রাইসির মৃত্যু কি ইরানে কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে ?

11

আকতার কামাল চৌধুরী

মধ্যপ্রাচ্যে এক ব্যতিক্রমী দেশ ইরান। চারপাশে রাজা-বাদশা, আমির-শেখগণ যেখানে বংশ পরম্পরায় রাজ্য শাসন করে আসছেন সেখানে ইরান আলাদা।
পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৭৯ সালে বিপ্লব ঘটায় ইরানি জনগণ। ইরানের তৎকালীন রাজা শাহ-এর মসনদ বাঁচানোর চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা। কিন্তু কিছুতে কিছুই হয়নি, ইরানি জনতার বিপ্লবের জোয়ারে সবকিছু ভেস্তে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে পশ্চিমাদের শত হুঙ্কার, শত কূটনীতি।
সফল বিপ্লবের পর ইরানি জনগণের প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেন আয়তুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনি। মূলত তাঁর অঙ্গুলিহেলনেই চলতে থাকে ইরান।
না,শুধু শুধু বিপ্লব করে বসে থাকেনি তারা। ফিরে যায় গণতন্ত্রের পথে। সেটা অবশ্য ইসলামি ভাবধারারই গণতন্ত্র।
আর সেই ১৯৭৯ সাল থেকেই ইরান পশ্চিমাদের চক্ষুশূল। শুধু পশ্চিমারা কেন, ইরানের প্রতিবেশি শাসকগোষ্ঠীদেরও চক্ষুশূলে পরিনত হয় বিপ্লবীরা। বলতে গেলে এই বিপ্লবের ঢেউ, বিশেষ করে সৌদি আরবের রাজা-বাদশার মসনদ কাঁপিয়ে তোলে। তাই নিজেদের গদি বাঁচাতে ইরানের বিরুদ্ধে তারাও পশ্চিমাদের সাথে এককাট্টা হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ তখন চরমে। এই স্নায়ুযুদ্ধের সুযোগে ইরান সোভিয়েত বলয়ে ঢুকে পড়ে। সোভিয়েত ইউনিয়নও বুকে টেনে নেয় পশ্চিমাবিরোধী ইরানকে। তখন বিশ্বে একঘরে হয়ে পড়া ইরান চীনসহ সোভিয়েত ঘরনার রাষ্ট্রগুলোর সাথে দোস্তি গড়ে তোলে। নিজেদের তেল-গ্যাস রপ্তানির মাধ্যমে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সাপোর্ট নিয়ে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মনোনিবেশ করা ইরান শক্তিমত্তায় বর্তমানে একটি অবস্থান তৈরি করেছে। এমনকি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর কঠিন নিষেধাজ্ঞা, প্রবল চাপ, শ্যেনদৃষ্টিকে পাশ কাটিয়ে পারমাণবিক প্রকল্পের মতো উচ্চবিলাসি ও সংবেদনশীল পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার মতো ঝুঁকিও গ্রহণ করে।
ইরানকে অস্থির করে রাখার লক্ষ্যে ইরাকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরানের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়া তোলে পশ্চিমারা। আধুনিক সমরাস্ত্রের যোগান দিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে বলিয়ান করে তোলে। এমনকি একসময় ইরানের বিরুদ্ধ যুদ্ধও বাঁধিয়ে দেয়।
ইরান-ইরাক যুদ্ধের পরিসমাপ্তির পর সাদ্দাম হোসেন ইউটার্ণ দিয়ে বসেন। পশ্চিমাদের অস্ত্রে বলিয়ান সাদ্দাম হোসেন দিন দিন বেপরোয়া ও দুর্বিনীত হয়ে উঠেন। একসময় বিনা উস্কানিতে কুয়েত দখল করে নিয়ে সৌদি আরবসহ পশ্চিমাদের গালে চপেটাঘাত বসিয়ে দেন।
এর পরের ইতিহাস বড়োই নির্মম! নিজেকে জুলিয়াস সিজার ভাবার স্বপ্নে বিভোর সাদ্দাম হোসেনের এক ভয়ানক আগ্রাসী সিদ্ধান্তের কারনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে অবাধ প্রবেশের এক আশাতীত প্রবেশাধিকার পেয়ে যায়। একইসাথে ইসরায়েলকে আরও দুর্বিনীত হওয়ার সাহস যোগায়।
কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তখনও ইরান নির্মোহ থাকে,সাদ্দাম হোসেনের হাজারো অনুনয় উপেক্ষা করে তাঁর পাশে না-দাঁড়িয়ে কুয়েত দখলের বিরোধিতার পাশাপাশি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধেও সরব হয় ইরানের নেতৃত্ব। আবেগের বশবতী হয়ে অপরিণামদর্শী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকেন তারা।
সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট রাইসির শাসনামলে কঠিন মাথাব্যথার কারণ ছিল ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প। যদিও ইরানের দাবি – ‘তাদের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত’। কিন্তু পশ্চিমারা ইরানের এই দাবি মানতে নারাজ। তাদের আশংকা, ইরান বিদ্যুৎ উৎপাদনের নামে তলে তলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে ; যা ইরানকে একসময় পারমাণবিক বোমার অধিকারী করে বসবে। আর এই আশংকা সত্যি হলে পাশ্চিমারা তা যেকোনো মূল্যে ঠেকাবেই। তারা চায় না মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল কোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হোক। তাই এই প্রকল্পকে ঘিরে ইরানের উপর একের পর এক কঠিন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে তারা। ইব্রাহীম রাইসির পূর্বসূরি হাসান রুহানী অত্যন্ত সুকৌশলে এবং ঠান্ডা মাথায় এই নিষেধাজ্ঞা মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সামর্থ্য হন।
কিন্তু সারা বিশ্বের প্রতিপক্ষ হয়ে তো আর চলা যায় না।বিশেষ করে আরব বসন্তের বাত্যাবরণে ইরাক,মিসর,লিবিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশগুলোকে একে কূপোকাত হতে থাকলে ইরানও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেক দেনদরবার শেষে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি দেশের সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে উপনীত হয় ইরান। ইতিহাসে যা ‘ছয়জাতি চুক্তি’ হিসেবে পরিচিত। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ইরান তার পারমাণবিক প্রকল্পে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ করার বিনিময়ে পশ্চিমারা ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাও প্রত্যাহার করে নেবে।
কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্র। আবার শুরু হয় টানাপোড়েন আর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের খেলা।
এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বাস্তবতা হলো, বিশ্বে কানাঘুষা চলছে-’ইরান সাম্প্রতিককালে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ এটোটাই বাড়িয়েছে যে,তারা এখন পারমাণবিক বোমার অধিকারী হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে’। যদিও অনেক বোদ্ধা এই আশংকাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন।
রাইসির ক্ষমতা গ্রহণ করার পরের বছর ২০২২ সালে নিতি পুলিশের হেফাজতে মাশা আমিনীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে পুরো দেশ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে। বলতে গেলে হিজাববিরোধী আন্দোলনে সরকারের ভিত কেঁপে ওঠে। বেশ কয়েকজনের মৃত্যু,গ্রেফতার, লাঠিচার্জ কোনোকিছুতেই কাজ না-হওয়ায় সরকার একসময় হিজাব আইন সংশোধন করতে বাধ্য হয়। ইরানের সংস্কারপন্থী গ্রুপ এবং বিশ্বে ইরানবিরোধী রাষ্ট্রগুলো এই আন্দোলনে মদদ দিলেও রাইসির সরকার শক্তভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়। যদিও সরকারের দমনপীড়ন নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।
২০১৬ সালে সৌদি আরব শিয়া আধ্যাত্মিক নেতা নিমর আল নিমরের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করলে ইরানের সাথে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকে। এই মৃত্যুদন্ডকে কেন্দ্র করে ইরানের জনগণ সৌদি দূতাবাসে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এর জেরে সৌদি আরব ইরান থেকে দূতাবাস গুটিয়ে নেয় এবং কূটনৈতিক সম্পর্কও ছিন্ন করে।
সৌদি আরবের সাথে ছিন্ন হওয়া কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগাতে মুন্সিয়ানা দেখান রাইসি। ইরানের পরম মিত্র চীনও সুযোগ বুঝে সৌদি আরবের সাথে ইরানকে এক টেবিলে বসিয়ে দেয়। আর বৈশ্বিক বাস্তবতা অনুধাবন করে পুরোনো বৈরীতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোড়া লাগায় দুই দেশ।
সৌদি আরবের চরম শত্রু হুতিদের প্রতি ইরানের অন্ধ সমর্থন দুদেশের সম্পর্ককে এতদিন আরও ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। যা রাইসির আমলে অনেকটা প্রশমিত হয়।
গেল ১লা এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইসরায়েল। এই হামলায় ইরানের তিন ঊর্ধ্বতন জেনারেলসেহ ১২ জন নিহত হন। এর আগে ২০২০ সালে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাশেম সোলাইমানীকে হত্যা করেছিল ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র।
এইসব ঘটনাবলী ইরানকে অস্তিত্বের সংকটে ফেলে দেয় বিশ্বে। শেষতক আলী খামানীর পরামর্শে রাইসি আকাশপথে দুঃসাহসিক হামলা চালান ইসরায়েলে। এই হামলার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সামাল দিতে সক্ষম হন তিনি।
ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েলের নারকীয় গণহত্যার একমাত্র উচ্চকণ্ঠ ইরান।তারা অকুতোভয়ে হুতি বিদ্রোহী ও হিজবুল্লাহকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।
সেই ইব্রাহিম রাইসি মারা গেলেন হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায়। এটি নিছক দুর্ঘটনা না কি কোনো সাবোটেজ ? অবশ্য ইরান এপর্যন্ত কাওকে এই দুর্ঘটনার জন্যে দায়ি করে বিবৃতি দেয়নি। অতএব, আপাতত এটাকে দুর্ঘটনাই বলা চলে।
খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হলো – রাইসির মৃত্যুকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র,ইসরায়েল ছাড়া সারাবিশ্বে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। এমনকি রাইসির মৃত্যুতে নিরাপত্তা পরিষদে একমিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতাও পালন করা হয়। যেখানে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি উপস্থিত থেকে একাত্বতা দেখান। চিরশত্রæ সৌদি আরবও শোকবার্তা দেয়।
রাইসি কি শিয়া,না কি সুন্নী, না কি ওহাবী – এ প্রশ্ন এখন অবান্তর মুসলিম বিশ্বে। সবাই তাঁর মৃত্যুতে শোকাভিভূত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলো যখন দিন দিন পশ্চিমাদের পেটে চলে যাচ্ছে,শাসকেরা পদলেহন করতে করতে সেবাদাসে পরিনত হচ্ছে, সেখানে ইরান শত প্রতিকূলতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে স্বমহিমায় একা-ই একশো হয়ে বুকচিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে। তাই ইরানী নেতৃত্বেই যেন স্বস্তি। ইরান-ই যেন আজ শক্ত মেরুদন্ডের প্রতীক।
রাইসির মৃত্যু কি ইরানে কোনো অভাবিত পরিবর্তন নিয়ে আসবে? না,এরকম সম্ভাবনাকে নাকচ করেই দিতে হয়। যদিও পশ্চিমারা সংস্কারপন্থীদের ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। কিন্তু, যেখানে গণতন্ত্র আছে(যদিও ইরানের এরকম গণতন্ত্র ও নারীর অধিকার নিয়ে বিতর্ক আছে), ভোটাধিকার আছে,যেখানে কেউ এককভাবে রাষ্ট্রের প্রতিভূ দাবি করতে পারে না, সেখানে শাসক বদল হলেও রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়ে কোনো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অবান্তর। সুতরাং, ইরান ইরানের মতোই থাকবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক