রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর চরম বর্বরতা

6

বিপ্লব বড়ুয়া

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কৌশলে নাশকতার কাজ লাগিয়ে একশ্রেণির দুর্বৃত্ত যেভাবে ঢাকাসহ দেশজুড়ে তান্ডবলীলা চালিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য রোমহর্ষক। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর এমন বর্বরতা বাংলাদেশের মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে প্রত্যক্ষ করেছে। যে বর্বরতা কোনভাবে মেনে নেয়া যায় না। কোটি কোটি টাকার ব্যয়ে উন্নত বিশ্বের আদলে গড়া মেট্রো রেলস্টেশনও বাদ যায়নি দুস্কৃতিকারীদের হাত থেকে। উদ্বোধনের কয়েকমাসের মাথায় মেট্রোরেলের অত্যাধুনিক ২ টি স্টেশন লুটেপুটে নিয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। এছাড়া বিভৎসতা দেখেছি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মাদারীপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ দেশের সর্বত্র।
বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে তারা ১৮ জুলাই দেশব্যাপী “কমপ্লিট শাটডাউন” এর ডাক দেন। এ ঘোষণায় পুরো দেশ একরকম অচল হয়ে যায়। ছাত্রদের এ আন্দোলনকে পুঁজি করে নাশকতাকারীরা ঐ একদিনেই দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আগুনে পুড়ে ধ্বংস করে দেয়। এরকম জগন্য, নির্মম বর্বরতা দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ১৮ ও ১৯ জুলাই দুর্বৃরা ছাত্রদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাষ্ট্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মহাখালির সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, ডাটা সেন্টার, গ্রীন রোডের রপ্তানি ভবন (বেপজা), মিরপুরে বিআরটিএ ভবন, ২টি মেট্রোরেল স্টেশন, গাজীপুরের সড়ক ভবন, বিআরটি স্টেশন, মহাখালির এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, যাত্রাবাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, নরসিংদী জেলা কারাগার ভেঙ্গে ফেলায় আট শতাধিক বন্দি পালিয়ে যাওয়ার পর লুটপাট, মাদারীপুরে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়সহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে। আগুন দিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর পুলিশের গাড়ি, পুলিশ বক্সসহ অসংখ্য যানবাহনে। মহাখালির সেতু ও সড়ক ভবনে ৫৫ টি গাড়ি, মহাখালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরোনো ভবনের পার্কিংয়ে রাখা ৩২ টি গাড়ি, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৪৬ টি বর্জ্যবহণকারী গাড়ি, মাদারীপুরে একটি কোম্পানীর ৩২ টি বিলাসবহুল বাসসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই শতাধিক দামি গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে নাশকতাকারী দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে স্টেশন দুটিতে এমনভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে পুরোদমে চালু করতে অন্তত একবছর সময় লাগবে। এসব সরকারি সম্পদগুলোকে এমনভাবে ধ্বংযজ্ঞে পরিণত করেছে মনুষ্যত্বজ্ঞান সম্পন্ন কারো পক্ষে এ কাজ সম্ভব নয়। ছাত্রদের আন্দোলনকে খুব সু² কৌশলে ব্যবহার করেছে দুস্কৃতিকারীরা। সরকার এই নাশকতার জন্য বিএনপি-জামাত জোটকে দায়ী করেছে।
ছাত্রদের আন্দোলনটি ছিল সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক যে কথাটি তারা বার বার বলে আসছিল। প্রায় ১৭/১৮ দিন একটানা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে অশান্তিতে পরিণত করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করেছে একশ্রেণির রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই মুলত এরা দেশব্যাপী নাশকতা পরিচালনা করে। যে বা যারা এ ধরনের প্রতিহিংসামুলক কর্ম করেছে তারা যে একটি টার্গেট নিয়ে এগিয়েছে তাদের কর্মযজ্ঞে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুস্কৃতিকারীরা একাধিকবার অকটেন, পেট্রোল ও গান পাউডার ব্যবহার করে গাড়িতে আগুন লাগানোর কথা সেতু ভবন ও সিটি কর্পোরেশনের কর্মচারীরা গণমাধ্যম কর্মিদেরকে অবহিত করেছেন। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে থেকে নবীন ছাত্রদের কোটা সংস্কার যৌক্তিক আন্দোলনে দেশের মানুষ সর্বাত্মক সাড়া দেয়। যারা এই আন্দোলনকে পরিচালনা করেছে তাদের বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ তাদের প্রত্যেকটি দিকনির্দেশনা ছিল সময়োপযোগী। তাদের এই নেতৃত্ব একজনের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ইতিমধ্যে আমরা কয়েকজনের নাম জেনেছি তাঁরা হলেন, সমন্বয়ক সারজিস আলম, আহসনাত আবদুল্লাহ, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম। ইলেক্ট্রিক ও প্রিন্ট গণমাধ্যমে তাদের বিবৃতি প্রকাশিত ও প্রচারিত কথামালা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকে মেধাবী, তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন এবং পরিপক্ব। আন্দোলন পরিচালনকালীন তাদের প্রত্যেকের কথামালায় একে অন্যের মধ্যে বেশ সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা গেছে। সে কারণে রাজনীতিকরা তাদের আন্দোলন নিয়ে বিদ্রুপাত্মক মন্তব্য করার পরও কোনো অবস্থাতে টলে যায়নি। উপরন্তু, ছাত্ররা খারাপ মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিল। যেটি, বাংলাদেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও ইতিপূর্বে দেখা যায়নি। আমি মনে করি ছাত্ররা তাদের নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে একটি সুন্দর মার্জিত ধারা প্রচলন করার ফলে সে ধারাটি খুব দ্রুত সকলস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের তরুণ সমাজ যদি প্রতিটি অনিয়মের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের মাধ্যমে সরব হয় তাহলে এদের মধ্যে দিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত হতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। তাঁরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ধারণাটিকে স্টাব্লিসমেন্ট করতে পেরেছে। যেটি এর আগে দেখা যায়নি। কিন্তু ১৭ জুলাই এর পর তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যায়। তাদের অহিংস আন্দোলনে যখন সুযোগ সন্ধানীদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে সহিংসতা ও সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ মারা গেছে। সম্পদে ধ্বংস হচ্ছে, তখন রাজনৈতিক কর্মসূচি স্থগিত করা উচিত ছিল। মনে রাখতে হবে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থিরা মেধাও সৃষ্টিশীলতায় অনেক বেশি এগিয়ে। তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম প্রতিনিয়ত এখন বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে তরুণ প্রজন্ম এখন ঘরে বসে অর্থউপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে যেটি বড়দের বেলায় কখনো সম্ভব পর নয়। তাঁরা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। ফ্রি-ল্যান্সার, ই-কর্মাসে দিনরাত প্রতিনিয়ত বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে তাঁরা শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তা শুধু নয় এই জাতিয় চ্যালেঞ্জগুলো তাদের হৃদয়ে সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাস স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। যে স্বপ্ন মানুষকে নিয়ে যায় বহুদূর। তাই এখন বড় ছোট বলে কাউকে অবজ্ঞা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই।
অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান হচ্ছে সমুদ্রসম। যাঁদের মধ্যে এই দুটি বিদ্যমান তাঁরা সহজে পরাস্ত হয় না। অর্থের ব্যাপারটা হচ্ছে সাময়িক। অর্থ সারাজীবন টিকে থাকেনা অপরদিকে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা কখনো ম্লান হয় না। যে যতবেশি অজ্ঞিতাসম্পন্ন সে ততবেশি সমৃদ্ধ। আজকে তরুণ শিক্ষার্থিরা তাঁদের সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে যে সুস্থধারার প্রচলন করেছে তা রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয় ব্যাপার। তরুণ প্রজন্মের নতুন নতুন চিন্তার সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নবতর কর্মসূচী প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার কর্মসূচি নিতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে যে বা যারা দেশের সম্পদ লুটপাটের উৎসবে মেতেছিল তারা আর যাই হোক দেশের মঙ্গলকামী নয়। যারা এই নৈরাজ্য চালিয়েছে তারা একশ্রেণির উগ্রবাদী ধর্মান্ধগোষ্ঠি। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরোবেশি কৌশলী হতে হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক