মুহাম্মাদ ফাতিহ

7

দ্বিতীয় মুহাম্মাদ, ৭ম উসমানীয় সুলতান। তিনি মুহাম্মাদ ফাতিহ অর্থাৎ বিজয়ী মুহাম্মাদ নামে পরিচিত। ১৪৪৪ সালের আগস্ট থেকে ১৪৪৬ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি সুলতান ছিলেন। এরপর ১৪৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় মসনদে অসেন। দ্বিতীয় দফায় তিনি ১৪৮১ সালের মে পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি ও তার শায়খ আকশামসউদ্দিন কনস্টান্টিনোপল এর কাছে প্রথম কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধের সময় সাহাবী আবু আইয়ুব আনসারির কবর খুঁজে পান ও পরবর্তীতে সেখানে আসে মসজিদ নির্মাণ করেন। মুহাম্মাদ (সাঃ) ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী কনস্টান্টিনোপল বিজয় এই উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মুহাম্মদ ২১ বছর বয়সে কনস্টান্টিনোপল জয় বিজয় করেন। তার অসামান্য দক্ষতা তৎকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় কামান ও স্থল ভাগের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়া ছিল কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধের অন্যতম কৃতিত্ব।এর ফলে পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়। মুহাম্মদ আনাতোলিয়া, আলবেনিয়া, বসনিয়া, ক্রিমিয়া, ইতালি পর্যন্ত ইউরোপ অভিযান অব্যাহত রাখেন। আধুনিক তুরস্ক ও মুসলিম বিশ্বে সুলতান মুহাম্মদ একজন বীর হিসেবে সম্মানিত হন। তার স্মরণে ইস্তানবুলের ফাতিহ জেলা, ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ সেতু ও ফাতিহ মসজিদের নামকরণ করা হয়েছে।
শাহজাদা মুহাম্মদ ১৪৩২ সালের ৩০ মার্চ উসমানীয় রাজধানী এদির্নে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ ও মা হুমা খাতুন।
অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ১১ বছর বয়সে তাকে প্রথা অনুযায়ী আমাসিয়া শাসনের জন্য প্রেরণ করা হয়। তার পড়াশোনার জন্য সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ কয়েকজন শিক্ষক নিযুক্ত করেন। ইসলামি শিক্ষা তার মনে গভীর প্রভাব ফেলে। কনস্টান্টিনোপল জয় করার ক্ষেত্রে তরুণ বয়সে আকশামসউদ্দিন তার উপর প্রভাব ফেলেছিলেন।
১৪৪৪ সালের আগস্টে আনাতোলিয়ার কারামানিদের সাথে শান্তি স্থাপনের পর সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মসনদ ত্যাগ করেন এবং দ্বিতীয় মুহাম্মদ ১২ বছর বয়সে সুলতান হন। পোপের প্রতিনিধি কার্ডিনাল জুলিয়ান সিসারিনির মদদে হাঙ্গেরির রাজা মুসলিমদের সাথে চুক্তি লঙ্ঘন করেন। জুলিয়ান তাকে বোঝান যে মুসলিমদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করলে তা বিশ্বাসঘাতকতা হবে না। হাঙ্গেরির জানোস হুনয়াডির নেতৃত্বে পরিচালিত ক্রুসেডকে মুহাম্মদ প্রতিহত করতে সক্ষম হন।[৩] এসময় মুহাম্মদ তার পিতা মুরাদকে পুনরায় মসনদে বসার অনুরোধ করেন কিন্তু মুরাদ তাতে অস্বীকৃতি জানান। মুহাম্মদ এর ফলে ক্রুদ্ধ হন এবং পিতার কাছে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, “যদি আপনি সুলতান হন, তবে এগিয়ে এসে সেনাদের নেতৃত্ব দিন। যদি আমি সুলতান হই তবে আমি নির্দেশ দিচ্ছি আপনি আমার সেনাদের নেতৃত্ব দিন।” এরপর মুরাদ দায়িত্বগ্রহণ করেন এবং ১৪৪৪ সালে ভার্নার যুদ্ধে জয়লাভ করেন।
মুরাদের পুনরায় ক্ষমতাগ্রহণের ক্ষেত্রে উজিরে আজম হালিল পাশার ভূমিকা ছিল। মুহাম্মদের শিক্ষক আকশামসউদ্দিনের সাথে হালিল পাশার বিরূপ সম্পর্ক থাকায় তিনি মুহাম্মদের শাসনের পক্ষে ছিলেন না।
১৪৫১ সালে পুনরায় মসনদে বসার পর সুলতান মুহাম্মদ নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে শুরু করেন এবং কনস্টান্টিনোপল আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। বসফরাসের পূর্বে এশীয় অংশে তার প্রপিতামহ প্রথম বায়েজীদ আনাদোলুহিসারি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। মুহাম্মদ ইউরোপীয় অংশে রুমেলিহিসারি দুর্গ নির্মাণ করেন ফলে প্রনালীর উপর উসমানীয়দের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ স্থাপিত হয়। এরপর প্রণালী অতিক্রমকারী জাহাজের উপর করারোপ করা হয়। ভেনিসিয়ান একটি জাহাজ নির্দেশ অমান্য করায় সেটিকে কামানোর গোলার আঘাতে ডুবিয়ে দেয়া হয় এবং নাবিকদের শিরশ্ছেদ করা হয়।
কনস্টান্টিনোপলে প্রথম অবরোধের সময় শহরের নিকটে দাফন করা সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারির কবর আকশামসউদ্দিন আধ্যাত্মিক শক্তিবলে খুজে পেয়েছিলেন। বিজয়ের পর মুহাম্মদ এখানে আইয়ুব সুলতান মসজিদ নির্মাণ করেন।
১৪৫৩ সালে মুহাম্মদ কনস্টান্টিনোপল অবরোধ করেন। এসময় তার বাহিনীতে সেনা সংখ্যা ছিল ৮০,০০০ থেকে ২,০০,০০০ এবং জাহাজ ছিল ৩২০টি। এপ্রিলের শুরুর দিকে শহর অবরোধ করা হয়। বাইজেন্টাইন সম্রাট একাদশ কনস্টান্টাইন কোনো উত্তরসূরি না রেখে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত বড় ভাইয়ের পুত্ররা তার উত্তরাধিকারী হওয়ার কথা ছিল। সুলতান মুহাম্মদ তাদেরকে প্রাসাদের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র হাস মুরাদকে মুহাম্মদ পছন্দ করতেন। তাকে বলকান বেলেরবে নিযুক্ত করা হয়েছিল। কনিষ্ঠ পুত্র মেসিহ পাশা একজন নৌ সেনাপতি হন এবং গেলিপলির সানজাক বে নিযুক্ত হন। তিনি পরবর্তীতে সাম্রাজ্যের উজিরে আজম নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছু ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের ১০ বছর পর মুহাম্মদ ট্রয় সফর করে বলেন যে গ্রীক তথা বাইজেন্টাইনদের জয় করার মাধ্যমে তিনি ট্রোজানদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নিয়েছেন।
কনস্টান্টিনোপল জয়ের পর মুহাম্মদ শহরে অনেক মসজিদ ও মাদ্রাসা গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ফাতিহ মসজিদ অন্যতম। সুলতান সুলাইমানের পূর্বে তিনি প্রথম ফৌজদারি ও শাসনতান্ত্রিক আইন লিপিবদ্ধ করণ করেন বলে স্বীকৃত। তার শাসনামলে উসমানীয় সাম্রাজ্য কনস্টান্টিনোপল, এশিয়া মাইনর, সার্বিয়া, আলবেনিয়া,ইতালি,ক্রিমিয়া বিস্তৃত হয়।
বসফরাসের উপর তার নামে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ সেতু নির্মিত হয়েছে। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত তুর্কি ১০০ লিরার নোটে তার নাম ও ছবি ছাপানো ছিল।
১৪৮১ সালে নতুন অভিযানকালে ইস্তাবুলের মালতেপেতে পৌছানোর পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। কিছু দিন পর ৩ মে ৪৯ বছর বয়সে সুলতান মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ইস্তানবুলের ফাতিহ মসজিদ সংলগ্ন স্থানে দাফন করা হয়। ধারণা করা হয় যে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল। একটি সূত্র অনুযায়ী ইহুদি থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত ইয়াকুব পাশা এর সাথে জড়িত। আরেকটি সূত্রমতে তার পার্সিয়ান চিকিৎসক তাকে বিষপ্রয়োগ করেছিল।
সুলতান মুহাম্মদের মৃত্যুতে ইউরোপে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। এ উপলক্ষে গির্জার ঘণ্টা বাজানো হয় এবং উদ্যাপন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ভেনিসে ঘোষণা করা হয়: ‘লা গ্রান্দে একুইলা এ মরতা!’ (মহান ঈগল মৃত!) সূত্র : উইকিপিডিয়া