রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা শিগগিরই

19

পূর্বদেশ ডেস্ক

রাষ্ট্র সংস্কার ও ক্ষমতার পরিবর্তনের রূপরেখা কী হবে, কীভাবে নির্বাচনী রূপান্তর হবে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কীভাবে হবে, বিচারের প্রক্রিয়া কী হবে, এমন নানা বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছেন রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা সবার মতামতের ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার কথা জানান।
গতকাল শনিবার বিকালে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় সভা শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম, প্রেস সচিব শফিকুল আলম এবং উপপ্রেস সচিব আজাদ মজুমদার সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে ব্রিফ করেন। খবর বিডিনিউজ ও বাংলা ট্রিবিউনের।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ছয়টি ইসলামি দল ও ইসলামি আন্দোলন, এলডিপি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২-দলীয় জোট, বাংলাদেশ জাসদ, গণফোরাম এবং জাতীয় পার্টির সঙ্গে মতবিনিময় হয়।
এতে প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন, আদিলুর রহমান খান, আসিফ মাহমুদ এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময়ের অংশ হিসেবে গতকালের বৈঠক হয়েছে বলে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, রাষ্ট্রের সংস্কার ও নির্বাচনী রূপরেখা নিয়ে অনেকের মনে সংশয়-সন্দেহ-আশঙ্কা আছে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে শুনতে চেয়েছেন তারা আসলে কী ধরনের সংস্কার চায়, ক্ষমতা পরিবর্তনের রূপরেখা কীভাবে চায়, কীভাবে তারা নির্বাচনী রূপান্তর দেখতে চান। এসব বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলেছেন।মতবিনিময় সভায় রাজনৈতিক দলগুলো অনেকগুলো সংস্কার প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন বলে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আশাবাদ শুনতে পেয়েছেন। তিনিও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে সবার সঙ্গে মিলে, সব রাজনৈতিক দল ও প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গে নিয়ে আগামীর রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা শিগগিরই উপস্থাপন করবেন।
মতবিনিময় সভায় অনেকগুলো প্রশ্ন উঠেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার কীভাবে হবে, বিচারের প্রক্রিয়া কী হবে এবং সংবিধান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সংবিধানের কী সংস্কার করবো, নাকি পুনরায় লেখা হবে, সেটা নিয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টার কাছে দেশের সংকট উপস্থাপন করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলগুলোকে আশ্বস্ত করেছেন। বলেছেন খুব দ্রæত সমস্যা সমাধান হবে। খুব দ্রæত সামলে নেবেন।
প্রধান উপদেষ্টা সবার মতামতের ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে চান। যার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করেছেন, সেটা সুদৃঢ় হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটা পরিবর্তনের জন্য একটা দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারে উদ্যোগ নিতে পারবেন। এ মিশনের অংশ হচ্ছে মতবিনিময় সভা যাতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়।
রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানো এবং একজন টানা দুই মেয়াদে সরকারপ্রধান হতে পারবেন, মতবিনিময় সভায় এমন আলোচনা হয়েছে বলে জানান প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
তিনি জানান, ইসলামি দলগুলো তাদের নামে থাকা মামলাগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের দাবি করেন। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের হত্যাকাÐ, ২০১৬ ও ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ আসেন, তখন প্রতিবাদে অনেক লোক মারা গেছেন। এ তিনটি ঘটনার নতুন করে তদন্ত দাবি করেছে ছয়টি ইসলামি দল।
রাজনৈতিক দলগুলো সংবিধান পরিবর্তন নাকি পুনর্লিখন চায়, সে বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা অনুরোধ করেছেন। জাতীয় পার্টির কয়েকজন সংবিধান সংশোধনের কথা বলেছেন। আবার আরেকজন বলেছেন, ফ্রেমওয়ার্কটা রেখে সংবিধান নতুন করে লেখা যায়। এ নিয়ে আরও বাস্তবসম্মত মতামত প্রধান উপদেষ্টা চান। গণফোরামের ক্ষেত্রেও একই বিষয়।
কোন ক্রাইটেরিয়ায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বিষয়টি উপদেষ্টা কাউন্সিল বলতে পারবেন।
বর্তমান সরকারের সময়কাল নিয়ে কোনও রাজনৈতিক দল বক্তব্য দেয়নি বলে জানিয়ে প্রেস সচিব বলেন, বেঠকে সময় নিয়ে কিছু বলেননি। সবাই বলেছেন, আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাবে। তারা আস্থা প্রকাশ করছেন। সবাই ধৈর্য ধরবেন। মনে হয় পুরো জাতি ধৈর্য ধরছেন।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আজাদ মজুমদার বলেন, সংবিধান সংশোধন নিয়ে অনেক প্রস্তাব এসেছে। একটা হলো সাংবিধানিক পরিষদ। সংবিধানে যে সংশোধনী হয়েছে, সেগুলো যদি আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়, সে ক্ষেত্রে আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত আসবে কী করে পরিবর্তন হবে। আবার রাজনৈতিক দলগুলো পরামর্শ দিয়েছে।
তিনি বলেন, কেউ কেউ গণভোটের কথা বলেছেন। আবার কেউ কেউ সংবিধান কমিশন করে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, সেটা ধরে পরবর্তী সরকার এসে অনুমোদন করবে। তবে এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও প্রস্তাব আসেনি। প্রধান উপদেষ্টা সবাইকে লিখিত মতামত দিতে বলেছেন। সেগুলো স্টাডি করে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন অথবা পরিবর্তন-পরিমার্জন যেটার প্রয়োজন হয়, সেটার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
অপরাধীর মানবাধিকার যাতে লঙ্ঘন না হয়, সেই বিষয়েও মতবিনিময় সভায় আলোচনা হয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
ছয়টি ইসলামী দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই আলোচনা। প্রথমে চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করীমের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গে আলোচনা করে উপদেষ্টা পরিষদ।
পরে একে একে যায় জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি, অলি আহমদের নেতৃত্বে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরাম, শরীফ নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাসদ, ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে ১২ দলীয় জোট।
দলগুলো তাদের দলীয় প্যাডে নির্বাচন, রাষ্ট্রীয় সংস্কারসহ বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন।
বৈঠকে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান ও ধর্ম বিষয়ক উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন।
যৌক্তিক সময় : সংবিধানে সংসদ ভেঙে দেওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা আছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন করবে, সে বিষয়ে কোনো ধারণা দিচ্ছে না।
গত ২৪ আগস্ট থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি উঠছে, তবে জামায়াত মনে করে নির্বাচনের সময় ‘এখন নয়’। এ নিয়ে দুই দলের বাদানুবাদের ঘটনাও ঘটেছে।
এলডিপির চেয়ারম্যান অলি আহমেদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে ব্যস্ত রাখার জন্য একমাত্র অস্ত্র হল একটা ফোরকাস্ট দিয়ে দেওয়া। এটা ছয় মাস পরেও হতে পারে, নয় মাস পরেও হতে পারে। সংস্কার করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নির্বাচন দেওয়ার কথা আমরা বলেছি। কিন্তু নির্বাচন তো হতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্যও ভালো, রাজনৈতিক দলের জন্যও ভালো, দেশের জন্যও ভালো। সংস্কার করার আগে নির্বাচন কোনো অবস্থাতে বাঞ্ছনীয় নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ছয় ইসলামী দলের সঙ্গে প্রথম মতবিনিময় শেষে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ও হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হক বলেন, আমরা উনাকে (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছি যে, তিনি একটি যৌক্তিক সময় নিয়ে সংস্কারগুলো করে অযথা যেন কাল বিলম্ব না করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন।
মাননীয় প্রধান উপদেষ্টাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন যে, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর তারা কালবিলম্ব না করে নির্বাচনে যেতেই তারা আগ্রহী এবং সেই ধরনের তারা প্রস্তুতি এবং আয়োজন করছেন।
ইসলামী আন্দোলনের আমির চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ রেজাউল করিম বলেন, বিগত ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকার প্রায় ১৬ বছর ধরে দলীয়করণ এবং ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এর যে ‘প্রহসনমূলক’ জাতীয় নির্বাচন এবং এই নির্বাচনগুলো উঠিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যারা প্রশাসনে দায়িত্ব পালন করেছেন, যারা বিভিন্ন মিডিয়াসহ সর্বত্র ওই সরকারকে সহযোগিতা করেছে, সেটা অন্যায়।
একটা নির্ভরযোগ্য একটা কমিশন গঠনের মাধ্যমে এই অন্যায়কারীদের চিহ্নিত করে তাদের ব্যবস্থা করার বিষয়টি আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলছি।
‘যোগ্যদের’ দিয়ে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দেওয়ার কথাও বলে ইসলামী আন্দোলন।
সংলাপ শেষে বের হয়ে এসে গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, অনেক সুন্দর আলোচনা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। আমরা লিখিত প্রস্তাব দিয়েছি। আলোচনা ভালো হয়েছে। গণফোরামের পক্ষ থেকে ২১ দফা দাবি দেওয়ার কথা জানান তিনি।
আলোচনায় ৮৩ দফা প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানান এলডিপি প্রধান। ‘গণহত্যার’ অভিযোগ এনে আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, জামায়াতকে যদি ‘ছোট ছোট তুচ্ছ কারণের’ নিবন্ধন বাতিল করা যায়, আমাদের হাজার ছেলে-মেয়েদের হত্যা করার জন্য, ১৫ বছর কয়েক হাজার নেতা-কর্মীকে গুম করার জন্য তাদের (আওয়ামী লীগ) বাতিল হবে না? এটা বাতিল করা অত্যন্ত প্রয়োজন। না হলে আগামীতে স্বৈরাচারের জন্ম বাংলাদেশে হবে।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমাদ আবদুল কাদের বলেন, ভারতের সঙ্গে শেখ হাসিনা যেসব চুক্তি করেছেন সেগুলো পুনর্মূল্যায়ন করে যেগুলো ‘দেশবিরোধী’, সেগুলো বাতিল করার কথা আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।
মামুনুল হক বলেন, সংবিধানে আল্লাহর ওপরে অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসের যে ধারাটি ছিল সেটা আবার যেন পুনর্বহাল করা হয়। সংবিধানে এজন্য সংশোধনী আনার প্রস্তাব করেছি। দেশে নীতিমালা ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইসলামবিরোধী নীতি বা আইন যেন না হয় সে বিষয়ে আমরা দাবি জানিয়েছি প্রধান উপদেষ্টার কাছে।
আহমাদ আবদুল কাদের বলেন, আলেম সমাজ, হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীসহ বিরোধী দলগুলোর যে মামলা শেখ হাসিনার সরকার দিয়েছে সেগুলো আগামী এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের একটা টাইমফ্রেমের কথা আমরা বলেছি।
মামুনুল হক বলেন, হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালের বহু মামলা ও হতাহত রয়েছে। অনেকের সন্ধানও আমাদের কাছে নেই। আমরা সেই ব্যাপারেও সহযোগিতা চেয়েছি যেন আমাদের সকল শহীদ ও নিখোঁজ মানুষের বিষয়ে সুন্দর একটি প্রতিবেদন আমাদের কাছে আসতে পারে।
সকল হত্যাকান্ডের বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার প্রস্তাবও আমরা বলেছি।