মিরপুর-পল্লবীর মটস : মানবিক ভ্রাতৃত্ব গঠনে কৃষি ও কারিগরি প্রশিক্ষণে এগিয়ে

3

বদরুননেসা সাজু

ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত বৃহৎ ক্যাম্পাস জুড়ে গাছগাছালি/বৃক্ষশোভিত ফুলফল সমৃদ্ধ পাখিডাকা ছায়া সুনিবিড় শান্তিময় নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশে কারিগরী শিক্ষার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান মটস। মটস তৈরী করছে যুগের চাহিদা অনুযায়ী মান সম্পন্ন যন্ত্র, বিভিন্ন পণ্য ও সেবা সামগ্রী; ব্যবহারের উপযোগী এবং অনায়াসে কাজ করার জন্য এগুলো খুবই উপকারী। মিরপুর এগ্রিকালচারাল ওয়ার্কশপ এন্ড ট্রেনিং স্কুল(মটস) এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৩ সালে। কারিতাস সুইজারল্যান্ডের অর্থায়নে ও কারিতাস বাংলাদেশ তৎকালীন কোর( দ্য খ্রীষ্টান অর্গানাইজেশন ফর রিলিফ এন্ড রিহ্যাবিলিটিশন) এর আন্তরিক সহযোগিতায় মটস প্রতিষ্ঠিত হয়। সকলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টার ফলে এটি বর্তমানে নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে। গ্রামীণ ও পিছিয়ে থাকা যুবক ও যুব মহিলাদের/ছেলে মেয়েদের চাহিদা সম্পন্ন কৃষি ও কারিগরি শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করছে মটস। স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কারিগরি প্রশিক্ষণ/ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি তৈরী করে দেশে ও বিদেশে কর্মসংস্থানে এটি সহায়তা করছে। এভাবে অর্ধশত বছর ধরে মটস ভালোবাসার সাথে কারিগরী সেবা প্রদান করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কাথলিক বিশপ সম্মিলনীর দূরদর্শী চিন্তার ফসল বর্তমানের সুপ্রতিষ্ঠিত মটস।
কাথলিক অর্থ সার্বজনীন বা বিশ্বজনীন। বিশপ সম্মিলনীর দিক নির্দেশনায় ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের পুর্নগঠন ও পুনর্বাসন কাজের সহযোগী হয়ে বিশেষত যুব সমাজের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে মটস ২০২৩-এ ৫০ বছর পেরিয়ে আরো দক্ষ মানব সম্পদ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় এটি ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা একটি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গৌরব অর্জন করে। তাই ১৯৭৩ থেকে ২০২৩ কৃষি ও কারিগরি সেবার ৫০ বছরে এটি সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করে। এ উপলক্ষে একটি আকর্ষণীয় স্যুভেনির প্রকাশ করে। স্মরণিকার বৃহৎ পরিসরে মটসের মহৎ কার্যক্রমগুলো প্রতিভাত হয়। ইতোমধ্যে মটস নানাবিধ কার্যক্রমে বহু পুরস্কার অর্জন করে। দিন বদলের গল্প গাথায় লেখা আছে যাদের নাম, যাদের ত্যাগে ও দানে এবং ভালোবাসায় আজকের মটস, তাঁদের স্মরণে এবং তাঁদের করকমলে সুবর্ণ জয়ন্তীর (নান্দনিক লেখাবহুল ও বিবিধ সফল কর্মপ্রবাহের ছবি সমৃদ্ধ) স্মরণিকাটি উৎসর্গ করা হয়েছে।
স্মরণিকায় প্রদত্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী থেকে আমরা জানতে পারি- “কারিগরী শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে মটস দেশের বেকার, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থান ও আত্মকর্মসংস্থানের উপযোগী করে তুলছে।
মটস এর শিক্ষার্থীরা কারিগরি প্রশিক্ষণকে যথাযথভাবে আয়ত্ত করে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে।”
যেহেতু মটস কারিতাস এর একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠান, তাই কারিতাস বাংলাদেশের মাধ্যমে ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স এবং লং টার্ম মেকানিক্যাল কোর্সে অনেক দরিদ্র শিক্ষার্থী এখানে ভর্তি হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এসব শিক্ষার্থীদের থাকা খাওয়াসহ সিংহভাগ খরচ মটস বহন করে। দরিদ্র এবং যোগ্য ছাত্রদের স্পনসরশিপ প্রদানের জন্য মটস কর্তৃপক্ষ (নিজেদের বন্ধু এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের সাথে) যোগাযোগ করে। স্পনসরশিপ প্রাপ্তদের তিনবছরের দীর্ঘমেয়াদী মেকানিক্যাল কোর্স (এল টি এম সি) এবং চার বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে স্বল্পমূল্যে প্রযুক্তিগত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিভিন্ন এনজিও এবং প্রাইভেট সেক্টরের চাহিদার ভিত্তিতে চার থেকে ছয় সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত কোর্স চালু করা হয়। ক্রমান্বয়ে শর্ট কোর্সের চাহিদা বাড়তে থাকে এবং গত ৪২ বছরে প্রশিক্ষণ কোর্সের ৭৭টি ট্রেডে মডিওলার-শর্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। দেশ ও বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার চাহিদার ভিত্তিতে এক থেকে চৌদ্দ সপ্তাহের মেয়াদ কোর্স চালু করা হয়। বিশটি ট্রেডে শর্ট কোর্স, কাস্টমাইজড কোর্স এবং ইংলিশ, জাপানিজ, কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কোর্স মটস প্রশিক্ষণ সমূহের অন্তর্ভুক্ত।
দেশে আন্তর্জাতিক মানের দক্ষ জনশক্তি তৈরীতে মটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি-এর শিক্ষক-প্রশিক্ষক, শিক্ষার্থী, পরিচালক এবং কর্মীবৃন্দ; ট্রাস্টিবোর্ডের সকল সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলে অধিকতর সততা ও নিষ্ঠার সাথে প্রতিনিয়ত কাজ করছেন। বিশেষ করে বর্তমান পরিচালক অধ্যক্ষ জেমস গোমেজ উল্লেখযোগ্য পরিচালনা দক্ষতায় এটিকে আরো এগিয়ে নিতে বদ্ধ পরিকর, যা সত্যিই প্রশংসনীয় । কারণ দেশের উত্তরোত্তর অর্থনৈতিক উন্নয়নে মটস এর ভূমিকা অপরিহার্য ।
কার্ডিনাল প্যাট্রিক ডি রোজারিও সি এস সি, আর্চবিশপ ইমেরিটাস অব ঢাকা-এর প্রাণের স্বপ্ন -এই প্রতিষ্ঠানটি একদিন ঢাকার নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গীভূত হয়ে খুবই উচ্চমানের ডিগ্রী প্রদান করতে সক্ষম হবে । সুবর্ণ জয়ন্তী পালন উৎসবে শুভেচ্ছা বাণীতে তিনি আরো বলেন: “জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনুসারে যে নীতি ও বিষয়গুলো মটস এর ট্রেনিং ও প্রশিক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে তা হল:- জাতি ধর্ম বর্ণ শ্রেণি নির্বিশেষে ‘মানবিক ভ্রাতৃত্ব ‘ গঠনে শিক্ষা, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা, পিছিয়ে পড়া ছেলে মেয়েদের অগ্রাধিকার, শিক্ষার্থীদের দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, আত্মকর্মসংস্থান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার, সৃজনমুখী এবং প্রয়োগমুখী উৎপাদন সহায়ক শিক্ষা ইত্যাদি। আজ বাংলাদেশ কাথলিক চার্চ ও কারিতাস বাংলাদেশ সত্যিই পরম করুণাময়কে অশেষ ধন্যবাদ জানাতে পারে নির্দ্বিধায় ।”
কৃষি, প্রযুক্তি ও কারিগরী বিষয়ে জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি মানবীয় গুণাবলী বিকাশে ইতিবাচক চর্চাকে মটস সদা সর্বদা উৎসাহিত করে। এখানে পুঁথিগত বিদ্যার পাশাপাশি খেলাধুলা তথা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, দেয়ালিকা (পত্রিকা) প্রকাশ, ফুল ও সবজি বাগান করা, পরিবার দিবস উদযাপন, শারদ্বীয় দুর্গোৎসব এর শুভেচ্ছা বিনিময়, ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়, বড় দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠান পালন করা হয়।
এছাড়া মটস -এ জাতীয় দিবসগুলো উদযাপন করা হয়,- অত্যন্ত সুন্দর ও পরিপাটি পরিকল্পনায় । নবীন বরণ, বর্ষবরণ, নারী দিবস, কারিতাস দিবস, কারিগরী সপ্তাহ এবং শিক্ষক দিবস পালনের পাশাপাশি এটি বিভিন্ন প্রজেক্ট ফেয়ার-এ অংশগ্রহণ করে। এখানে বিশ্ব যুব দক্ষতা দিবস ও উদযাপন করা হয়। এর আরও চমৎকার প্রোগ্রাম হল সনদ বিতরণ অনুষ্ঠান। মটস ক্যাম্পাসে লাইব্রেরীসহ অনেকগুলো ল্যাব এবং মটস তৈরিকৃত অনেক পণ্য সামগ্রী ও মেশিন বা যন্ত্র রয়েছে । সেগুলো দেশে-বিদেশে চাহিদা মোতাবেক উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
বর্তমান পরিচালকের ভাষায়: ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যখন বাংলাদেশী শ্রমিকদের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছিল তখন মটস বিদেশী বিভিন্ন কোম্পানীর চাহিদার ভিত্তিতে কোর্স কারিকুলাম প্রস্তুত করে প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরী করার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল যা বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের গন্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপ আমেরিকা পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বহিবির্শ্বে দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে এ প্রশিক্ষণের চাহিদা ও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিদেশী কোম্পানীর ডেলিগেটগণ এখন বিভিন্ন এজেন্সীর মাধ্যমে সরাসরি মটস -এ চলে আসছেন, তাত্তি¡ক ও ব্যবহারিক ইন্টারভিউ নিচ্ছেন এবং নিয়োগ দিচ্ছেন । যার মাধ্যমে মটস এর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। মেধাবী যুবক যুবতীর দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমের সফল বাস্তবায়নের ফলে মটস বর্তমানে দেশের সকল বেসরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট গুলোর মধ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে। এ ধারাবাহিকতায় আগামী দিনের পথ চলায় মটস আরও দক্ষতার সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে উচ্চতর কারিগরী শিক্ষা স¤প্রসারণ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলবে এবং অধিক উৎপাদনের মাধ্যমে উন্নত দেশ গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে ।
পল্লবী মেট্রোরেল স্টেশনের নিকটবর্তী মটস -এর দেয়ালে লিখিত উদ্দীপনামূলক শ্লোগান সদৃশ ছন্দময় বাণী এবং মনীষা প্রমুখ গণের চিরায়ত বাণীগুলো পড়লে মটসের ভিতরের মনোমুগ্ধকর বিশাল ক্যাম্পাসের নানাবিধ কার্যক্রম ও মহৎ মানবিক জীবন গঠন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় । আবার ক্যাম্পাসের ভিতরে ও দুখী মানুষের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ বাণী দেখে মটসের মানবিকতায় আমরা মুগ্ধ হয়ে দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসায় আবেগাপ্লæত হই ।
সবশেষে সুবর্ণ জয়ন্তীর থিম সং এর কয়েকটি লাইন উল্লেখ করে আমি লেখাটি শেষ করছি/যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ/ মানসম্মত উৎপাদন/ জীবন জীবিকার দিশা দিয়ে/ জাগিয়ে দিয়েছো প্রাণ / আছে বিশ্বাস ভালোবাসা মিলন – আনন্দ মহোৎসবে / আছে গৌরব, দিগ্বিজয়ী হাসি / মটসের আছে অবদান, আছে সুনাম/……/
তথ্য ঋণ:-
মটস সুবর্ণ জয়ন্তী ‘স্মরণিকা’-২০২৩।
মটস প্রসপেকটাস।
ঢাকা মিরপুর মটসের পরিচালকের সাথে সাক্ষাৎ এবং ক্যাম্পাস পরিদর্শন, ১৩ থেকে ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম