লালদিঘির মাঠের সবুজ ধূসরে বিলীন

3

রাহুল দাশ নয়ন

চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠ। এই মাঠটির সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মাঠেই ঐতিহাসিক ছয়দফা দাবির পক্ষে প্রথম জনসভা করেছিলেন। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করা প্রায় নেতা এই মাঠে ভাষণ দিয়েছেন। যে কারণে ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে লালদিঘি মাঠের ঐতিহাসিক ছয়দফার স্মৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু উদ্বোধনের দেড় বছরের মাথায় লালদিঘি মাঠের সবুজ সৌন্দর্য্য ধূসরে বিলীন হয়েছে। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না রাখায় মাঠটি যেমন বালুময় তেমনি ছয়দফার স্মৃতি সম্বলিত মঞ্চটিও ভাসমান মানুষের নিদ্রাঘরে পরিণত হয়েছে।
নগরের কোতোয়ালী আসনের সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের প্রচেষ্টায় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ছয়দফা দাবির স্মৃতি সংরক্ষণে চার কোটি ১৭ লাখ টাকা ব্যয়ে লালদিঘি মাঠের সৌন্দর্য্য বর্ধন ও অবকাঠামো নির্মাণ করে। ২০২২ সালের ৪ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পলোগ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত জনসভায় ‘সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের লালদিঘি মাঠের ছয় দফা মঞ্চ ও মাঠ সংস্কার কাজ’ শীর্ষক প্রকল্পটির উদ্বোধন করেন। ২০২৩সালের ২জানুয়ারি মাঠটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হলে মাঠটি রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্ব পায় সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
চট্টগ্রাম শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপংকর খীসা পূর্বদেশকে বলেন, ‘উন্মুক্ত হওয়ার কারণে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে। গেট তালাবদ্ধ রাখা গেলে সৌন্দর্য্য থাকতো। এখন যারা রক্ষণাবেক্ষনের দায়িত্বে আছে তারা যদি ঠিকমতো দেখভাল করতো এমন অবস্থা হতো না। কর্তৃপক্ষ চাইলে সুন্দর রাখা সম্ভব। এখন যেহেতু আমি বিষয়টি অবগত হয়েছি প্রস্তাবনা দিয়ে সুন্দর রাখার চেষ্টা করবো।’
সরকারি মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোরশেদ জামান পূর্বদেশকে বলেন, ‘পানির স্তর নেমে গেছে। পানি না থাকার কারণে ঘাসগুলো মরে গেছে। যতটুকু পারি দেখার চেষ্টা করি। ম্যুরালের দু’একটা কাঁচ ভেঙ্গে গেছে। ছেলেরা খেলাধুলা করলে এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। আসলে দুইজন গার্ড দিয়ে এতবড় মাঠ রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিন।’
সরেজমিনে মাঠটি ঘুরে দেখা যায়, ওয়াকওয়ের পাশে নির্মাণ করা বসার সিটগুলোতে প্রায়সময় ভাসমান লোকজন শুয়ে থাকে। ঐতিহাসিক ছয়দফা মঞ্চটিও সযত্নে রাখা হয়নি। বৃষ্টির জমে থাকা পানিতে মঞ্চটির অবস্থা স্যাঁতসেঁতে। বামপাশের দেয়ালে লাগানো টেরাকোটাগুলো ঝাপসা আবরণ ধারণ করেছে। ভেঙ্গে গেছে ‘১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক টেরাকোটায় লাগানো কাঁচের গ্লাস। পূর্ব-উত্তর দেয়ালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেল, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ, মানুষকে সাহায্য করাসহ গ্রামীণ দৃশ্যপট নিয়ে শিক্ষামূলক জনজীবনের আঁকা ছবিগুলো লতাপাতায় ঢেকে গেছে। পুরো ওয়াকওয়ে ঝরাপাতায় ভরপুর। দেড় বছর আগে লাগানো মাঠের সবুজ ঘাস আর নেই। ঘাসবিহীন পুরোমাঠ বালুময়। নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন না করায় এবং সঠিক রক্ষণাবেক্ষনের অভাবেই মাঠটির সৌন্দর্য্য বিনষ্ট হয়েছে।
একটি সিকিউরিটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে লালদিঘি মাঠের পাহারাদারের দায়িত্বে আছেন আব্দু ছালাম। তিনি বলেন, ‘মাঠ রক্ষণাবেক্ষনে আমরা দুইজন দায়িত্ব পালন করছি। কোম্পানির চাকরি করলেও বেতন দেন মুসলিম স্কুল কর্তৃপক্ষ। মাঝেমধ্যে মাঠ পরিষ্কার করা হয়। ছেলেরা নিয়মিত ফুটবল খেলায় ঘাস উঠে গেছে। মাঠে কোন সমাবেশ হয় না। ছোট ছেলেরা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে আঘাত করায় গøাস ভেঙ্গে গেছে। যখন মুসলিম স্কুল থেকে অর্ডার দিলেই মাঠটি পরিষ্কার করা হয়। নগর পরিষ্কারের দায়িত্বে থাকা লোকজন এটি পরিষ্কার করেন।’
মাঠের পাশে লাগানো টাকবাদামের গাছতলে বসে প্রশান্তি খুঁজছিলেন কোর্টে মামলার হাজিরা দিতে আসা জয়নাল আবেদীন। তিনি বলেন, ‘এই মাঠটিতে যখন ঘাস ছিল তখন অনেক সুন্দর ছিল। ঘাসগুলো চলে যাওয়ায় এটি আবারও আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। ছেলেরা খেলাধুলা করলে ঘাস চলে যাবে এটা ভুল। মূলত অযতœ ও পরিচর্যার অভাবেই মাঠের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। যে ঘাস খেলাধূলা করলে নষ্ট হবে সেগুলো লাগানোই উচিত হয়নি।’