রাজীব গান্ধী

9

রাজীব রত্ন গান্ধী, ভারতের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। তিনি ইন্দিরা নেহেরু ও ফিরোজ গান্ধীর জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর মায়ের মৃত্যুর দিন মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি দেশের কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালের ২ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে পরাজয়ের পর পদত্যাগ করার আগে পর্যন্ত তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনীতিতে পদার্পণের পূর্বে রাজীব ছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের এক পেশাদার বিমানচালক। কেমব্রিজে থাকাকালীন ইতালীয় বংশোদ্ভুত সোনিয়া মাইনোর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় এবং পরে ১৯৬৮ সালে তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। মা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্তে¡ও, ১৯৮০ সালে কনিষ্ঠ ভ্রাতা সঞ্জয় গান্ধীর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত রাজীব রাজনীতি থেকে দূরেই ছিলেন। ১৯৮৪ সালে অপারেশন ব্লু স্টারের প্রতিক্রিয়ায় আততায়ীর হাতে ইন্দিরা গান্ধী নিহত হলে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ রাজীবকেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে।
১৯৮৪ সালে তার নেতৃত্বে কংগ্রেস সংসদের ৫৪২টি আসনের ৪১১টিতে জয়লাভ করে। এই জয় ছিল ভারতীয় সংসদে কংগ্রেসের সর্বকালের রেকর্ড। রাজীব গান্ধী লাইসেন্স প্রথা, শুল্ক ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের জন্য অনুমতি প্রদানের নিয়মনীতি ঢেলে সাজান; টেলিযোগাযোগ ও শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ তথা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতিসাধন প্রভৃতি নানা কাজ শুরু করেন।
১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাজীব গান্ধী ছিলেন ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি। এই বছরই একটি নির্বাচনী জনসভায় জনৈক এলটিটিই জঙ্গির আক্রমণে নিহত হন তিনি। ১৯৯৮ সালে তাঁর স্ত্রী সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভানেত্রী নির্বাচিত হন এবং ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস লোকসভায় জয়লাভ করে। তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধী সংসদ তথা সর্বভারতীয় কংগ্রেস কমিটির সাধারণ সম্পাদক।
মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা (ভারতরতœ/ভারতরতেœ) ভূষিত করা হয়। উল্লেখ্য, তার মা ইন্দিরা গান্ধীও ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। রাজীব গান্ধী ভিইউ২আরজি নাম ব্যবহারকারী একজন অপেশাদার রেডিও সঞ্চালক ছিলেন।
৩১শে অক্টোবর ১৯৮৪, যেদিন ইন্দিরা গান্ধী তার দেহরক্ষীদের দ্বারাই নিহত হন সেদিন গান্ধী পশ্চিম বঙ্গে ছিলেন। তার মায়ের দুই শিখ দেহরক্ষী দ্বারা হত্যা-কান্ডের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই উচ্চ পর্যায়ের কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ এমনকি রাষ্ট্রপতি জৈল সিং ও তাকে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য চাপ দিতে থাকেন। দেশের রাজধানী দিল্লিতে শিখ-বিরোধী দাঙ্গার পরিপ্রেক্ষিতে রাজীব গান্ধীর, ‘যখন একটি বিশালাকৃতি বৃক্ষের পতন হয় তখন তার তলায় ভূমিকম্প সৃষ্টি হয়’ এই মন্তব্যটির জন্য ব্যাপক ভাবে সমালোচিত হতে হয়েছিল। বহু কংগ্রেস রাজনীতিককে এই দাঙ্গা পরিকল্পনার/পরিচালনার জন্য দায়ী করা হয়েছিল। যেহেতু তৎকালীন লোক সভা তার পাঁচ বছর কার্যকাল সম্পূর্ণ করেছিলো সেহেতু রাজীব কার্যভার গ্রহণের অব্যবহতি পরেই রাষ্ট্রপতি জৈল সিংকে লোক সভা ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচন করতে অনুরোধ জানান। রাজীব গান্ধী আনুষ্ঠানিক ভাবে কংগ্রেস পার্টির সভাপতি ও মনোনীত হলেন।
ভারত বর্ষের সংসদের ইতিহাসে সর্বকালীন সর্ববৃহদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কংগ্রেস পার্টি এক অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে সরকারের ওপর গান্ধীর একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। তারুণ্য, নিষ্কলুষ (মি. ক্লিন) ভাবমূর্তি ও ‘দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিক’ এই প্রেক্ষাপট-বিহীনতা তার সহায়ক হয়েছিল। রাজীব তাই কংগ্রেসের অনুক‚লে ভারতের জনসাধারণের আশা ও উদ্দীপনাকে পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছিলেন।
গান্ধী তার মায়ের, সমাজবাদী, পথের বিশিষ্ট ভাবে ভিন্ন পথে নেতৃত্ব প্রদান আরম্ভ করেছিলেন। তিনি, ভারতের সমাজতান্ত্রিক নীতি ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্যপুর্ণ সম্পর্কের কারণে দীর্ঘ সংকটাদীর্ণ ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি এবং অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার প্রসার সাধন করেন। তিনি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা এবং সমগোত্রীয় শিল্পে সরকারী সহায়তা বৃদ্ধি, বৈদেশিক আমদানির পরিমাণ হ্রাস, প্রযুক্তি-নির্ভর শিল্প, বিশেষত কম্পিউটার, এয়ারলাইনস, সামরিক ও টেলিযোগাযোগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে কর ও শুল্ক হ্রাস কম্পিউটার করেন.তিনি, ব্যবসায়ীদের মূলধন সংগ্রহ, ব্যক্তি বিশেষের ভোগ্য পণ্য ক্রয় এবং আমদানির ওপর আমলাতান্ত্রিক বিধি-নিষেধ সৃষ্টিকারী লাইসেন্স রাজ এর হ্রাসের জন্য কিছ গুরুত্বপূর্ণ পন্থার প্রচলন করেছিলেন। সারা ভারত ব্যাপী উচ্চ শিক্ষা প্রসারের উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৮৬ সালে জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করেছিলেন। তিনি ১৯৮৬ সালে জওহর নবোদয় বিদ্যালয় সিস্টেম-এই নামে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন একটি প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন যার প্রধান লক্ষ ছিল ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেনী পর্যন্ত অবৈতনিক-গৃহশিক্ষা সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে সমাজের গ্রামীণ ক্ষেত্রে মানুষের উন্নয়ন। তারই প্রচেষ্টায় ১৯৮৬ সালে গঞঘখ -এর সৃষ্টি হয় এবং পাবলিক কল অফিস যা চঈঙ এই নামেই খ্যাত গ্রামীণ এলাকাগুলিতে টেলিফোনের বিস্তার ঘটাতে সহায়তা করেছে।
তার অনুমোদনেই জঙ্গি কার্যকলাপের রাশ টানতে পঞ্জাবে এক বিস্তীর্ণ পুলিশী ও সামরিক অভিযান চালানো হয়। পাঞ্জাব রাজ্যে এক সামরিক আইন জারির মতো অবস্থা চলছিলো যার ফলে অসামরিক মুক্ত জীবনযাপন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও পর্যটন শিল্প বিশেষ ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছিলো। সেই সময় এখানে পুলিশ অধিকর্তা ও জঙ্গি উভয়ের দ্বারাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। এরকম অভিযোগ ও করা হয় যে, যখন পঞ্জাবের পরিস্থিতি আয়ত্তের মধ্যে তখন ভারত সরকার শ্রীলঙ্কা সরকারের সঙ্গে যুদ্ধরত খঞঞঊ বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করেছে। ১৯৮৭ সালের ২৯শে জুলাই কলম্বোতে রাজীব গান্ধী ও শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রপতি জে আর জয়ার্ধনের মধ্যে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা পীস একর্ড স্বাক্ষরিত হয়। তার পর দিনই, ৩০শে জুলাই ১৯৮৭ সালে রাজীব গান্ধী যখন গার্ড অফ অনার নিচ্ছিলেন তখন ভিজয়ামুনিগে রোহন দি সিলভা নামে একজন নবীন সিহ্নলী নৌ-সেনা সদস্য রাইফেলের কুদো দিয়ে তার মাথায় আঘাত করে। আঘাতটি রাজীব গান্ধীর মাথার পিছনে করার উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকলেও তা তার কাঁধে লাগে। ‘রাজীব একটু লাফিয়ে উঠেছিলেন এবং তাঁর সামান্য ভারসাম্য হারিয়ে ছিল’ এই বলে লজ্জিত শ্রীলঙ্কা রাষ্ট্রপতি, জুনিয়াস রিচার্ড জয়েবার্দেনে প্রথমিক ভাবে এই অদ্ভুত ঘটনাটিকে পাস কাটাতে চয়েছিলেন, রাজীব গান্ধী নতুন দিল্লিতে ফেরার পথে জে এন দীক্ষিত কে বলেছিলে ‘নিশ্চিত রূপে আমার আঘাত লেগেছিলো’। নৌ-সেনা সদস্য রোহন সেই সময় ভারতের সাম্রাজ্যবাদিতার বিরুদ্ধে সিন্ঘলীদের কাছে জাতীয়তাবাদের এক প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলো। শ্রীলঙ্কা সরকার ও খঞঞঊ বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারীর প্রচেষ্টাটি যখন প্রত্যাঘাত করে তখন রাজীব গান্ধীর সরকারও এই কাজের জন্য বড়ো একটি ধাক্কা খায়। ভারত ও মার্কিন কংগ্রেসের যুগ্ম-সভায় তার বক্তৃতা সকলকে বিমুগ্ধ করেছিল, যখন তিনি বলেন, ‘ভারত বর্ষ একটি প্রবীন দেশ কিন্তু নবীন জাতি এবং সর্বস্থানের নবীনদের মতই আমরাও অধৈর্য্য। আমি নিজেও নবীন এবং আমার নিজেরও স্বপ্ন আছে। আমি, সম্মুখ সারির সম্মুখে প্রতিষ্ঠিত, মানুষের সেবায় নিযুক্ত, মহান দেশগুলির মধ্যে এক স্বাধীন, শক্তিশালি, স্বনির্ভর ভারত বর্ষের স্বপ্ন দেখি’।
১৯৯১ সালের ২১শে মে রাজীব গান্ধী তামিল নাডুর, মাদ্রাজ থেকে ৩০ মাইল দুরে শ্রীপেরুম্বুদুরে যখন শ্রীপেরুম্বুদুর লোক সভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে প্রচার-অভিযান সভায় তখন গুপ্ত ঘাতক দ্বারা তাকে হত্যা করা হয়। এই গুপ্ত হত্যাকান্ডটি সংঘটিত করেছিলো লিবারেশন টাইগার্স অফ তামিল ইলম (খঞঞঊ) আত্মঘাতী মানববোমা থেনমঝি রাজারতœম, একে গায়েত্রী এবং ধানু বলেও জানা যায়। সূত্র : উইকিপিডিয়া