যার হাত ধরে কলাবতী শাড়ি

7

সুফল চাকমা

কলাগাছের তন্তু থেকে উৎপাদিত কলাবতী শাড়ি সাড়া জাগিয়েছে দেশজুড়ে। এর কারিগর হিসেবে রাধাবতীর নাম প্রচারিত হলেও মূল উদ্যোক্তা ছিলেন বান্দরবানের সাইং সাইং উ নিনি। যিনি গবেষণার মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের কাছে পাইলট প্রকল্পে শাড়ি তৈরির প্রস্তাব রাখেন।
সাইং সাইং উ নিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক, উদ্যোক্তা, সংগঠক। কলাগাছের তন্তু থেকে কলাবতী শাড়ি ও ব্যানানা সিল্ক শাড়ি তৈরির পরিকল্পনার উদ্যোক্তাও তিনি। যদিও কলার তন্তু থেকে শাড়ি তৈরির কৃতিত্ব একা নিতে রাজি নন তিনি। কলাবতী শাড়ি বান্দরবান পার্বত্য জেলার একটি ব্র্যান্ডিং প্রোডাক্ট। এর বিশেষত্ব হলোÑ কলাগাছের তন্তু থেকে বিশেষ পদ্ধতিতে বাছাইকৃত উৎকৃষ্ট তন্তু থেকে বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে সুতাগুলোকে শাড়ি বোনার উপযোগী করে তা দিয়ে তৈরি করা হয়।
নিনি বলেন, ‘ডিসি মহোদয়কে আমি প্রকল্পের শুরু থেকে জানিয়েছিলাম যে এ প্রকল্পে আমার আগ্রহের মূল কারণ হচ্ছে এলাকার কিছু মানুষের উপকার করা। পিস মহিলা কল্যাণ সংগঠনের ১০ জনসহ মোট ৪০ মহিলাকে বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ দিনব্যাপী তন্তু থেকে থেকে পণ্য তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তবে কেউ এই ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। বান্দরবান মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক পরে তৎকালীন জেলা প্রশাসককে কাজের জন্য একটা তাঁত এবং একজন তাঁতির প্রয়োজন বলে জানানো হলে তার সম্মতিতে এখানকার কোমর তাঁতে যারা ন্যূনতম কাজ করতে পারে, তাদের এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করি। এ ছাড়া আমার স্বামী মনিপুরী স¤প্রদায়ের হওয়ার সুবাদে তার এলাকা থেকে একজন তাঁতি নিয়ে আসতে বন্ধু শ্যাম কিশোর সিংহকে অনুরোধ করা হলে কারিগর রাধাবতীর নাম প্রস্থাব করা হয়। তবে কলাগাছের তন্তু থেকে কাপড় বুননের কথা শুনে রাধাবতী প্রথমে আসতে চাননি। তিনি জানান, কখনও কলাগাছের তন্তু দেখেননি। একটা নমুনা পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। অবশেষে তিনি দৈনিক ৮০০ টাকা মজুরিতে কাজ করতে রাজি হন এবং সঙ্গে হেমন্ত কুমার সিংহকেও বান্দরবানে নিয়ে আসেন। রাধাবতী চলে এলে এখানকার কিছু লোকাল তাঁতিকে নিয়ে কোমর তাঁতে কাজ শুরু করি। কলাগাছের সুতাগুলোকে আমি এবং আমার পরিবার দায়িত্ব নিয়ে প্রসেসিংয়ের কাজগুলো করতে থাকি। প্রথম দিকে বুননের কাজে এখানকার কোমর তাঁত ব্যবহার করা হয়েছিল। প্রজেক্টের একপর্যায়ে আমরা এক হাত সমান কাপড় তৈরি করতে সক্ষম হই এবং ধীরে ধীরে বেশ কয়েকটি কাপড় তৈরি করি। পাইলট প্রজেক্টের অগ্রগতি দেখে জেলা প্রশাসক এটা দিয়ে ফাইল ফোল্ডার তৈরি করার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু যেহেতু কোমর তাঁতে কাপড় তৈরি করা কঠিন ও শ্রমসাধ্য। ফলে একটি তাঁতের প্রস্তাব দেই জেলা প্রশাসককে। প্রস্তাবে রাজি হলে মৌলভীবাজার থেকে তাঁত তৈরির জন্য সুরেন সিংহসহ হেমন্তকে নিয়ে আসি।
নিনির ভাষ্যমতে, প্রকল্পের এই পর্যায়ে এসে সুতা তৈরি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তিনি, তার পরিবার ও হেমন্ত সিংহ নিরলসভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করে কীভাবে সুতার গ্রেডিং মান ভালো করা যায় সে ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন। প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ ভালো সুতা তৈরি করতে সক্ষম হওয়ার পর সে সুতা দিয়ে রাধাবতীকে শাড়ি তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নিনি বলেন, ‘শাড়ি তৈরির একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে রাধাবতী চলে যেতে চান। যেহেতু প্রকল্প শেষ করাটা দায়িত্ব ছিল, তাই তাকে বুঝিয়ে কাজ করার সাহস জোগাই।
অবশেষে ২০২৩ সালের ৩০ মার্চ শাড়ি সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। শাড়ি তৈরির কাজ শেষ করে জেলা প্রশাসককে জানাই। তিনি আমার বাসভবনে উপস্থিত হলে তাকে বলি- স্যার এটা বাংলাদেশে কলাগাছের তন্তু থেকে তৈরি করা প্রথম শাড়ি। এই তন্তু থেকে আগে কেউ শাড়ি বা কাপড় বানায়নি।’
কলাবতী শাড়ীর সাফল্য দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি। সংবাদপত্র, টিভি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ শাড়ীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। নিনি বলেন, শাড়ি বুননের কাজ যেহেতু রাধাবতী করেছেন, তাই শাড়িটির নাম কলাগাছের কলা ও রাধাবতীর বতী অর্থাৎ কলাবতী নামকরণ করেন জেলা প্রশাসক। এভাবে কলাবতীর মাধ্যমে আরেকবার মানুষ বান্দরবানকে নতুনভাবে চেনে।’
নিনি জানান, পাইলট প্রকল্পের পণ্য হিসেবে প্রথম কলাবতীতে অনেক খুঁত ছিল, বিভিন্ন অংশ অমসৃণ ছিল। ডিসি স্যারকে বলিÑ আর একটু চেষ্টা করতে চাই। এবার আমি ব্যানানা সিল্ক তৈরির চেষ্টা করতে চাই। প্রকল্পের এই পর্যায়ে আমার পরিবার ব্যানানা সিল্ক শাড়ি তৈরি করার ব্যাপারে শঙ্কা প্রকাশ করে।
নিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসক প্রধানমন্ত্রীকে কলাবতী উপহার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। বিষয়টি তখন আমাদের জন্য আরও বেশি চ্যালেঞ্জের হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত ব্যানানা সিল্ক তৈরি করা আমাদের জন্য নতুন এবং সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে বিষয়টি অস্পষ্ট। সুতা ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে ব্যানানা সিল্ক শাড়ি তৈরি করার সময় তাঁতিরা অনীহা প্রকাশ করা শুরু করে। শেষে ব্যানানা সিল্কের শাড়ি তৈরি করার ওপরে পুরোপুরি নির্ভর না করে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে অন্য আরেকটি তুলা দিয়ে কলাবতী শাড়ি বানানোর কাজ শুরু করি। পাশাপাশি ব্যানানা সিল্কের শাড়ি তৈরির কাজও চালিয়ে যাই। পরে গাম স্প্রে ব্যবহার করে সফলভাবে ব্যানানা সিল্কের কাজ সম্পন্ন করতে সক্ষম হই। পিস মহিলা কল্যাণ সংগঠনের প্রতিনিধি হিসেবে পাইলট প্রকল্পের পরবর্তী কোনো ধরনের সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়া কলাবতী শাড়ি উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিনি নিজ খরচে। কয়েকজন মেয়েকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে সীমাবদ্ধতার ভেতর দিয়েও এই আইকনিক পণ্য ধরে রাখতে কাজ করছেন সাইং সাইং উ নিনি।