রাসুলুল্লাহ ( )’র রওযা মোবারক যিয়ারতের নিয়তে সফর একটি জায়েয ও উত্তম আমল

5

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

মুমিন মুসলমানদের প্রাণের স্পন্দন, হৃদয়ের প্রশান্তি, নয়নের শীতলতা, ঈমানের আশ্রয়স্থল, রহমতের ফল্গুধারা, অগণিত ফেরেশতাদের যিয়ারতগাহ, জান্নাতের চেয়েও দামি, শ্রদ্ধা-সম্মান ও ভালোবাসার প্রাণ হলো; প্রাণের নবী সাইয়েদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন, সাইয়েদুনা মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রওযা মোবারক। জান্নাত প্রত্যাশী প্রতিটি মুমিন মুসলমানদের অন্তর সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকে নবীর রওযা মোবারক যিয়ারতের। যেখানে উম্মতের গুনাহ মাফ হবার এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুপারিশের প্রতিশ্রæতি দেয়া হয়েছে। এতে রয়েছে অনেক পূণ্য ও ফযিলত। যা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা সমর্থিত ও উত্তম ইবাদত হিসেবে গণ্য। রওযা পাকের যিয়ারতের ফযীলত কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
কুরআনুল করীমের দৃষ্টিতে : রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা পাক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করার নির্দেশ প্রদান করে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, “যদি কখনও তারা নিজেদের আতœার প্রতি জুলুম করে হে মাহবুব’ আপনার দরবারে হাজির হয়। অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর রাসুলও তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই তারা আল্লাহকে তাওবা কবুলকারী ও দয়ালু পাবে।”(সূরা আন নিসা, আয়াত- ৬৪)
এ প্রসঙ্গে মুসলমানের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুনিয়া থেকে পর্দা করার মাত্র তিন দিন পর এক বেদুইন নবীজির নূরানী রওযা পাকে উপস্থিত হয়ে রাওযা পাকের সামনে শুয়ে পড়লো এবং রাওযা পাকের নূরানী মাটি নিজের গায়ে-মাথায় লাগাতে লাগল আর আরয করতে লাগল, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা আপনার কাছ থেকে শুনেছি, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, ‘আর যদি কখনো তারা নিজেদের আত্মার প্রতি যুলুম করে তখন হে মাহবুব! (তারা) আপনার দরবারে হাযির হয়, অতঃপর আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে, আর রাসূল তাদের পক্ষে সুপারিশ করেন, তবে অবশ্যই আল্লাহকে অত্যান্ত তাওবা কবুলকারী দয়ালু পাবে।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত- ৬৪) ইয়া রসূলাল্লাহ! আমি গুনাহে লিপ্ত হবার মাধ্যমে আমার উপর যুলুম করেছি এবং আপনার দরবারে অসহায়বস্থায় হাযির হয়েছি যেনো আপনি আমার জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।” এদিকে লোকটি আরয করছিলো আর ঐদিকে নূরানী রাওযা থেকে আওয়াজ আসলো, যাও! তোমার গুনাহ ক্ষমা করে দেয়া হলো। (কানযুল উম্মাল, কিতাবুল আযকার, ২/১, ১৬৬ পৃষ্ঠা, হাদীস: ৪৩১৯)
অনুরূপ এক বর্ণনায় আল্লামা ইবনু জাওযী ‘উয়ুনূল হিকায়ত’ নামক কিতাবে বর্ণনা করেন, হযরত মুহাম্মদ বিন হরব হিলালী বলেন, একবার আমি রাওযায়ে মুস্তফায় উপস্থিত ছিলাম, দেখলাম এক বেদুঈন প্রিয় নবীজির রাওযা পাকে উপস্থিত হয়ে উপরোক্ত আয়াত তেলাওয়াত করে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি আমার গুনাহের জন্য আপনার উচ্চ দরবারে উপস্থিত হয়েছি, আপনাকে আল্লাহ পাকের দরবারে আমার সুপারিশকারী হিসাবে পেশ করছি। এটা বলার লোকটি কান্না করতে লাগলো এবং কবিতার ছন্দে বলতে লাগল, হে উৎকৃষ্ট সত্তা! যাঁর মোবারক শরীর এ যমীনে দাফন করা হলো, যাঁর শ্রেষ্ঠত্ব এবং পবিত্রতা দ্বারা ময়দান ও পর্বত সুগন্ধ হয়ে গেলো। আমার প্রাণ উৎসর্গ হোক এ নূরানী রাওযা পাকের প্রতি যেটাতে আপনি আরাম করছেন, যা পবিত্রতা, দক্ষিনা ও ক্ষমার অঢেল ভান্ডার।”
এসব কাব্যগুলো পুনরাবৃত্তি করতে থাকে আর গুনাহের ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে অশ্রæসিক্ত নয়নে বিদায় নিলো। হযরত মুহাম্মদ বিন হারব হিলালী বলেন, তখন স্বপ্নে দেখলাম যে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ডেকে বলছেন, হে আতবী! এ বেদুঈনের সাথে সাক্ষাৎ করো আর তাকে সুসংবাদ দাও যে, আল্লাহ পাক তাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। (বায়হাক্বী, ইবনু কাসীর প্রমূখ) তাই এই আয়াতের হুকুম সর্বদা বিদ্যমান।
হাদীস শরীফে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা পাক যিয়ারতের নিয়তে সফরের প্রমাণ :
এ সপ্রসঙ্গেরাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনেকগুলো হাদীস পাওয়া যায়। যেমন তিনি এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আমার কবর শরীফ যিয়ারত করল, তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে গেল।“ {ইবনে মাজা, হা-৩১১২)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি হজ্ব করেছে, অথচ আমার যিয়ারত করেনি, সে আমার উপর জুলুম করল”। {হাশিয়ায়ে মুয়াত্তা মালিক, হা-৯৪৭}
তিনি আরও ইরশাদ করেন, “যে আমার ওফাতের পর আমার যেয়ারতে আসবে সে যেন আমার যাহেরী হায়াতেই যেয়ারত করতে আসল। যে দুই হেরমের যে কোন একটিতে মৃত্যুবরণ করবে কেয়ামত দিবসে সে নিরাপত্তা প্রাপ্তদের সাথে উত্থিত হবে। ” (দারু ক্বুত্বনী, ২/২৭৮, হ- ১৯২, বায়হাক্বী, ৫/ ২৪৬)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, ‘যে-কেউ যিয়ারত করার উদ্দেশ্যে মদীনায় আসবে এবং আমার যিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার জন্যে শাফায়াত করবো এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য দেবো।’। {বায়হাকী, হা-১০০৫৩, শুয়াবুল ঈমান, হা-৪১৫৩}
তিনি আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি একমাত্র আমার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে আসবে, কিয়ামতের দিন সে আমার আশ্রয়ে থাকবে। আর যে মক্কা ও মদিনার কোনো এক হারাম শরীফে মৃত্যুবরণ করবে, সে কিয়ামতের দিন শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকবে। (আল বায়হাকি: শুআবুল ইমান, হা-৩৮৫৬।)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি মক্কা শরীফে গিয়ে হজ্জ আদায় করবে অতপর আমার মসজিদে এসে আমার যিয়ারত করবে তার জন্য দুটো মাবরূর হজ্জে সাওয়াব লেখা হবে। (আসসামহুদি: ওয়াফাউল ওয়াফা বিআখবারি দারিল মুস্তাফা, ৪:১৭৫।)
তিনি আরও ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমার ওফাতের পর আমার যিয়ারত করলো সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার জিয়ারত করলো। আর আমার উম্মতের মধ্যে যে ব্যক্তির দৈহিক ও আর্থিক শক্তি-সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও আমার যিয়ারতে আসবে না , তার কোনো ওজরই গ্রহণ করা হবেনা। (ইবনুন নাজ্জার: আদদিররাতুস সামিনা ফি আখবারিল মদিনা: ১৫৫।)
এ সকল হাদীস দ্বারা সুষ্পষ্টভাবে একথা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযায়ে আতহার যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা শুধু জায়েযই নয়, বরং অনেক উত্তম ও সাওয়াবের কাজ।
যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা পাক যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফরকে না-জায়েয বলে তাদের দলিল ও তার জবাব :
১. যারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযায়ে আতহার যিয়ারতের উদ্দেশ্য সফর করা শিরক, না জায়েয বলে তারা নিজেদের মতের পক্ষে নিম্নোক্ত হাদীস দ্বারা দলির পেশ করে থাকে। ‘তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোন মসজিদে (অধিক সওয়াবের আশায়) সফর করা জায়েয নেই: মসজিদুল হারাম, আমার এ মসজিদ ও মসজিদুল আক্সা।’[বুখারী : ১১৩২, ১১৮৯, মুসলিম: ১৩৯৭, ৩৪৫০।]
জবাব: জমহুর ওলামায়ে কিরাম উক্ত হাদীসটির ক্ষেত্রে বলেন, এ হাদীস শরীফে অধিক সওয়াবের আশায় তিনটি মসজিদ ছাড়া অন্য কোনও মসজিদে নামাযের উদ্দেশ্যে সফর করাকে নিষেধ করা হয়েছে, কেননা অন্যান্য সকল মসজিদে নামায পড়ার সাওয়াব সমান। কিন্তু এ তিন মসজিদে সওয়াব বেশি হওয়ায় এ মসজিদের উদ্দেশ্যে সফরের কথা বলা হয়েছে। তাইতো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “কোনও মুসল্লীর জন্য নামায আদায়ের লক্ষে তিনটি মসজিদ তথা মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আক্সা ও আমার এ মসজিদ ব্যতিরেকে অন্য কোনও মসজিদের উদ্দেশ্যে সফর করা উচিৎ নয়। (মুসনাদ-এ আহমদ: ৩/৬৪, হা-১১৬০৯)
কবর যিয়ারত সুন্নাত: যেহেতু কবর যিয়ারত হচ্ছে সুন্নাত। সুতরাং কবর যিয়ারতের জন্য সফর করাটাও সুন্নাত বলে বিবেচিত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “তোমরা কবর যিয়ারত কর, কারণ তা তোমাদেরকে আখেরাত স্মরণ করিয়ে দেয়।”(ইবনু মাজা, ১/১১৩, হা-১৫৬৯)
ফতওয়ায়ে শামী’র ভূমিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম শাফেয়ী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, আমি ইমাম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি থেকে বরকত হাসিল করি এবং তাঁর মাযারে আসি। আমার কোন সমস্যা দেখা দিলে, প্রথমে দু’রাকাত নামায পড়ি। অতঃপর তাঁর মাযারে গিয়ে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তখন সহসা আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। (ইমাম ইবনে আবেদীন শামী রাহ: রদ্দুল মুহতার, ১ম খÐ)
সুতরাং অসংখ্য দলীলের মাধ্যমে প্রমানিত হলো নিঃসন্দেহে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওযা শরীফ যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা অবশ্যই জায়েয। পাশাপাশি আল্লাহর নেক বান্দাদের রওযাতে যাওয়া শুধু জায়েয নয়, বরং প্রখ্যাত ইমামদের অনুসৃত নীতিও বটে।
আলা হযরত ইমাম আহমদ রেযা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন: প্রিয় নবীজির নূরানী রাওযার হাজিরী এবং সেখানের মাটিকে চুম্বন করার সৌভাগ্য সব মুস্তাহাব থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ এবং ওয়াজিবের প্রায় কাছাকাছি। (ফতোওয়ায়ে রযবীয়া, ৯/ ৫৩৮ পৃষ্ঠা)
‘জযবুল কুলুব ইলা দিয়ারিল মাহবুব’ নামক কিতাবে শায়খ মুহাক্কিক আল্লামা আব্দুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী বর্ণনা করেন, যখন কোন মুসলমান যিয়ারতের নিয়্যতে মদীনা মনোওয়ারায় আসে তখন ফেরেশতারা রহমতের উপহার নিয়ে তাকে স্বাগতম জানায়। (জযবুল কুলুব, ২১১ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সত্যকে কবুল করে সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুক, আমীন।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ,
সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ