যানজট বাড়াবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল বুথ!

17

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করতে চলেছে সরকার। তবে এতে নতুন করে যানজট তৈরির আশঙ্কা করছেন পর্যটকসহ সংশ্লিষ্টরা। কারণ পতেঙ্গা প্রান্তে টানেল চত্বরে বসানো হচ্ছে চারটি টোল বুথ। সেখানে টোলের জন্য সময়ক্ষেপণ হবে যানবাহনের। দীর্ঘ হতে পারে যানজট। গত কয়েকদিনে পতেঙ্গা এলাকা ঘুরে পরিবহন চালক-শ্রমিক, পর্যটক, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব পূর্বদেশকে বলেন, ‘সময় বাঁচানো এবং যানজট নিরসনের জন্য মানুষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করবে, কিন্তু পতেঙ্গা গিয়ে যদি টোল দেয়া-নেয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়, তাহলে সুফল আসলো কোথায়? আমরা ঈদের আগে দেখেছি, কর্ণফুলী সেতুর টোলের কারণে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। এতে অনেকে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। সেটা যাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে না হয় তা মাথায় রেখে যেন সংশ্লিষ্টরা কাজ করেন।’
তবে নির্মাণকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ পূর্বদেশকে বলেন, ‘পতেঙ্গা প্রান্তে টোল বুথ স্থাপন করলেও আমরা এখনও যান চলাচল চালু করিনি। পূর্বের পরামর্শক টিমের কিছু ভুল ছিলো। আমরা সেগুলো খুঁজে বের করে তারপর চালু করবো। তাই অভিজ্ঞ মহলের চূড়ান্ত পরামর্শ ছাড়া সম্পূর্ণ কাজ শেষ হয়েছে বলতে পারছি না। পুলিশ, প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সকলের সমন্বয়ে বাকি কাজ সম্পন্ন করে যান চলাচল করা হবে।’এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকেও যানজটের বিষয় নিয়ে সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি দেয়া হয়। এতে বলা হয়- ‘কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে প্রথম টানেল উদ্বোধন করেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। উদ্বোধনের পর থেকেই পর্যটনস্থান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল এর গুরুত্ব জাতীয় অর্থনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক/দর্শনার্থী টানেল পরিদর্শন ও সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে আসছেন। এজন্যই বিচ গোল চত্বরে যানবাহনের চাপ ক্রমেই বেড়ে গিয়ে জটিলতর হচ্ছে। লালখানবাজার থেকে পতেঙ্গা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল ও সিডিএ আউটার রিং রোড নির্মিত হওয়ায় বিমানবন্দর, পতেঙ্গা সি-বিচ ও আনোয়ারা-কক্সবাজার তথা দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাথে সারা দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হতে যাচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ে পুরোদমে চালু হবার সাথে সাথে এক্সপ্রেসওয়ের পতেঙ্গা টোল বুথ ত্রিকোণী সংযোগস্থল, টানেল এর সামনের গোল চত্বর ও বিচ এলাকায় আগত হাজার হাজার পর্যটক-দর্শনার্থী ও তাদের বহনকারী যানবাহনের দ্বারা যানজটের এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করবে।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, নগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এখন দৃশ্যমান। যদিও এর কিছু কাজ এখনও বাকি রয়েছে। তার মধ্যে সড়ক বাতির পোল স্থাপন, সৌন্দর্য বর্ধন, ট্রাফিক সাইন, মার্কিং ইত্যাদির কাজ চলছে। চার লেনের দুটি সড়কের একপাশ পুরোপুরি প্রস্তুত। আরেক পাশের কাজ কিছুটা বাকি আছে। বসানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক পোল। তাতে লাগানো হবে বাতি। এখনও শুরু হয়নি সিসিটিভি ক্যামেরা এবং স্পিড ক্যামেরা লাগানোর কাজ। এরই মধ্যে এ সড়কে মোটরসাইকেল চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। তবে এসব কাজ শেষ হয়ে গেলে কিছুদিনের মধ্যে যান চলাচল করতে পারবে বলে জানান কর্মরতরা।
সি বিচ এলাকায় ঘুরতে আসা রুহুল আমিন সাজ্জাদ বলেন, ‘এমনিতে এ এলাকায় কোনো শৃঙ্খলা না থাকায় মূল সড়কের উপর এলোমেলোভাবে গাড়ি রাখছে। এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে আরও বেশি বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে।’
সিডিএ’র কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, আগে বহদ্দারহাট থেকে দুই-তিন ঘণ্টা লাগতো এয়ারপোর্ট কিংবা পতেঙ্গায় যেতে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হলে মাত্র ২০ মিনিটে যাওয়া যাবে। এটিতে ওঠানামার জন্য ১৫টি র‌্যাম্প থাকবে। এর মধ্যে ১৩টি র‌্যাম্প নির্মাণাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে যানবাহনের টোলের হার অনুমোদন দিয়েছে। তবে কবে নাগাদ যান চলাচল শুরু হবে, সেই সিদ্ধান্ত এখনও হয়নি। পুরো এক্সপ্রেসওয়েতে টোল নেওয়ার জন্য ১৪টি টোল বুথ থাকবে। প্রাথমিকভাবে পতেঙ্গা প্রান্তে চারটি টোল বুথ থাকবে। র‌্যাম্প নির্মাণের পর বাকি টোল বুথ বসানো হবে। তখন আর পতেঙ্গা প্রান্তে যানজট হবে না।
তারা আরও বলেন, এই সড়কে সর্বোচ্চ গতিসীমা রাখা হয়েছে ৬০ কিলোমিটার। এখানে নিরাপত্তার জন্য বসানো হবে সিসিটিভি ক্যামেরা এবং যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে থাকবে স্পিড ক্যামেরা। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ এই ক্যামেরা নিয়ন্ত্রণ করবে। নির্ধারিত গতির চেয়ে যারা কম বা বেশি চালাবে সেসব যানবাহনগুলোকে অটোমেটিক স্পিড ক্যামেরার মাধ্যমে জরিমানার আওতায় আনা হবে।
টোলের বিষয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে চলাচল করলে কার ১০০ টাকা, জিপ ১০০ টাকা, মাইক্রোবাস ১০০ টাকা, মিনিবাস ২০০ টাকা, বাস ৩০০ টাকা, ট্রাক (চার চাকা) ২০০ টাকা করে টোল দিতে হবে। তবে উড়াল সড়কে চলবে না মোটরসাইকেল, ট্রাক (৬ চাকা) এবং কাভার্ড ভ্যান। প্রায় ১৬ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে, ৫৪ ফুট প্রশস্ত এবং চার লেনের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ১৫টি র‌্যাম্পের মধ্যে জিইসি মোড়ে একটি, টাইগারপাসে দুটি, আগ্রাবাদে চারটি, ফকিরহাটে একটি, নিমতলায় দুটি, সিইপিজেডে দুটি, সিমেন্ট ক্রসিং মোড়ে একটি এবং কেইপিজেড এলাকায় দুটি থাকবে।
সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করলে যানবাহনে নির্ধারিত হারে টোল দিতে হবে। টেন্ডারের মাধ্যমে এই টোল আদায়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে এখনও টেন্ডার আহ্বান করা হয়নি।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল নির্মাণের ফলে পতেঙ্গা এলাকায় যানজট হওয়ার আশঙ্কা করে আমাদের পক্ষ থেকে সিডিএ, সিটি করপোরেশনের মেয়র বরাবর সমস্যা ও সমাধানের উপায় উল্লেখ করে অবগত করেছি। তারা যদি এটা সমাধান করে তবে ভালো, না হয় নগরবাসী ভোগান্তিতে পড়বেন।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম নগরীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের ১১ জুলাই একনেক সভায় চট্টগ্রাম শহরের লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। প্রথমে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ২৫০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। তিন বছরের মধ্যে অর্থাৎ, ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়। তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তৃতীয় দফায় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এই দফায় সময় বেড়েছে এক বছর। অর্থাৎ, ২০২৩ সালের জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা। একই সময়ে প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ৩৬৯ কোটি ৭ লাখ ১০ হাজার ৮১৯ টাকা করা হয়। সিডিএ’র এই প্রকল্প যৌথভাবে বাস্তবায়ন করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স-র‌্যাংকিন।