রাসেলস ভাইপার আতঙ্কে নির্বিচারে সাপ হত্যা প্রকৃতির জন্য অশনি সংকেত

2

মো. দিদারুল আলম

বাংলাদেশে আবহাওয়ার যে প্রকৃতি, তাতে এ দেশে সরীসৃপজাতীয় শীতল রক্তের প্রাণিদের জীবনযাপনের জন্য একেবারে উপযুক্ত বলা যেতে পারে। বছরে তিন মাস হালকা শীতকাল, বাকি আট মাস গরমকাল অধিকাংশ সময় বৃষ্টিপাত হয়। ফলে এ দেশে নানা জাতের গাছপালা জন্মায়, রয়েছে হাজারো প্রজাতির কীটপতঙ্গ। এমন পরিবেশ সাপের বসবাস ও বিকাশের জন্য আদর্শ। বাংলাদেশ ১ লাখ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারের ছোট দেশ হলেও এখানে বিকশিত হয়েছে ১০০ প্রজাতিরও বেশি সাপ। এদের মধ্যে ২৬টি প্রজাতি মরণ বিষের অধিকারী। বাকিগুলোর মধ্যে অন্তত ৬টি প্রজাতির সাপ খুব ভালোভাবে কামড়ালে মানুষ মারা পড়বে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায়। যার মধ্যে প্রায় সাড়ে ০৭ হাজার মানুষ মারা যায়। যাদের বেশির ভাগই গ্রামের সাধারণ ও দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুলনা বিভাগের মানুষ সর্পদংশনের শিকার হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। খুলনা বিভাগের চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, নড়াইল থেকে শুরু করে বাগেরহাট, সাতক্ষীরা সব অঞ্চলেই সর্পদংশনের ঘটনা রয়েছে। এই অঞ্চলে গোখরা, কেউটে, কোবরা, রাসেল ভাইপার সাপের দংশনে বেশি মানুষ মারা যায়। মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে সাপের উপদ্রব বেশি দেখা যায়। এর বাইরে সারা বছরই সাপের কামড়ে অনেকে আক্রান্ত হন।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ম্যানেজমেন্ট অভ স্নেকবাইট-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে সাপের প্রায় ১০০ প্রজাতি রয়েছে। এগুলোর ১৬টি সামুদ্রিক সাপ, তিনটি গোখরা প্রজাতি, শঙ্খিনীর পাঁচটি প্রজাতি, দুই ধরনের প্রবাল সাপ, ছয় ধরনের গ্রিন পিট ভাইপার এবং একটি রাসেল ভাইপার তথা চন্দ্রবোড়া। পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই বিষধর সাপের অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে, প্রতি বছর ৬৪ হাজারের বেশি ভারতীয় সাপের কামড়ে মারা যান যা বিশ্বে বার্ষিক সর্পদংশনে মৃত্যুসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি।
আমাদের দেশে সাপ নিয়ে প্রচুর কুসংস্কার রয়েছে। বীণ বাজিয়ে সাপ আনা, সাপ দুধ খায়, দাঁড়াশ সাপ মারাত্মক বিষধর-লেজ দিয়ে বাড়ি দিলে মানুষ বাঁচে না, বাড়ি দেওয়ার স্থান পচে যায়, সাপ মানুষকে চিনে রাখে, আঘাত করলে রাতে বাসায় এসে কামড় দেয়, সাপ কামড়ালে ওঝা ভালো করতে পারে ইত্যাদি হলো কুংসস্কার।
দেশে এত বেশি মানুষ মারা যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাড়াতাড়ি হাসপতালে নিতে দেরি করা। আর এন্টিভেনামের সহজপ্রাপ্যতা আর আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যেসব অ্যান্টিভেনম আমদানি করে, তার মেয়াদকাল থাকে ৪ বছর। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো বিতরণ করা হয় ৩ বছর পর। বেশিরভাগ চিকিৎসকই সাপের বিষের চিকিৎসা জানেন না। সাপ চেনেন না। উপসর্গ বোঝেন না। দুই ধরনের সাপের কামড়ের চিকিৎসা দুই রকম। বিষধর সাপের কামড়ে সাধারণত দুটি ক্ষত হয়, তবে নির্বিষ সাপের কামড়ে চার থেকে ১৬টি পর্যন্ত ক্ষত দেখা যেতে পারে। তাঁরা রোগীর আত্মীয়দের বোঝান, তাদের কাছে সিরাম নেই। অন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। পথেই রোগীর মৃত্যু হয়। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত, সাপে কামড়ানোর বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া আর চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা।
বিষধর সাপের কামড়ে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ সময় আক্রান্ত ব্যক্তি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। উদ্বেগজনক ভীতি রোগীকে মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তিকে আশ্বস্ত করতে হবে যে, ভয়ের কিছু নেই। সাপে কাটা রোগী অতিরিক্ত নড়াচড়া করলে মাংসপেশির সংকোচন-প্রসারণে বিষ দ্রæত পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই ছোটাছুটি বা অস্থির হওয়া যাবে না। হাসপাতালে রোগীকে হাঁটিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে গাড়ি, রিকশা কিংবা হুইলচেয়ার করে নিতে হবে। গাড়ির ব্যবস্থা না থাকলে কাঁধে বা খাটিয়ায় করে নিয়ে যেতে হবে।
সাপে কাটার পর প্রথম কাজই হলো যত দ্রæত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। একবিংশ শতাব্দিতে এসেও অনেকে ঝাড়ফুঁক, ওঝা ও বৈদ্যে বিশ্বাস রাখেন। কোনোভাবেই ওঝা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। পরীক্ষিত ডাক্তারের কাছে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। কিছু সাপ কাটলে তৎক্ষণাৎ টের পাওয়া যায় না। যেমন কালাচ। এ সাপ অত্যন্ত বিষধর, কিন্তু বিষদাঁত ছোট হওয়ায় প্রাথমিকভাবে বোঝা যায় না, শুধু বমিভাব বা পেট খারাপের মতো উপসর্গ দেখা যায়। তাই এসব লক্ষণ দেখলে কোনোভাবেই অবহেলা করা যাবে না।
প্রতিষেধক তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণার সুবিধার্থে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে দেশের একমাত্র সাপের অত্যাধুনিক গবেষণাগার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, এই গবেষণাগারে নানা প্রজাতির সাপ পালনের পাশাপাশি বিষ সংগ্রহ করা হবে। পরবর্তীতে বিষ থেকে তৈরি হবে সাপের বিষের প্রতিষেধক। বিদেশ থেকে আনা সাপের বিষের প্রতিষেধক তেমন কার্যকর না হওয়ায় এই গবেষণাগারের উদ্ভাবিত প্রতিষেধকই আগামীতে কাজে লাগানো হবে। বিষধর সাপের অনন্য এক সংগ্রহশালা গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামে। যেখানে আছে ৯ জাতের ৩ শতাধিক সাপ। সাপের দংশনের প্রতিষেধক তৈরির জন্যই ব্যতিক্রমী এ প্রকল্প এবং খুব শিগগিরই তারা প্রতিষেধক তৈরি করতে যাচ্ছে।
সম্প্রতি রাসেলস ভাইপারের উপস্থিতি উদ্বেগজনক হলেও এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষের সাথে এই সাপের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সাপ সাধারণত নিচুভূমির ঘাসবন, ঝোঁপ-জঙ্গল, উন্মুক্ত বন, কৃষি এলাকায় বাস করে এবং মানুষের বসতি এড়িয়ে চলে। সাপটি মেটে রঙের হওয়ায় মাটির সাথে সহজে মিশে যেতে পারে। মানুষ খেয়াল না করে সাপের খুব কাছে গেলে সাপটি বিপদ দেখে ভয়ে আক্রমণ করতে পারে। রাসেলস ভাইপার দক্ষ সাঁতারু হওয়ায় নদীর ¯্রােতে ও বন্যার পানিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিস্তৃত হয়েছে। তাই, সকলকে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে এত আতঙ্কিত হওয়ার কারণে হচ্ছে, গত এক বছরে প্রথমে রাজশাহী অঞ্চল থেকে আসত ছোবলে আহত বা প্রাণ হারানোর খবর। চলতি বছর এখন পর্যন্ত অন্তত ১৬ জন রাসেলস ভাইপারের কামড় নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, যার মধ্যে ৫ জনের মৃত্যুর খবর মিলেছে।
বেজি, গুইসাপ, বাগডাশ, গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, মেছো বিড়াল, তিলা নাগ ঈগল, সারস, মদন টাক এবং কিছু প্রজাতির সাপ রাসেল’স ভাইপার খেয়ে এদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এসকল বন্যপ্রাণীকে মানুষের নির্বিচারে হত্যার কারণে প্রকৃতিতে রাসেলস ভাইপার’ বেড়ে যাচ্ছে। তাই বন্যপ্রাণী দেখলেই অকারণে তা হত্যা, এদের আবাসস্থল ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকুন। চন্দ্রবোড়ার চেয়েও অন্তত ১০ গুণ বেশি বিষধর সাপ কেউটে-কোবরা আমাদের প্রকৃতিতে আছে। হঠাৎ রাসেলস ভাইপার নিয়ে সংঘবদ্ধ আতঙ্ক কেন ছড়ানো হচ্ছে, এটা বুঝতে পারছি না।
অহেতুক বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার কারণে রাসেলস ভাইপার মনে করে অন্যান্য যেসব সাপ মেরে ফেলা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য আবারো হুমকির মুখে পড়বে। সাপের সংখ্যা ও বিচরণ কমে গেলে ক্ষতিকর পোকামাকড় ও ইঁদুরের সংখ্যা বেড়ে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে দেশের কৃষি উৎপাদন। বিশেষ করে ধান ও গমের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এছাড়াও খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে প্রকৃতি এবং ইঁদুরের মাধ্যমে ছড়ায় এমন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আতঙ্কিত মানুষের হাতে জীবন হারানো সাপগুলোর মধ্য অনেকটা চন্দ্রবোড়া সাপের মত দেখতে নির্বিষ অজগর, ঘরগিন্নি, হেলে সাপ ও মৃদু বিষধর নোনাবোড়া এবং পাতি ফনি মনসা অন্যতম।
স্মরণ রাখা প্রয়োজন, রাসেল’স ভাইপার বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ৬(১) ধারা অনুযায়ী সংরক্ষিত প্রাণী। রাসেলস ভাইপার ইঁদুর খেয়ে যেমন ফসল রক্ষা করে, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সাপের বিষ হতে অনেক জীবন রক্ষাকারী ওষুধ তৈরি হয়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও কলেজ শিক্ষক