লেখকের স্বাধীনতা ও অধিকার : প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ

3

মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম

একজন লেখক সমাজকে জাগ্রত করতে লিখেন। অনেক সময় তার না বলা কথা, না লিখতে পারায় ছট ফট করেন বা সত্য প্রকাশে অনেকের রোষানলে পড়েন বা মানুষকে আলোকিত করতে গিয়ে নিজে অর্থনৈতিক ভাবে আলোহীন হয়ে বেঁচে থাকেন আর বেঁচে থাকা যেন প্রতিটি লেখকের ভাগ্যের নিয়তি। আমাদের সমাজে লেখকের যে সুখ্যাতি ও সুনাম রয়েছে তা লেখককে সাময়িকভাবে তৃপ্তি দেয়। এ সমাজে লেখককে সবাই ভুল বুঝে, অর্থনৈতিক নানা টানাপোড়নে লেখকমন সারাক্ষণ অস্থির থাকে তারপরও সমাজের নানা অপমান, হুমকি উপেক্ষা সহ্য করে সমাজকে আলোকিত করতে লেখক লিখে থাকেন। এই সমাজের উন্নয়ন গণমানুষের উন্নয়ন সমাজ পরিবর্তনের দিন গুনে লেখক লিখেন আর আগামী প্রজম্মের মঙ্গল কামনায় সোনালী ভোরের প্রত্যাশায় সেই লেখক বেঁচে থাকেন। লেখকের জীবন মান উন্নয়ন বিশেষ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে লেখকরা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আশা করেন এমনকি লেখকরা বিভিন্ন সময়ে যে সব নানাবিধ দাবি জানিয়েছেন, তারা সেসব দাবিকে অধিকার হিসাবেও দেখেন। তাছাড়া লেখক যে গ্রন্থ রচনা করেন, লেখকের গ্রন্থস্বত্ব মূলত তার সম্পদ অন্যান্য সম্পদের মত সংরক্ষণের অধিকার সেই লেখকই রাখেন এবং লেখক ইচ্ছা করলে তার সম্পদ বা স্বত্ব বিক্রিও করতে পারেন। গ্রন্থস্বত্ব সংরক্ষণ করা বৈধ এবং এর বেচাকেনাও বৈধ।
অনুমতি ছাড়া কারো হস্তক্ষেপ করা অন্যায় অনৈতিক অবৈধ। বই লিখে প্রকাশক কর্তৃক ছাপিয়েছে এবং লেখক নির্ধারিত যে রয়্যালিটি পেয়ে থাকেন তাতে একজন লেখক কোন ভাবে নিজের বা পরিবার পরিচালনা করতে সম্পুর্ণ অক্ষম সেই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কল্যাণে মানুষের কল্যাণে যখন একজন লেখক লিখেন তখন তার অধিকার বাস্তবায়ন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব বলে লেখকরা মনে করেন। গত কয়েক বছর ধরে কলম একাডেমি লন্ডন নামীয় একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য ও সমাজ কল্যাণ মূলক সংগঠন প্রতি বছর ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব লেখক অধিকার দিবস পালন করে আসছে। তারা মূলত দিনটির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি চায়। তাদের উনিশ দফা দাবি রয়েছে সেসব দাবির মধ্যে অন্যতম দাবি হচ্ছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে আলাদা লেখক মন্ত্রণালয় ছাড়াও সুবিধা বঞ্চিত লেখক ও তার পরিবারের জন্য সরকারি ভাতা। পরিবারের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনে সরকারি খরচে আইনি সহায়তা, বাংলাভাষা বিশ্বময় প্রচার ও প্রসারে দেশে বিদেশে লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠাকরণ, সভা- সেমিনার ও বাঙালি লেখকদের গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী প্রচার করা সহ সংগঠনের পক্ষে নানাবিধ দাবি বাস্তবায়নে দীর্ঘদিন ধরে তারা চেষ্টা করছেন যদিও স্বাধীন বাংলাদেশে সম্পূর্ণ পৃথক সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামীয় দুইটি মন্ত্রণালয় রয়েছে। সাংবাদিকদের জীবন মান উন্নয়নে বিভিন্ন সময়ে তথ্য মন্ত্রণালয় এগিয়ে আসলে ও লেখকদের জীবন মান উন্নয়নে বাংলাদেশের কোন মন্ত্রণালয় কখনও তেমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করেননি। অনেকে মনে করেন, লেখক কারা, কিভাবে সরকার তা নির্ধারণ করবে বা নির্ধারণের মাপকাঠি কি কি এই সব বিষয়ে সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। লেখকদের যৌক্তিক দাবি সমূহ রাষ্ট্র দ্রæত বাস্তবায়ন করবে বলে লেখক সমাজ আজও মনে করে। সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সুরক্ষার জন্য বার্ন কনভেনশন এবং অন্যান্য অনুরূপ চুক্তি দ্বারা লেখক দের অধিকার আন্তর্জাতিক ভাবে সুরক্ষিত। লেখকের স্বাধীনতা, লেখকদের অধিকার নিয়ে সব লেখকরা সব সময় সোচ্চার।লেখকের অধিকারের দুটি স্বতন্ত্র উপাদান থাকে যেমন-কাজের অর্থনৈতিক অধিকার এবং লেখকের নৈতিক অধিকার। লেখকদের অর্থনৈতিক জীবন মান উন্নয়নে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এটি সকল লেখকের প্রত্যাশা।
লেখক হবেন তিনি যিনি বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য শিল্প এবং সৃজনশীল লিখনীর মাধ্যমে সমাজকে জাগ্রত করেন একজন লেখক উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা নাটক, চিত্রনাট্য, প্রবন্ধ, বিভিন্ন প্রতিবেদন লিখতে পারেন একটি সমাজ উন্নয়ন ও সংস্কৃতিতে লেখক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। লেখকের বাস্তব জীবনের যে অনুভূতি তা মূলত সাহিত্য। যে সাহিত্য রচনা করেন অনেকের মতে তিনি সাহিত্যিক হলেও মূলত তিনিএকজন লেখক সাহিত্যিক তিনি যিনি গদ্য, প্রবন্ধ রচনা করেন। একজন লেখক বিভিন্ন ধারায় তার নিজের সৃজনশীল চিন্তা চেতনা প্রকাশ করতে পারেন। প্রথমে কোন লেখক সাহিত্য প্রীতি থেকে যখন লিখেন তখন থেকে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারায় তিনি লিখতে পারেন। লিখার ক্ষেত্রে তার তেমন কোন বাধ্যবাদকতা নেই। ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল প্রথমে সাহিত্য জগতে পা রাখেন এরপর তিনি ভ্রমণ সাহিত্য রচনা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিভিন্ন বিষয়ে তিনি লিখতেন। অনেক লেখক আছেন যারা কথাসাহিত্য রচনার পাশাপাশি তারা কাব্য ও রচনা করেন। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, ডরোথি সায়ার্সের কথা তিনি অপরাধ কল্প কাহিনী লিখেছেন অন্যদিকে তিনি ছিলেন নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং সমালোচক।সর্ব ক্ষেত্রে তিনি নন্দিত ছিলেন। একজন লেখক কখন কি লিখবে সেটি তার একান্ত নিজস্ব স্বাধীনতা। এক্ষেত্রে পাঠক বা অন্য কারও বলা উচিত নয় এই যে, ঐ লেখকের ঐ বিষয়ে লিখা উচিত ছিল বা তিনি লিখতে পারতেন আসলে সব লেখকের কাজ হচ্ছে সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজের অবক্ষয় সহ নানাবিধ বিষয়ে তার নিজস্ব চিন্তা চেতনা থেকে সমাজকে জাগ্রত করা। আমার মতে, পৃথিবীর সব লেখক স্বাধীন। লেখার আগে একজন লেখককে প্রথমে সত্যিকার অর্থে মনে করতে হবে তিনি স্বাধীন,তিনি নির্ভয়ে লিখতে পারবেন তার সত্য লিখনী প্রকাশে তার ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জীবনে অন্তত কোন সমস্যা সৃষ্টি হবেনা। সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে সর্বদা সর্বত্র অনুকূল পরিবেশ থাকতে হবে আর অন্যদিকে যে পরিবেশ থাকুক না কেন সব পরিবেশে লেখক সব সময় যা ভাবেন তা লিখার বা বলার স্বাধীনতা তার থাকতেই হবে বা তাকে দিতে হবে। যে কোন লেখক তার,চিন্তা চেতনা থেকে লিখেন। একজন লেখকের মনুষ্যত্বে এই বিশ্বাস থাকতেই হবে যে কোনো অবস্থাতেই তার চিন্তার স্বাধীনতা সে বিসর্জন দিবে না। যদি দেয় তাহলে সে লেখক নয় কখনও মানুষ ছিল না। সুবিধা ক্ষমতা প্রাপ্তিতে লেখক সীমা লঙ্ঘন করে এমন কি তার চিন্তা, চেতনা তখন সংকোচিত হয় তখন প্রকৃত সত্য প্রকাশে তিনি অনীহা প্রকাশ করেন বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় অনেক জ্ঞানী,গুনী লেখকের কর্মযজ্ঞ সুন্দরের পথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সৎ, মননশীল লেখকরা সব সময় শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় অসহায় বোধ করেন। দেশ স্বাধীন হলে হবে না লেখককে লিখতে স্বাধীনতা দিতে হবে। কল্পনায় অবাধ হতে না পারলে লেখক কিছুতেই লেখক হতে পারেন না। আমাদের দেশে লেখক, বুদ্ধিজীবীরা কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত তখন তারা তাদের জীবিকা হারাবার ভয়ে সব সময় সন্ত্রস্ত থাকেন ফলে যে সময় যে সরকার থাকে তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেককে লিখতে হয় এবং লেখা ও তাদের ছাপাতে হয়। আবার অনেক সময় অনেক তথাকথিত লেখক নিজকে রক্ষার্থে বা কারও রোষানলে পড়বেন ভেবে সত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকেন। উদাহরণ স্বরূপ ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে অনেক লেখক সত্য প্রকাশ না করে বিগত শাসকের তাবেদারী করতে গিয়ে ও অন্যায়কে মৌন সমর্থন জানিয়ে তার লেখকত্ব হারিয়েছেন। লেখক হবে নিঃস্বার্থবান, সৎ, কখন ও অন্যায়ের সাথে আপোস করবে না,স্বাধীন ভাবে মত প্রকাশ করবে। একজন লেখক পারে একটি জাতিকে নৈতিক আর মন-মানসের দাসত্ব থেকে বাঁচাতে তাই নজরুল আজো আমাদের সকলের নিকট একটি আদর্শ। প্রত্যেক লেখকদের একটি তৃতীয় চোখ থাকে সে চোখ দিয়ে তারা সব কিছু দেখতে পায়। পৃথিবীর সব শাসকরা জানে, স্বাধীনতা, সংগ্রামে, বিদ্রোহ সহ সব কিছুর বীজ লেখকদের কলমের মুখ থেকে নিঃসৃত হয় আর ধীরে ধীরে যা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। অন্যদিকে কলম কখনও কথা বলে না সেই কলমকে দিয়ে সত্য প্রকাশ করা ও কলমের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্ব সব লেখকদের।
সমাজে যখন চারিদিকে অন্যায়, স্বৈরাচারী শাসন, নানা অবিচার মিথ্যা আর মিথ্যা অনাচার তখন লেখক কে প্রতিবাদ করতে হবে,অসত্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে সমাজ কে জাগ্রত করতে হবে। লেখকের স্বাধীনতা যে শুধু লেখকের জন্যই প্রয়োজন তা মোটেই নয় দেশের প্রতিটি মানুষের বুদ্ধি আর মানসিকতা বিকাশে তা অত্যাবশ্যক।’ একটি সমাজ তখনই সুস্থ থাকে যেখানে লেখকরা রাষ্ট্র বিকাশে ও মানুষের কল্যাণে স্বাধীন ভাবে তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, জনগণের কল্যাণের সংগ্রাম,লেখক দের সংগ্রাম সেই লেখকরা সমাজে আজ নানা ভাবে নিগৃহীত হচ্ছে। লেখক যেখানে সমাজে আলোকবর্তিকা সেখানে সেই লেখকের জীবন মান উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন সর্বোপরি সত্য তথ্য প্রকাশ বা লিখা বা বলার ক্ষেত্রে লেখকের স্বাধীনতার কোন বিকল্প নেই। লেখকের সুন্দর ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার ও লিখার স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলে একটি সমাজ, দেশ সুন্দর ভাবে সামনে এগিয়ে গিয়ে সুন্দর একটি সমাজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে আর এতে রাষ্ট্রের যথাযথ সুষ্ঠু কর্ম পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক