রাঙ্গুনিয়ায় পাহাড়ের খাদে ৩০ হাজার পরিবার

5

মাসুদ নাসির, রাঙ্গুনিয়া

বৃষ্টি ঝড়ো হাওয়া ও পাহাড় ধসের মতো জীবনের ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের নিচে পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করে। ভারী বৃষ্টিপাত হলে ওরা ঘর ছেড়ে আত্নীয় স্বজনের বাসায় আশ্রয় নেয়। বৃষ্টি চলে গেলে আবার চলে আসে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসস্থলে। রাঙ্গুনিয়ায় গত কয়েক দিন ভারী টানা বৃষ্টিপাত হচ্ছে। কয়েকদিন ধরে পাহাড়ের নিচে ঝুঁকি নিয়ে কমপক্ষে ৩০ হাজার পরিবার পাহাড় ধসের ঝুঁকির মাঝে বসবাস করছে বছরের পর বছর।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৩ জুন রাঙ্গুনিয়ায় রাজানগর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে ভয়াবহ পাহাড় ধসে ২২জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর এক বছর পর ২০১৮ সালে মোহাম্মদপুর ওই ওয়ার্ডেই পাহাড় ধসে তিনজন মানুষ মারা যায়। প্রতি বছর প্রবল বৃষ্টিপাত শুরু হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়। বাসিন্দাদের অন্যত্র স্থায়ীভাবে সরিয়ে নিতে কিংবা পাহাড় কাটা বন্ধে দুয়েকটি অভিযান চালানো হলেও কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। বিষয়টি উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন সচেতন মহল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৫টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায় ৯ হাজার একর সরকারি ও ১৫ হাজার একর সংরক্ষিত বনভূমি ও পাহাড় রয়েছে। এসব পাহাড়ে প্রায় দশ হাজার বসতঘর রয়েছে। এর মধ্যে পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ। প্রতিবছর ভারী বর্ষণে উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটে।
উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের ৪নম্বর ওয়ার্ডটিতে দেখা যায়, ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুর, গলাচিপা, সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন গ্রামে অন্তত কয়েক শতাধিক পরিবার ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে পাহাড়ের ঢালে, পাদদেশে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায়। যেকোনসময় পাহাড় ধসে প্রাণহানিসহ ভয়াবহ পরিস্থিতি নেমে আসতে পারে এসব বাসিন্দারের জীবনে।
একই ওয়ার্ডের সোনারগাঁও নতুনপাড়া গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকাটিতে শতাধিক পরিবারের বসবাস। সবগুলো পরিবার বসবাস করছে খাড়া পাহাড়ের ঢালে। কিছু পরিবার ওই পাহাড়ের উপরই বসবসা করেন। বৃষ্টিতে পাহাড়গুলোতে মাটি ধসে পড়ার চিহ্ন রয়েছে। এরমধ্যেই রাতের আঁধারে পাহাড়গুলো কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোনারগাঁও নতুন পাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সৈয়দ বলেন, বনবিভাগের মালিকানাধীন এই এলাকায় দখলস্বত্বের ভিত্তিতে প্রায় ১০০টি পরিবার বসবাস করেন অন্তত অর্ধশত বছর ধরে। ঝুঁকি আছে তারপরও নিম্ন আয়ের হওয়ায় কোথাও যাওয়ার সুযোগ না থাকায় সবাই থাকছেন বলে তিনি জানান। ঝড়ো হওিয়া কিংবা ভারী বৃষ্টিপাত হলে আমরা ঘর ছেড়ে আত্নীয় স্বজনের দ্বারে আশ্রয় নিই। আমরা নিম্ন আয়ের মানুষ জায়গা কিনে ঘর বাধার সামর্থ নেই। জানি যে কোন সময় পাহাড় ধসে আমাদের মৃত্যু হবে তারপরেও আমাদের যাওয়ার জায়গা নেই।
দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের গলাচিপা এলাকায় মরিয়মনগর ডিসি সড়ক থেকে প্রবেশ মুখের কিছু দূর এগুলেই দেখা গেছে বেশ কিছু পাহাড় কাটা হয়েছে। সেই পাহাড়গুলোর উপরই ঝুঁকি নিয়ে মাটির বসতঘরে বসবাস করছে অন্তত ১০টি পরিবার। বৃষ্টি এলেই ধসে পড়তে পারে ঘরগুলো। এই এলাকা থেকে বের হয়ে মোহাম্মদপুর এলাকাতেও প্রবেশমুখের কিছু অদূরে গিয়ে দেখা যায় একটি পাড়ার অন্তত ২০টি পরিবার বসবাস করছে পাহাড়ি টিলায়। পাহাড় কেটে একেবারে মাটির টিলা বানানোর স্পষ্ট আলামত রয়েছে। বসতঘরগুলোর চারদিকে পাহাড়ি টিলাগুলো কাটতে কাটতে একেবারে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা হলেও তারা সবাই সেখানে থাকছেন।
রাঙ্গুনিয়া পৌরসভার নোয়াগাঁও এলাকার বাসিন্দা কোহিনুর আক্তার (৬০) বলেন, তাঁর ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি–নাতনিকে নিয়ে পাহাড়ের কোলে থাকেন। কর্ণফুলী নদীভাঙনের কারণে সরফভাটা ইউনিয়নের ভূমিরখীল থেকে গত ১৮ বছর আগে তাঁরা এসেছেন। নিজেদের কোনো ভিটেবাড়ি নেই। তিনি আরও বলেন, রাঙ্গুনিয়াসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ধসে মৃত্যুর খবর তিনিও পেয়েছিলেন, কিন্তু কী করবেন? যেখানে দুবেলা ভাত তাদের ঠিকমতো জোগাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে অন্য কোথাও গিয়ে বসতঘর নির্মাণ তাদের চিন্তার বাইরে। তার মতো এ এলাকার কুলসুমা বেগম (৩৫), রাহেলা আক্তার (৫২), হুমায়ারা বেগমসহ (৪৮) অর্ধশতাধিক পরিবার একইভাবে পাহাড়ের ঢালুতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করছে।
রাঙ্গুনিয়া বন বিভাগের উপজেলা রেঞ্জ কর্মকর্তা নাহিদ হাসান জানান, এসব পরিবারকে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাস ছেড়ে নিরাপদে বসবাস করার জন্য নানাভাবে চেষ্টা করেছি। তারা আমাদের কথা শুনে না। তাদের কথা মরলে পাহাড়ের টিলায় মরবো। তারপরেও এ জায়গা ছাড়ব না।
রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান মেহবুব জানান, মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চলছে। পাহাড়ধসের কবল থেকে বাঁচতে জরুরি সময়ে নিকটস্থ সরকারি প্রতিষ্ঠান স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানে যেতে বলা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন মাইকিং করেছে। কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস।