মুরাদপুর রণক্ষেত্র, ঝরল ৩ প্রাণ

93

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীর মুরাদপুর ও ষোলশহর দুই নম্বর গেটসহ আশপাশের এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এতে পুলিশসহ আহত হয়েছেন আরও একশ জন। এর মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংঘর্ষের সময় শুলকবহর থেকে জিইসি পর্যন্ত পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সংঘর্ষের পর তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।
গতকাল দুপুর থেকে কয়েক দফা সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে। এতে নিহতরা হলেন মো. ওমর ফারুক (৩২), ওয়াসিম আকরাম (২৩) ও ফয়সাল আহমেদ শান্ত (২৪)।
এর মধ্যে ফারুক স্থানীয় একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী এবং কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মো. দুলালের ছেলে। ওয়াসিম চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহŸায়ক। তিনি কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মেহেরনামা গ্রামের শফিউল আলমের ছেলে। ফয়সাল চট্টগ্রামের ওমরগণি এমইএস কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে পুলিশসহ প্রায় একশ জন আহত হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন ৭৮ জন।
নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন জানান, চমেক হাসপাতালে আসা রোগীদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন। তিনজনই গুলিবিদ্ধ।
সরেজমিন দেখা গেছে, সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় ছাত্রলীগের এক মিছিল থেকে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের গতকাল মঙ্গলবার নগরীর ষোলশহর রেলস্টেশনে বিক্ষোভ সমাবেশ করার কথা ছিল। কিন্তু দুপুর ১২টা থেকেই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল আজিম রনির নেতৃত্বে কয়েকশ ছাত্রলীগকর্মী রেলস্টেশনে অবস্থান নেন। এ সময় মুরাদপুর মোড়ে অবস্থান নেন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। এরপর বিকেল পৌনে ৪টার দিকে মিছিল নিয়ে মুরাদপুরের দিকে এগোতে থাকেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা।এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের রাস্তার আশপাশে অবস্থান নেওয়া শিক্ষার্থী ও পথচারীদের ওপর হামলা চালাতে দেখা যায়। ওই মিছিল থেকেই মুরাদপুরে শিক্ষার্থীদের ওপর প্রথমে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা হয়। পরে শুরু হয় গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ। এ সময় কয়েকজন অস্ত্রধারীকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। এতে শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। পরে তারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলে দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া।
সংঘর্ষ শুরু হলে নগরীর ব্যস্ততম সিডিএ এভিনিউ সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ মানুষ এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। শিক্ষার্থীদের কয়েকটি অংশ অলিগলিতে ঢুকে পড়েন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে মুরাদপুর মোড়ের নিয়ন্ত্রণ নেন। এ সময় শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় পাশের অলিগলিতে ঢুকে পড়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা। এরপর রাস্তায় অবস্থান নেয় পুলিশ। এ সময় প্রায় ৪০ মিনিট বিভিন্ন ভবনে ও গলিতে আশ্রয় নেওয়া ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ইট-পাটকেল নিক্ষেপ হয়।
বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে আবারও একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সামনে থেকে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা শুরু করেন যুবলীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় মুহুর্মুহু গুলি ও ককটেল বিস্ফোরণ হতে থাকে, এর মধ্যেই চলতে থাকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। সংঘর্ষ চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উপস্থিত ছিল না।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মহিন উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘আমাদের পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী কর্মসূচি ছিল। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতাকর্মীরা মুরাদপুরে পরিকল্পিতভাবে আমাদের ওপর হামলা করে। এতে আমাদের তিনজন নিহত হন। আর আহত হন প্রায় অর্ধশত।’
এদিকে সংঘর্ষের পর নগরীতে তিন প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। বিজিবির ব্যাটালিয়ন-৮ চট্টগ্রামের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাহেদ মিনহাজ সিদ্দিকী গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান।
সংঘর্ষকালে একের পর এক আহত শিক্ষার্থীকে রিকশা ও ভ্যানে করে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। চমেক পুলিশ ফাঁড়ির দেয়া তথ্যমতে, রাত ৯টা পর্যন্ত ৭৮ জনকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। একইভাবে নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওমরগণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান তারেক পূর্বদেশকে বলেন, আমরা সড়কে দুর্ভোগ দূর করতে ও জানমালের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য অবস্থান করছিলাম। সাধারণ মানুষকে কষ্ট দিবে, গাড়ি পোড়াবে, তা তো মেনে নিতে পারি না। আমাদের অবস্থানকালে তারা তেড়ে এসে সাধারণ জনগণ ও আমাদের ওপর হামলা চালায়। এতে তাদের এবং আমাদের মাঝে সংঘর্ষ হয়। তবে আমরা গায়ে পড়ে কারও ওপর হামলা চালাইনি।
ছাত্রলীগের মিছিলের কারণে সংঘর্ষ হয়েছে- এমন অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন সব দোষ তো ছাত্রলীগের ওপর আসবে। তারা মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, ক্ষতি করছে, তা তো কেউ বলবে না। খেটে খাওয়া মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছে। তারা নিজেরা রাজাকার বলছে, তারা ছাত্র হয় কি করে?
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ) মো. আশরাফুল হক বলেন, সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তিনজন নিহত হয়েছে। আহতের সংখ্যা অনেক। আমাদের অনেক পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন। তাদের সংখ্যা এখন বলা যাচ্ছে না।