মুহররম ও আশুরার ইতিহাস ও ফজিলত

16

মুহাম্মদ শওকত আলী নূর

মুহররম (আরবি: محرم) হলো ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। চারটি পবিত্রতম মাসের মধ্যে এটি একটি। মুহররম শব্দটি আরবি যার অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। প্রাচীনকাল থেকে মুহররম মাস ও আশুরা পবিত্র হিসাবে গণ্য। মহররমের ১০ তারিখ বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন দিন, যাকে আশুর্ াবলা হয়ে থাকে। আশুরাও আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো দশম তারিখ। ইসলামি পরিভাষায় মহররমের দশম তারিখকে আশুরা বলে। সৃষ্টির শুরু থেকে মহররমের ১০ তারিখে তথা আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যার ফলে আশুরার মর্যাদা ও মাহাত্ম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ ৬২ হিজরি সনে কুফার ফোরাত নদীর তীরে কারবালার প্রান্তরে আমাদের প্রিয় নবীকরিম (সা.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেইন (রা.)-এর শাহাদত এই দিনকে বিশ্ববাসীর কাছে স্মরণীয় ও বরণীয় করে রেখেছে। আশুরার রোজা সব নবীর আমলেই ছিল। নবী করিম (সা.) মক্কায় থাকতেও আশুরার রোজা পালন করতেন। হিজরতের পর মদিনায় এসে রাসুলুল্লাহ (সা.) দেখতে পেলেন, ইহুদিরাও এই দিনে রোজা রাখছে। নবীজি (সা.) তাদের রোজার কারণ জানতে চাইলেন এবং জানতে পারলেন, এ দিনে মুসা (আ.) সিনাই পাহাড়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলকে ফেরাউনের কয়েদখানা থেকে উদ্ধার করেন এবং এ দিনেই তিনি বনি ইসরাইলদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন। আর ফেরাউন সেই সাগরে ডুবে মারা যায়। তাই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য ইহুদিরা এই দিন রোজা রাখে।
মহানবী (সা.) বললেন, মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ ও অগ্রাধিকারমূলক। অতঃপর তিনি ১০ মহররমের সঙ্গে ৯ মহররম মিলিয়ে দুটি রোজা রাখতে বললেন। কারণ, ইহুদিদের সঙ্গে মুসলমানদের যেন সাদৃশ্য না হয়। দ্বিতীয় হিজরিতে রমজান মাসের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা নফল হয়ে যায়। তবে রমজানের রোজার পর আশুরার রোজা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের নফল রোজা ও অন্যান্য ইবাদত রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনো মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম। (মুসলিম ও আবু দাউদ)। (বিশেষ প্রয়োজনে একটিও রাখা যাবে; তবে দুটি রাখাই উত্তম)।
হজরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত নবীজি (সা.) বলেন, আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর উছিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন। (তিরমিজি ও মুসানাদে আহমাদ)। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেন, রমজানের রোজার পরে মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ, যেমন ফরজ নামাজের পরে শেষ রাতের তাহাজ্জুদ নামাজ সবচেয়ে বেশি মর্যাদাসম্পন্ন।
আল্লাহ তাআলা কিছু দিনকে কিছুদিনের উপর, কিছু মাসকে কিছু মাসের উপর এবং কিছু সময়কে সময়ের উপর মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন। আর প্রতিটি ফজিলতমন্ডিত মাস, সময় ও দিনে কিছু আমল নির্ধারণ করেছেন এবং কিছু নাফরমানি থেকে বেঁচে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। মাস সমূহের মধ্যে মহররম মাস সম্মানিত মাস এবং আশুরার দিন বরকতময় দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। মহররম মাসের ফজিলতপূর্ণ আমলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-(১) মুহররম এর প্রথম ফজিলত ও তাৎপর্য হলো, আরবি হিজরী বছরের সূচনা এই মাস থেকেই শুরু হয়, অর্থাৎ ১২ মাসের মধ্যে প্রথম মাস মুহররম। মুসলিম জাতি এতে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। (২) এই মাসটি ১২ মাসের সম্মানিত চারটি পবিত্র মাসের মধ্যে একটি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন: ‘নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। (সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩৬)। (৩) এই মাসের রোজা অন্যান্য মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘রামাদানের পর সর্বোত্তম রোজা মুহররম মাসের এবং ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম নামাজ হল রাতের নামাজ। (সহিহ মুসলিম: ১২০২, সুনান আবু দাউদ: ২৪২৯, সুনান আল-তিরমিযী: ৭৪০)। আবু হুরায়রা বর্ণনা করেছেন একজন সাহাবী রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেসা করলেন যে, রামাদানের পরে সর্বোত্তম রোজা কোনটি? তিনি বললেন, ‘আল্লাহর মাসের রোজা। যে মাসকে তোমরা মুহররম মাস নামে জান। (সুনান আল-নিসা’ই আল-কুবরা: ২৯০৬, খÐ ২/১৭১। (৪) নবী করীম (সা.) এ মাসটিকে ‘আল্লাহর মাস’ বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও সমস্ত মাস আল্লাহ তা’আলার সৃষ্ট। কিন্তু এই মাসের গুরুত্ব ও মর্যাদার কারণে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করেছেন। আর এটা স্পষ্ট কথা যে, আল্লাহ তায়ালার সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলি সম্মানজনক এবং শ্রেষ্ঠতর। (৫) এই মাসে আশুরার দিন রয়েছে, যে দিনের রোযা এক বছরের গুনাহের কাফফারা। এ মর্মে রাসূলুল্লাহ (সা.) উল্লেখ করেছেন, আশুরার রোজা সামনের এবং পিছনের এক বছরের গুনাহের কাফ্ফারা। (সহিহ মুসলিম: ১১৬২, রোজা – সুনান আল-তিরমিযী: ২৫২)
পবিত্র কুরআনে সূরা তওবার ৩৬ নং আয়াতে বর্ণিত যে চারটি মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে মহররম অন্যতম। ‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় বারটি। এর মধ্যে বিশেষ রূপে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত ধর্ম। অতএব তোমরা এ মাসগুলিতে (ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করোনা, আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে রয়েছেন।’ (সুরা তাওবা : আয়াত ৩৬)। সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) এ মাসকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রমজানের পরে সর্বোত্তম সাওম হলো মহররম মাসের সাওম এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল তাহাজ্জুদের সালাত। মহররম হিজরি বর্ষের প্রথম মাস। নানা কারণে মাসটি অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। এমাসের ১০ তারিখ হলো পবিত্র আশুরা। এ দিনের সঙ্গে আছে পৃথিবী সূচনালঘেœর বহু ইতিহাস ও ঘটনা। মহররম মাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহ হচ্ছে-
১) মহররম মাসে আশুরার দিন তথা ১০ তারিখে হযরত আদম (আ.)-এর তওবা কবুল হয়েছে। বর্ণিত আছে, তিনি দীর্ঘ ৩০০ বছর কান্নাকাটির পর আশুরার দিনে তওবা কবুল হয়। ২) হযরত নূহ (আ.) এর জাহাজ মহাপ্লাবন থেকে এ দিন মুক্তি পায়। প্লাবন শেষে জাহাজটি জুদি পাহাড়ে (বর্তমানে আরারাত পর্বতশ্রেণী) এসে স্থির হয়। ৩) এ দিনে হযরত মূসা (আ.) ও বনি ইসরাইল ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্ত হন এবং ফেরাউন ও তার অনুচরবর্গ লোহিত সাগরে নিমজ্জিত হয়। ৪) হযরত ইউনুস (আ.)এ দিনে মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। ৫) হযরত ঈসা (আ.) এ দিন জন্মগ্রহণ করেন এবং এ দিনেই তাকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়। ৬) পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামরা (আ.) ও আশুরার দিন রোজা রাখতেন। ৭) উম্মতে মুহাম্মদির ওপর রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে, আশুরার রোজা ফরজ ছিল। রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার পর আশুরার রোজা নফল রোজায় পরিণত হয়। ৮) আরশ, কুরসী, আসমান-জমিন, চন্দ্র-সূর্য, তারকা, বেহেশত এ দিনেই সৃষ্টি করা হয়েছে। ৯) সর্বপ্রথম আসমান থেকে যমিনে বৃষ্টিপাত এ দিন থেকেই হয়েছে। ১০) হযরত ইবরাহিম (আ.) এ দিনেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে তিনি এ দিনেই মুক্তিলাভ করেছিলেন। ১২) এই দিনেই হযরত সোলাইমান আলাইহিস সালাম-কে উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন বাদশাহী দেয়া হয়েছিল। ১৩) এই দিনেই হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম তাঁর চোখের দৃষ্টি ফিরে পেয়েছিলেন। ১৪) এ দিনেই হযরত রাসুলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, বেহেশতি যুবকদের সরদার হযরত ইমাম হোসেইন (রা.) শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেন। ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান হিজরি সন তারিখ ও চান্দ্র মাসের সাথে সম্পর্কিত। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, আনন্দ-উৎসবসহ অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ হিজরি সনের ওপর নির্ভর করে। হিজরি সনের সাথে উম্মাহর তাহজিব-তামাদ্দুনিক ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। ফজিলতপূর্ণ ঐতিহ্যের এই আশুরাকে কেবলমাত্র ‘কারবালা দিবস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা আমাদের জন্য অনুচিত। আল্লাহ তাআলা সব ধরনের বিভ্রান্তি ও বিদআত থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন। কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।
লেখক: প্রাবন্ধিক