রাতারাতি বনে গেলেন বিএনপি নেতা!

15

নিজস্ব প্রতিবেদক

বোয়ালখালী উপজেলার শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ নেতা মো. লোকমান রাতারাতি বনে গেছেন বিএনপি নেতা। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে স্থানীয় কাউন্সিলর ও স্থানীয় সাংসদকে ব্যবহার করে অবৈধভাবে শত কোটি টাকার মালিক হলেও এখন সরকারের সাথে সাথে নিজের রূপও পাল্টান তিনি। এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। অভিযুক্ত লোকমান মীর পাড়া এলাকার মৃত রহমত আলীর সন্তান। গত কয়েকদিন ওই এলাকার স্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
স্থানীয়রা জানান, চলতি আগস্ট মাসের ৫ তারিখও লোকমান স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাছের আলীকে ব্যবহার করে এলাকায় নৈরাজ্য চালিয়েছেন। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললে ধমকিসহ প্রাণনাশের হুমকি প্রদান করতো তার সহচররা। এমনকি অনেককে মারধরের ঘটনা পর্যন্ত আছে। কিন্তু ৫ আগস্ট বিকেলে সরকার পরিবর্তনের খবর পেয়ে, তিনি নিজে বিএনপির রাজনীতিতে যোগদান করেন। বিএনপির একাধিক নেতার সাথে ইদানিং তার সখ্যতা দেখা গেছে। একই সাথে এলাকায় নিজেকে এখন বিএনপি নেতা পরিচয় দিচ্ছেন। তবে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পূর্বে লোকমান নিজেকে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন বলে দাবি করেন। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমি কোনো সময় আওয়ামী লীগের রাজনীতি করিনি, আমার বিরুদ্ধে শত্রু লেগেছে। তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। আপনি এখানে আসুন, আপনার সাথে সরাসরি কথা বলতে চাই।’
এলাকাবাসীর মতে, লোকমানের রাজনীতি নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য। তিনি বেট৩৬৫ ওয়েবসাইটে জুয়া পরিচালনা, অবৈধভাবে সাধারণ মানুষের জায়গা দখল করে অন্যকে পাইয়ে দেয়া, ঘুষ বাণিজ্য, লুটপাট সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। লোকমানের টাকা খরচ করে পৌরসভার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হন মোহাম্মদ নাছের আলী। এছাড়া পূর্ব গোমদন্ডীর মো. ওয়াহেদ, নাজিম উদ্দিন ও বেলাল উদ্দিনের মাধ্যমে তার অবৈধ বাণিজ্যের কাজগুলো করে থাকেন।
এলাকাবাসীর মধ্যে কয়েকজন জানান, বোয়ালখালীর পূর্ব গোমদন্ডী এলাকাবাসী তার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ২০১৯ সালের ১০ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরে লোকমানের অপকর্মের বিষয়গুলো তুলে ধরে একটি অভিযোগ প্রদান করেন। কিন্তু অভিযোগের বিষয়টিও মোটা অংকের বিনিময়ে সেখানে ধামাচাপা দেয়া হয়। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়- ‘বিগত ৫/৬ বছর ধরে জুয়া, দুর্নীতি, জবর দখল, ও নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার এবং রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনে যাওয়া জোট সরকারের আমলে ছাত্রদল নেতা নিজ স্বার্থকে চরিতার্থ করার লক্ষ্যে আওয়ামী তকমা গায়ে লাগিয়ে যুবলীগ নেতা হন মো. লোকমান।’
একই অভিযোগে বলা হয়- ‘ফোনে বেট ৩৬৫ একাউন্ট এবং ইউএস ডলারের মোটা অর্থ পাওয়া যাবে, অর্ধ শতাধিক ল্যাপটপে ৩০০ এর বেশি জুয়ার একাউন্ট রয়েছে, নগদ টাকা এবং স্বর্ণ বাড়িতে পাওয়া যাবে, ব্যাংক এফডিআর এ লোকমান এবং তার সহচরদের ২০ কোটি টাকা জমা রয়েছে, জায়গা-জমি, নতুন ভবন নির্মাণসহ ব্যবসা বিনিয়োগ রয়েছে শত কোটি টাকার উপর। অর্ধ কোটি টাকা দামের একটা কার রয়েছে যার নম্বর- চট্ট মেট্রো চ ১২-৭৪৫০। এমনকি যে কোন সময় তার দেশ থেকে পালানো সম্ভাবনা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়ে। এসবের পাশাপাশি লোকমানের রয়েছে হুন্ডি ব্যবসাও।’
পূর্ব গোমদন্ডী মীর পাড়া এলাকার ভূক্তভোগী মো. ওমর ফারুক রুবেল পূর্বদেশকে বলেন, লোকমান ৫ আগস্টের আগে কাউন্সিলর নাছের ও এমপি’র সাথে সখ্যতা গড়ে নানা রাজনৈতিক কাজে যোগ দিতেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নিজেকে এলাকায় বিএনপি নেতা দাবি করছেন। তবে তিনি নিজে কোনো মানুষের সাথে দ্বন্দ্বে জড়াননি। তার সাথে আমাদের ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ তৈরি হয়নি। লোকমান প্রতিটি কাজে কাউন্সিলর নাছেরসহ অন্যান্যদের ব্যবহার করতেন। নাছের ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে আমার চার তলা ভবন (২৭টি ফ্ল্যাট) দখল করে ভাড়া উত্তোলন করে নিজে ভোগ করতেন। সে বিষয়ে আমি তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলাও করেছি। সেনাবাহিনীর সহায়তায় কয়েকদিন আগে আমি আমার বাড়ি ফিরে পেয়েছি। এর আগে গত ৫ বছর ধরে মাসে ৮০ হাজার টাকা করে ভোগ করতেন তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক ভূক্তভোগী বলেন, এলাকার কেউ তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতো না। পুরো এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে এসেছিল। কিন্তু তিনি আবার বিএনপি’তে যোগদান করলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, কাউন্সিলর নাছেরের প্রতিবেশীর ঘর ডাকাতি ও লুটপাটেও কাউন্সিলর নাছের, লোকমান, নুরুল আমিন, আবছার, আলী ফকির, ইসমাইল হোসেন বাচা, সেলিমসহ কয়েকজন জড়িত ছিলেন। এসব লোকদের কারণে ওই এলাকায় কেউ কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারেনি। কেউ কিছু করলেই তাদেরকে চাঁদা দিতে হতো।
ভূক্তভোগী শাহানাজ সিদ্দিকা বলেন, গত রমজানের একদিন আগে কাউন্সিলর নাছেরসহ আমাদের পুকুর থেকে মাছ চুরি করে তারা। আমরা প্রতিবাদ করলেই উল্টো আমরা চাঁদা চাইছি বলে আমাকে ও আমার ছেলেকে মারধর করে। এলাকার গাছপালা জোর করে কেটে ফেলে বিক্রি করে দেয়া, টাকা আদায় ইত্যাদি হয়রানি করতো।
চেমন আরা বেগম মুন্নি বলেন, কাউন্সিলর নাছেরকে চলাচল করার জন্য রাস্তা দিয়েছি আমরা। কিন্তু আমাদের রাস্তায় দেওয়াল তুলে আমাদের চলাচলে বাধা দেয় নাছের ও তার সহচর মুন্না, ওয়াহেদ, শামছুল, ওসমান। আমরা থানায় মামলা করতে না পেরে কোর্টে মামলা করি। লোকমানসহ তারা আমাদের উপর অনেক অত্যাচার চালায়।
এসব বিষয়ে ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাছের আলীকে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি তো নাছের নই। আমার নাম শাহাদাত। আপনি ভুল নম্বরে যোগাযোগ করেছেন।
অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা মো. লোকমান পূর্বদেশকে বলেন, আমি সাংসদ, কাউন্সিলরসহ সকলের সাথে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যোগাযোগ রাখতাম। ছবিও তুলেছি অনেক। তবে তাদের কোনো রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। এখন অনেকে অনেক কিছু বলতে পারে, সেখানে আমার তো কিছু করার নেই। এখন আমার বাসার জমিদার শওকত ভাই। উনার রাজনীতি আগেও করতাম, এখনও করি। আমাদের কাউন্সিলর নাছের যদি অপকর্ম করে, তবে সে তার শাস্তি পাবে। তবে বাকি সব আমার সাথে দুশমনি করা হচ্ছে বলে মনে করি।