শর্টকাটে বড়লোক হতে গিয়ে

5

বিদেশিরা মেটাল কয়েন গবেষণার কাজে ব্যবহার করেন। এই কয়েন বিক্রি করে ভালো মুনাফা পাওয়া যায়। হাজার কিংবা লাখে নয়, মাত্র ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করলে দুই দিনের ব্যবধানে পাওয়া যাবে শত কোটি টাকা। এমন প্রলোভন দেখিয়েই এক ব্যক্তির কাছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। শুধু এই ‘মেটাল কয়েন’ নয়; কখনও সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, কখনও মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের লোক ও আবার কখনও বড় ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে সুযোগ বুঝে ফাঁদ পাতছে প্রতারকরা। লোকজনদের টার্গেট করে, ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টা করে। তাদের এই পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে শর্টকাটে ধনাঢ্য হতে গিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকে। চক্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না নামি-দামি লোকজনও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, অল্প সময়ে ধনী হতে গিয়ে নিজেদের সতর্কতার অভাবেই বিভিন্নক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছেন মানুষ। না বুঝে যার-তার সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করা; লেনদেনের প্রকৃত চ্যানেল না জানা; কোনো রেকর্ড না রাখা; না বুঝে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেওয়া; এমনকি ব্যক্তির বিষয়ে খোঁজ-খবর না নেওয়া- মূলত এসব কারণেই লেনদেন করে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে।
সম্প্রতি ‘মেটাল কয়েনে’ বিনিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করা চক্রটির দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ বিষয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, প্রথমে চক্রটি মানুষের সঙ্গে সখ্য ও বিশ্বাস স্থাপন করে। এরপর তাদের মেটাল কয়েনে ইনভেস্ট করার কথা বলে। এভাবেই ভুক্তভোগী মো. রফিকুল ইসলাম নামে ব্যক্তিকে প্রতারকরা তাদের পূর্বে নির্ধারিত স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে মেটাল কয়েনকে বৈদ্যুতিক আলোর স্পর্শে এনে বিভিন্ন রিফ্লেকশনের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দেখান। বাস্তবে এমন কোনো কয়েনের অস্তিত্ব এখনও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকটা ‘তক্ষক’, ‘সীমান্ত পিলার’-এর মতো এটিও একটি প্রতারণার কৌশলমাত্র। আর এতেই অনেকটা লোভে পড়ে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হন রফিকুল ইসলাম। পরবর্তী সময়ে উপায় না পেয়ে তিনি মামলা করেন। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
আরেক ভুক্তভোগী আইনজীবীর মেয়ে গত বছর এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। ওই আইনজীবীর ফোনে একটি মেসেজ আসে। সেখানে জানানো হয় ভালো রেজাল্টের জন্য তার মেয়ে প্রতি মাসে ৫ হাজার ২০০ টাকা করে উপবৃত্তি পাবে। স্কলারশিপের টাকা জমা হবে, সে জন্য একটি বিকাশ নম্বর ও মেয়ের মোবাইল নম্বর এবং এনআইডি নম্বর জানতে চান। পরে ভুক্তভোগীর বিকাশ নম্বরে বিভিন্ন মেসেজ আসে এবং একাধিক কোড ভুক্তভোগী সরবরাহ করে। একপর্যায়ে ফোন করে মোবাইলে ক্যালকুলেটর দেখতে বলে। নির্দিষ্ট একটি নম্বরের সঙ্গে অপর একটি নম্বর এবং বিকাশের পিন যোগ করে যোগফল জানতে চাইলে ভুক্তভোগী যোগফল জানায়। পরে বিকাশ অ্যাকাউন্ট চেক করে দেখেন তার ১ লাখ টাকা কেটে নেওয়া হয়েছে। পরে এভাবে আরও ১ লাখ ৮০ হাজার টাকাসহ মোট ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় একটি চক্র। সম্প্রতি এই চক্রের সদস্য মো. সাজ্জাত হাওলাদার (২৬) নামে এক প্রতারককে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
ডিবি জানায়, গ্রেপ্তার প্রতারক সাজ্জাত ফরিদপুরের বাসিন্দা। তিনি ঢাকায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। স্বল্প পরিশ্রমে অধিক টাকা উপার্জনের লক্ষ্যে এলাকার সমবয়সি বন্ধুরা মিলে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল রপ্ত করেন। পরে তারা সংঘবদ্ধ চক্র গড়ে তুলে ব্ল্যাকমেইলিং বা বৃত্তির টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন।
এদিকে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সিঙ্গাপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং ম্যানেজার পরিচয়ে প্রতারণা করে আসছিল রিয়াজুল ইসলাম নিলয় চৌধুরী নিল নামে এক প্রতারক। ফেসবুকে ভুয়া জৌলুসপূর্ণ প্রোফাইল তৈরি করে নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদ, পরে বিয়ের প্রলোভন ও স্বপরিবারে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করার অভিযোগে তাকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।
পুলিশ জানায়, ফেসবুক প্রোফাইলটিকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য রিয়াজুল নিয়মিত অন্য একজন সিঙ্গাপুর প্রবাসীর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে ছবি ও ভিডিও পোস্ট করতেন। প্রতারক রিয়াজুল ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ এবং পেজে নিঃসঙ্গ নারীদের টার্গেট করে মেসেঞ্জারে যোগাযোগ করে প্রথমে প্রেমের ফাঁদ, পরে বিয়ের প্রলোভন ও স্বপরিবারে সিঙ্গাপুরের নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাতেন। সে অডিও-ভিডিওকলে অনলাইন প্রণয়ের এক পর্যায়ে ভুক্তভোগীর কাছ থেকে অন্তরঙ্গ ছবি ও ভিডিও নিয়ে পরবর্তীতে সেগুলো ভাইরাল করে দেবে বলে ব্ল্যাকমেইল করে ভুয়া এনআইডি নিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা বিকাশ নম্বরে অর্থ গ্রহণ করতো।
এছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কথিত এক বিকাশ কর্মকর্তার প্রতারণার ফাঁদে পড়েছিলেন চিত্রনায়িকা প্রার্থনা ফারদিন দীঘি। ওই ফাঁদে পড়ে নিজের বিকাশ অ্যাকাউন্ট নম্বর থেকে হারান দেড় লক্ষাধিক টাকা। প্রথমে দীঘির মোবাইল ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। অপর পাশের ব্যক্তি ওই ব্যক্তি নিজেকে বিকাশ অফিসের কর্মী দাবি করেন। বিকাশ অ্যাকাউন্ট ব্লক হওয়ার তথ্য জানিয়ে ঠিক করে দেওয়ার নামে দীঘির কাছে একটি ওটিপি নম্বর চাইলে সরল মনে সেটা দিয়ে দেন অভিনেত্রী। এর কিছুক্ষণ পরই বিকাশ অ্যাকাউন্টের ব্যালেন্স চেক করলে দীঘি দেখতে পান, তার অ্যাকাউন্ট থেকে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকা উধাও। পরে তিনি শেরেবাংলা নগর থানা ও ডিবিতে অভিযোগ করেন। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ ডিবি। এসময় উদ্ধার হয় হাতিয়ে নেওয়া টাকাও।
শুধু এসব ঘটনা নয়, সম্প্রতি এমন আরও বহু ঘটনা ঘটেছে। এসব প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সব হারিয়ে পথে বসেছে অনেকে। এতো ঘটনার পরও কেন সচেতন হচ্ছে না মানুষ বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন।
এ প্রসঙ্গে পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অল্প সময়ে ধনী হতে গিয়ে নিজেদের সতর্কতার অভাবেই বিভিন্নক্ষেত্রে প্রতারিত হচ্ছেন মানুষ। না বুঝে যার-তার সাথে আর্থিক লেনদেন করা। লেনদেন করা প্রকৃত ওয়ে না জানা। লেনদেন করার সময় কোনো রেকর্ড না রাখা। না বুঝে ব্যক্তি তথ্য দিয়ে দেওয়া। যার সঙ্গে লেনদেন করছে তার বিষয়ে খোঁজ খবর না নেওয়া। ব্যক্তি কোন পেশা সঙ্গে জড়িত আগে থেকে না জানা। এসব কারণে লেনদেন করে প্রতারিত হচ্ছেন অনেকে। এসব প্রতারকরা ক্যাশে লেনদেন করে। ব্যাংকে করে না। প্রলোভনে পড়ে যে টাকা বিনিয়োগ করছে, ওই ব্যক্তি কেন বুঝতে পারছে না কোটি কোটি টাকা এভাবে ক্যাশে লেনদেন করা যায় না। আমি একজন ভুক্তভোগীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি ১ কোটি টাকা পেলেন কোথায়। উত্তরে বললেন তার বন্ধুর কাছ থেকে নিয়েছে। আমরা খোঁজ নিয়ে দেখেছি বন্ধুই দিয়েছে। বন্ধু লেনদেন করছে, অথচ কোনো খোঁজ খবর নিচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, প্রতারক চক্রগুলো আগেই থেকে টার্গেট করে যাদের কাছে জমানো টাকা আছে, তাদের কৌশলে ম্যানেজ করেই কাজগুলো করে। আসলে যাদের অলস টাকা, আরও টাকা বাড়ানোর জন্য, অল্প সময়ে ধনী হয়ে উঠতে মূলত এ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে। পরে নিজেরাই সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়।
বিকাশ ও অনলাইন ব্যাংকিং সাহায্যের নামে প্রতারণার প্রসঙ্গে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ও গোয়েন্দা প্রধান হারুন অর রশীদ বলেন, সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের সক্রিয় সদস্যরা ব্যক্তির অজান্তে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন করা সিম ব্যবহার করে। সিমগুলো দিয়ে বিকাশ বা নগদ কাস্টমার কেয়ারের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে কৌশলে টার্গেট করা ব্যক্তিকে ফোন কল করে তার বিশ্বাস অর্জন করে। এরপর বিভিন্ন কথা বলার পর অবৈধভাবে টার্গেট ব্যক্তির বিকাশ একাউন্টে লগ-ইন করার জন্য তার নম্বরে ওটিপি পাঠিয়ে দেয়। তারপর টার্গেট ব্যক্তিকে তার মোবাইলে যাওয়া ওটিপি বলার জন্য অনুরোধ করে। নায়িকা দীঘি সরল বিশ্বাসে এবং তার বিকাশ অ্যাকাউন্ট সচল করা বা অন্য কোনো আশায় তার মোবাইলে আসা ওটিপি বলে দেয়। এরপর প্রতারক চক্র দীঘির অ্যাকাউন্টে লগইন করে ভুয়া নামে বিকাশ রেজিস্ট্রেশন করা নম্বর দিয়ে টাকা তুলে নেয়। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ওই টাকা নগদ উত্তোলন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। এভাবে দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষ এসব চক্রের প্রতারণার শিকার হচ্ছে বলেও জানান মহানগর গোয়েন্দা প্রধান।