মা মা-ই। মা থাকুক শ্রদ্ধা সম্মান ভালোবাসায়

6

বাবুল কান্তি দাশ

মা বলতে আমরা বুঝি নিখাদ নিঃস্বার্থ ভালবাসা, যা জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবার জন্য সবার কাছে। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। যদিও মাকে ভালোবাসা-শ্রদ্ধা জানানোর কোনো দিনক্ষণ ঠিক করে হয় না- তবুও মাকে গভীর মমতায় স্মরণ করার দিন আজ। মাতৃদিবসের মূল আখ্যান রোম থেকে এলেও সারা বিশ্বেই এই দিনটা সমান জনপ্রিয়। যিশুখ্রিস্টের জন্ম হতে তখনও ২৫০ বছর বাকি। সেই সময় রোমের অধিবাসীরা দেবী হিলারিয়াকে সম্মান জানাতে মাতৃ দিবসের প্রচলন শুরু করেন। তার পর সাত সমুদ্র তেরো নদী দিয়ে গ্যালন গ্যালন পানি বয়ে গিয়েছে। যিশুখ্রিস্ট ক্রুশ বিদ্ধ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার পর মা মেরিকে স্মরণ করে শুরু হল মাদারিং সানডে। সেও অনেক কাল আগের ঘটনা। সীমাবদ্ধ ছিল নির্দিষ্ট জায়গায়। বর্তমান ধারণার মাতৃদিবস শুরু হয় ১৯০৮ সালে। আমেরিকায় শান্তি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আন্না জার্ভিস মায়ের জন্যে গোটা একটা দিন বরাদ্দ করার দাবি তোলেন। অ্যানা জার্ভিস আমেরিকাবাসীর কাছে আবেদন করেন রোজ সম্ভব না হলেও মাদার্স ডে-তে অন্তত ছেলে মেয়েরা যেন মায়ের জন্য হাতে লেখা একটা চিঠি আর উপহার দেন। তার পর থেকে বিশ্ব জুড়ে মাতৃদিবস পালন করা হয় হইহই করে। মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্বের ৪৬ টি দেশের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশ বাংলাদেশেও মাতৃদিবসের উৎসবে মেতে উঠেছি। মা, মাত্র একটি অক্ষরে শব্দটি গঠিত হলেও এর ব্যাপকতা সাগরের চেয়েও বিশাল। সত্যি বলতে পৃথিবীতে কোনো মহা মানবের কোনো উপমা জানা নাই মায়ের আদর, ভালবাসা, স্নেহ-প্রীতি সংজ্ঞায়িত করার। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মা হচ্ছেন জগজ্জননী। তার চেয়ে শান্তির ঠিকানা আর কোথাও নেই। ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিং বলেছেন, ‘মাতৃত্বেই সব মায়া-মমতা ও ভালোবাসার শুরু এবং শেষ।’ সনাতন ধর্মে মাকে স্বর্গের থেকেও বড়, মহান ও পবিত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইসলাম ধর্মের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত। ‘মা’ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে মুঠো ভরা স্নেহ মমতা আর অকৃত্রিম ভালোবাসা।
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই মা, মায়ের বৈশিষ্ট্য আর ভালোবাসা কখনো বদলায় না। জীবনের পুরোটাই সন্তানের জন্য উৎসর্গ করে যান। মায়ের গভীর মমতার কথা আর তাঁর প্রতি সন্তানের দায়িত্ব কর্তব্য স্মরণ করে দিতেই বুঝি প্রতি বছর আসে এই ‘মা’ দিবস। আজকের এই দিনে বিশ্বের সকল মাকে জানাই আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও প্রণাম। কবিগুরুর কথায় বলি- ‘বড়ো আশা করে এসেছি গো, কাছে ডেকে লও, ফিরায়ো না জননী। দীনহীনে কেহ চাহে না, তুমি তারে রাখিবে জানি গো। আর আমি-যে কিছু চাহি নে, চরণতলে বসে থাকিব।’ মা হচ্ছে মহাশক্তির আধার। পরিবার সমাজ রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির উদ্গাতা। মা মানে মেপে দেওয়া। মা যা করে দেয় তাই নিয়েই সব কেরামতি। প্রত্যেকটি মা চায় যে তার ছেলে সুখী হোক, সুস্থ হোক, সুদীর্ঘজীবী হোক, কৃতী হোক, ভাল হোক। কিন্তু গোড়া কেটে আগায় জল ঢাললে কি হবে? তার মানে হলো মাতৃশক্তির অমর্যাদা, অবমাননা কখনো কোনোকালে শুভ ফল বয়ে আনেনি আনবেও না। সন্তান জন্মদানের পূর্বে এবং তৎপরবর্তীকালে নারীশক্তির যেকোনো অমর্যাদা সন্তানে বর্তায়। ভাইরাসের মতো সংক্রমিত হয়। কারণ, জন্মের পূর্বেই তো একটা জীবনের বেশীরভাগ রচিত হয়ে যায়। যে শরীর মন নিয়ে সে জন্মায় তার উপর দাঁড়িয়েই তো তার চলা। আবার জন্মের পরে যেমন- যেমন করে সন্তানকে সুগঠিত করে তুলতে হয় কজন মা-বাপই বা তার ধার ধারে ? ফলে ছেলেপেলেদের নিয়েই কত কষ্ট পায় আর অদৃষ্টকে ধিক্কার দেয়। অথচ নিজেদের যা করণীয় তা করে না। চলনাও শুধরায় না। তাই সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশে মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। মা হওয়া কি মুখের কথা! সত্যিই তাই। বাস্তব যেন আরও রূঢ়। মা চিরন্তন ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতীক। সন্তানের চারপাশেই তাঁর সময় কাটবে, এমনটাই যেন স্বাভাবিক। সন্তানের সঙ্গে সময় কাটাতে ভাল লাগছে না, এটুকু কথা বলতে পারা যেন অপরাধের শামিল। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না মা সম্পূর্ণ আলাদা একজন মানুষ। রোজ সন্তান-সংসার, কর্মজগতের দোলাচলে নিঃশব্দেই কত হতাশা-অবসাদের সঙ্গে লড়ে যেতে হয় মায়েদের। তাঁদের খেয়াল কি আমরা করি। কতো ত্যাগ সেবা সন্তান ও পরিবারের জন্য। কী নিঃস্বার্থ ভালোবাসা প্রতিটি পদে পদে। তার কতটুকুই মূল্য আমরা দিই! তার খেয়ালই রাখি বা কয়জনে! কিন্তু মা যে সর্বংসহা নন। তাঁরও একটু স্বস্তির কোণ দরকার। তার জন্য অবশ্য পরিবার-পরিজনের সাহায্যও দরকার। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে প্রভূত সমস্যা। সমস্যাটা কোথায়? ‘সমস্যাটা আসলে বৃহত্তর। আমাদের সমাজ, জীবনদর্শন ও পরিস্থিতি সবই এর জন্য মূলত দায়ী। এখন বেশির ভাগ পরিবারই নিউক্লিয়ার। যৌথ পরিবারে একটা সুবিধে ছিল, সন্তান সকলের মধ্যে বড় হত। মায়েদের উপরে অতটা চাপ তৈরি হত না। সে হয়তো সংসারের কাজে ব্যস্ত, সন্তান তখন কাকা-পিসি বা তুতো ভাই-বোনের সঙ্গে খেলত। কিন্তু নিউক্লিয়ার পরিবারে মা বাড়িতে থাকলে তার পুরো সময়টাই সন্তানকে দিতে হয়।’ ওয়ার্ক ফ্রম হোম যাঁরা করেন, তাঁরা কাজ-সন্তান-সংসারের ‘বারমুডা ট্রায়াঙ্গল’- এ পড়ে যান। আর হোমমেকাররা সংসার আর সন্তান নিয়ে একে নাজেহাল, তার উপরে কারও কারও আইডেন্টিটি ক্রাইসিস সঙ্গী হয়। আরও একটি সমস্যা, সেটা হল সন্তানের কাছ থেকে মায়েদের আশা-প্রত্যাশাও মায়েদের হতাশার আরও এক কারণ। নিজের সবটুকু দিয়ে সন্তানকে মনের মতো গড়তে চান প্রত্যেক মা-ই। হয়তো গান শেখালেন বা নাচ। কিন্তু সন্তান একটু বড় হতেই তার পছন্দ হয়তো বদলে গেল। তখন মায়ের মনে হয়, এত পরিশ্রম করে, টাকা খরচ করে এত কিছু করানোর এই ফল? তার থেকেও হতাশা দানা বাঁধে। সন্তানরা কেমন তৈরি হল, তাদের সাফল্য বা ব্যর্থতা দিয়ে অনেক সময়ে মায়েদের মূল্যায়ন করা হয়। এখনও আমাদের সমাজে ছেলেমেয়ে দোষ করলে মাকেই কথা শুনতে হয়। ফলে মানসিক চাপ তৈরি হয়। তার সঙ্গে নিজের কাজ ব্যালান্স করার দায়িত্ব থাকে। এই ব্যালান্স করাটা তখনই সম্ভব যদি বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কিছু দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া যায়। আমরা যেন মায়েদের একটু অবসর আর যতœ চাই। তাঁরাও যে রক্ত মাংসের শরীরে গড়া সেটা যেন ভুলে না যাই। মায়েরাও যে মানুষ। তাদেরও কষ্টবোধ থাকে। সন্তানের নামে কেউ কিছু বললে বা কর্মক্ষেত্রে কেউ ভুল ধরিয়ে দিলে সাঙ্ঘাতিক অবসাদ গ্রাস করে। চট করে মাথা গরম হয়ে যায়, অনেকে আবার ভেঙে পড়েন। তখন সন্তানের উপরে গিয়ে রাগ পড়ে। তাই সে সময়ে নিজেকে সেখান থেকে সরিয়ে আনা জরুরি। অনেক মা-ই ভাবেন, ‘সন্তানকে আমার মতো করে কেউ খাওয়াতে পারবে না’ ইত্যাদি। এই চিন্তাকে প্রশ্রয় দেবেন না। ওকে স্বাবলম্বী হতে শেখান। ওর কাজগুলো দরকার হলে স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিন। তাতে আপনিও সময় পাবেন, সন্তানও স্বনির্ভর হবে। অফিসের সব কাজ হাতে নিয়ে অনেকে বসে থাকেন। ‘না’ বলতে পারেন না। এ দিকে বাড়ির সমস্যার মাঝে সে কাজও সামলে উঠতে পারেন না। এতে চাপ তৈরি হয় নিজের উপরেই। তাই যতটুকু আপনার সাধ্য সেটুকুই করুন। অহেতুক নিজের উপরে চাপ সৃষ্টি করবেন না। হোমমেকাররা যেহেতু অধিকাংশ সময়ে বাড়িতে থাকেন, সংসারের সব দায়িত্ব তাঁদের। তাঁরা যদি নিজের জন্য সময় চান, তাতেও জবাবদিহি করতে হয়। অনেক সময়ে সেটুকুও তাঁরা পান না।’ তাই অল্প কিছু হলেও নিজের শখ-আহ্লাদ বজায় রাখতে হবে। মায়েদের বয়সটাও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মেনোপজের সময়ে মেয়েদের এমনিতেই হরমোনাল পরিবর্তন দেখা যায়, যা থেকে মুড সুয়িং, ডিপ্রেশন দেখা দিতে পারে। তার সঙ্গে যদি সন্তানের ব্যর্থতা যোগ হয়, তা হলে হতাশা বেড়ে যায়। হয়তো ছোট সন্তানের জন্য মা চাকরি ছেড়েছেন। বছর বারো ঘুরতেই সন্তানের নিজের জগৎ তৈরি হয়ে যায়। এ দিকে মাঝবয়সে পৌঁছে তখন মা-ও নিজের কেরিয়ার শুরু করতে পারছেন না। তখন সব দিক থেকে ক্লান্ত লাগে, অর্থহীন মনে হয় সব কিছু। তাই নিজের জগৎ তৈরি করতে হবে। সন্তান এবং মা যে দুটো আলাদা মানুষ, সেটা গোড়া থেকেই স্পষ্ট করা জরুরি। সংসারের কাজ হোক বা সন্তানের বা অফিসের, সেগুলো সবই কাজ। আপনার অবসর আপনাকেই বার করতে হবে। সে সময়টা নিজের মতো কাটান। কাছের বন্ধুর সঙ্গে সময় কাটালেও মন ভাল থাকে। বন্ধুর সময় না থাকলে একটা সিনেমা দেখলেন বা বই পড়লেন। মনে রাখবেন সব দিকে ভারসাম্য রাখতে না পারলেও ক্ষতি নেই। ৩৬৫ দিন ব্যালান্স করা সহজ নয়, সম্ভবও নয়। মা মানেই সুপারউওম্যান নয়, সে-ও মানুষ। পরিস্থিতি অনুযায়ী প্রত্যেক দিনের প্রায়োরিটি ঠিক করুন। কোনটা সে দিন বেশি জরুরি, সে দিকে মন দিন। বাকি দিকে কী হচ্ছে তা নিয়ে ভেবে লাভ নেই। তেমনই একটা দিন যদি নিজের জন্য রাখা জরুরি মনে হয়, তা-ই রাখুন। তার জন্য অপরাধবোধে ভুগবেন না, জবাবদিহিও করবেন না। রোজরুটিন থেকে মায়েদেরও ছুটি দরকার। একটু সুখাবসর না হয় উপহার দিলেন নিজেকে। এতোকিছুর পরও মা যখন সন্তান স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে একটু সহানুভূতি না পায় তার থেকে দুঃখজনক আর কি হতে পারে! কোনো কোনো ক্ষেত্রে মায়ের প্রতি অনাদর অবহেলা ভীষণ পীড়াদায়ক হয়ে উঠে। যা সন্তান বা পরিবারের কারো উচিত নয়। মায়ের প্রতি অনাদর অবহেলা সন্তানের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। প্রতিটি সন্তানের মনে যেন থাকে মা কিন্তু শুধুই স্নেহময়ী জননী নন, পথপ্রদর্শক, গুরুও। শত দুঃখ কষ্ট অনাদর অবহেলার মাঝেও মায়ের প্রার্থনা থাকে তাঁর সন্তানরা আদর্শ জীবন যাপন করুক, পরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাক। মা মা-ই। মা’কে রাখি শ্রদ্ধা সম্মান আর ভালোবাসায়।
লেখক: প্রাবন্ধিক