রাষ্ট্রীয় সম্মানে হায়দার আকবর রনোকে চিরবিদায়

3

পূর্বদেশ ডেস্ক

নানা মতের রাজনীতিবিদদের শ্রদ্ধার ফুল আর রাষ্ট্রীয় সম্মানে সিক্ত হয়ে চিরবিদায় নিলেন মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হায়দার আকবর খান রনো। গতকাল সোমবার দুপুরে ঢাকা জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম হেদায়েতুল ইসলামের নেতৃত্বে পুলিশের একটি চৌকশ দল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রয়াত এই কমিউনিস্ট নেতাকে গার্ড অব অনার দেয়। এসময় বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবির আয়োজনে এ অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জেএসডি, জাসদ, বাসদ, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর),গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশ জাসদের নেতারা এসেছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে।
এছাড়া বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফোরাম, গণসংহতি আন্দোলন, ঐক্য ন্যাপ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টিসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ এবং পেশাজীবী নেতারাও আসেন প্রয়াত এই রাজনীতিবিদকে শেষবারের মত বিদায় জানাতে। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। খবর বিডিনিউজের
শহীদ মিনারে আসা সবার মুখে মুখে ফেরে মেহনতি মানুষের পক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হায়দার আকবর খান রনোর অংশগ্রহণ ও অবদানের কথা। তাদের ভাষ্য, এমন আপসহীন রাজনীতিবিদের মৃত্যু দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন এবং জাতির জন্য বিরাট ক্ষতি।
বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রভাগের নেতা হায়দার আকবর খান রনো ছিলেন সিপিবির উপদেষ্টা। গত শুক্রবার রাতে ঢাকার পান্থপথের হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।
গত শনি ও রবিবার তার মরদেহ রাখা হয়েছিল হাসপাতালের হিমঘরে। গতকাল সোমবার সকালে কফিন নিয়ে যাওয়া হয় পুরানা পল্টনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ‘মুক্তিভবনে’। সেখানে পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা তাদের দীর্ঘদিনের ‘কমরেড’কে শেষ বিদায় জানান।
সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে নেতা-কর্মীরা শোক মিছিল করে প্রয়াত নেতার কফিন নিয়ে যান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেখানে শুরুতে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানো হয়। তারপর কফিন নির্ধারিত মঞ্চে এনে দলীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাহজাহান খান, মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিল, আফজাল হোসেনে, মৃণাল কান্তি দাস কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী, আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, জহির উদ্দিন স্বপন, মুস্তাফিজুর রহমান বাবুলসহ আরও অনেকে শ্রদ্ধা জানান।
পরিবারের সদস্যরা জানান, শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা শেষে রনোর মরদেহ নেওয়া হয় বনানী কবরস্থানে। সেখানে মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আফসোস করে বলেন, ‘হায়দার আকবর খান রনোর মৃত্যুতে জাতির বড় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি আগাগোড়া বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কোনোদিন আপস করেননি, কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি মার্কসবাদী-লেলিনবাদী ছিলেন। ওই আদর্শের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন’।
বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘কমরেড হায়দার আকবর খান রনোর নাম ইতিহাসে অক্ষয় হয়ে থাকবে। প্রতিটি সংগ্রামে তিনি আপসহীন লড়াই করেছেন। তিনি দেশ, জাতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য, জনগণের ভবিষ্যত রচনার জন্য চেষ্টা করেছেন। তিনি আমাদের আদর্শের প্রতীক হয়ে থাকবেন’।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘বাংলাদেশ ও উপমহাদেশের মধ্যে যারা সমাজতন্ত্রের রাজনীতি করেন, তাদের মধ্যে উনি একজন ব্যতিক্রমধর্মী নেতা ছিলেন। তিনি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, স্বৈরাচার বিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। আমি মনে করি অনেক বামপন্থি বিভ্রান্তিতে ভুগলেও, হায়দার আকবর খান রনো কখনোই বিভ্রান্তিতে ভুগেননি।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে, জনগণের মুক্তি সংগ্রামে, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হায়দার আকবর খান রনো একটি অনন্য নাম। ছাত্রজীবন থেকে তিনি এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতি করেছেন। মাক্সবাদী আদর্শে দীক্ষিত এই মানুষটি তার সারাটা জীবন আদর্শের প্রতি অবিচল থেকে মানুষের মুক্তির জন্য, কৃষক-শ্রমিক-মহনতি মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন’।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, হায়দার আকবর খান রনো কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তিনি ‘জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন’ ছিলেন। রমুক্তিযুদ্ধে রনোর ভ‚মিকা তুলে ধরে হানিফ বলেন, ‘এদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। তার মত ত্যাগী নেতা জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন’।