মালয়েশিয়ায় ‘ছোট কাজ’ পাওয়াও বড় চ্যালেঞ্জ

3

রাহুল দাশ নয়ন, মালয়েশিয়া থেকে ফিরে

৬-৮ লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়ে অনেকেই পড়েছেন বিপদে। কাজ না পেয়ে বেকার ঘুরছে পথেঘাটে। শ্রমিকদের কাছে ছোট কাজ পাওয়াও যেন বড় চ্যালেঞ্জ। কোম্পানির অধীনে গিয়েও কাজ না পেয়ে অনেকেই পার করছেন দূর্বিসহ জীবন। কেউ কেউ আগে যাওয়া আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে থেকে কাজ জোগাড়ের চেষ্টা করছেন। কাজের সন্ধানে কুয়ালালামপুর ছেড়ে শ্রমিকরা ছুটছেন নানা শহরে। বাংলাদেশি শ্রমিকদের সেখানে কাজ পাওয়া যেন সোনার হরিণ।
এদিকে সম্প্রতি কলিং ভিসায় যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিক এখনো কাজে যোগ দিতে পারেনি। চাহিদার চেয়ে বেশি মানুষ যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। গত আটদিন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ল্যাংকাউই শহর ঘুরে এমন তথ্য মিলেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক কুলি, ট্রলিম্যান ও সুইপারের কাজ করছে। যাদের বেতন ১২০০-১৭০০ রিঙ্গিত। অল্পবেতন হলেও প্রবাসে একটি চাকরি জোগাড় করতে পেরেই অনেকে সন্তুষ্ট। বাইরে হোটেল, রেস্টুরেন্টে কাজ করছে শ্রমিকরা। মালয়েশিয়ায় দোকান ও কনস্ট্রাকশন কাজের শ্রমিকদের চাহিদা বেশি। যারাই এমন কাজ পেয়েছেন তারা ভালোই আছেন। পাকিস্তানি ও ভারতীয় রেস্টুরেন্টে বেশি বাংলাদেশি কাজ করেন। চায়না টাউন মার্কেটে ঝুপড়ি দোকান দিয়েছেন অনেক বাংলাদেশি।
শ্রমিকরা জানান, গত এক বছরে বৈধ-অবৈধভাবে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়ায় ঢুকেছে। এদের বেশিরভাগই এখনো কাজ জোগাড় করতে পারেনি। ইতোমধ্যে শ্রমিক আনা অনেক কোম্পানি লাপাত্তা হয়ে গেছে। কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে। শ্রমিকদের বেকার ঘুরার সুযোগ কাজে লাগিয়ে অল্প বেতনে নিম্নমানের চাকরি দেয়া হচ্ছে। সুইপার, রেস্টুরেন্টের ওয়েটারসহ নানা কাজে যোগ দিতে বাধ্য হচ্ছেন শ্রমিকরা।
তবে সব শ্রমিক যে খারাপ আছে এমনটা নয়। অনেক শ্রমিক ভালো বেতনে চাকরি করে স্বাবলম্বি হয়েছেন। সম্প্রতি শ্রমিকদের মালয়েশিয়া যাওয়ার যে প্রবণতা এতে সফল হওয়ার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারি বেশি। কুয়ালালামপুর, ল্যাংকাউই ও পেনাং নগরীতে বাংলাদেশি বেশি।
টেকনাফের বাসিন্দা রাশেদুল আমীন। গত ১৬ বছর ধরেই ল্যাংকাউই শহরের স্কাইডক পর্যটন স্পটে গাড়ি পরিচালনার সাথে যুক্ত আছেন। তিনি বলেন, ‘সবাই তো সফল হতে পারে না। আমি দীর্ঘদিন ধরে মালয়েশিয়ায় থেকে মাস শেষে বাংলাদেশি টাকায় এক লক্ষ টাকা আয় করতে পারি না। তবুও এখন যারা আসছেন তাদের কষ্টের জীবন দেখলে আমি মনে করি সফল’।
একই শহরের পানতাই সেনাং এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টে কাজ করা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসিন্দা রিদুয়ান হাসান বলেন, ‘এখানে কাজ পাওয়া কঠিন। এক বছর আগে মালয়েশিয়া এসেছি। কুয়ালালামপুরে কোনো কাজ না পেয়ে ল্যাংকাউই চলে আসি। সাত মাস বেকার থেকে পাঁচ মাস আগে কাজে যোগ দিয়েছি। এই সময়ে বাড়ি থেকে উল্টো টাকা আনতে হয়েছে’।
কক্সবাজারের মহেশখালীর ধলঘাট এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে মালয়েশিয়া এসেছি। কথা ছিল কনস্ট্রাকশনের কাজ করবো। করতে হচ্ছে রেস্টুরেন্টের কাজ। ১২ ঘন্টা দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হয়। ছয় লক্ষ টাকা দিয়ে দালালের মাধ্যমে এখানে এসেছি। ১৫০০ রিঙ্গিতে (৩৭ হাজার ৫০০ টাকা) কাজ করছি। একবেলা খাওয়ার ফ্রি, রুমভাড়া নিজ থেকে দিতে হয়। বেতনের ৩০০ রিঙ্গিত রুম ভাড়াতেই চলে যায়। অনেক কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে’।
কুয়ালালামপুরে স্পোর্টস দোকানে চাকরি করেন আরমান ইকবাল। তিনি বলেন, ‘১৬ বছর ধরে একই জায়গাতেই কাজ করছি। মালিক ভালো আছে। যে কারনে আমি ভালোভাবেই চাকরি করতে পারছি। নিয়মিত বেতন দেন। প্রতিমাসে লাখ টাকার মতো আয় করছি’।
টুইন টাওয়ার এলাকায় কেএলসিসিতে রেস্টুরেন্ট কাজ করা আকরাম বলেন, ‘দশ বছরের চাকরি জীবনে পাঁচ বছর খুব কষ্টে দিন কাটিয়েছি। জুসের দোকানে চাকরি করেছি। এখন আমি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত (১ লক্ষ ৩৭ হাজার টাকা) চাকরি করছি। ভালোই আছি। আমার আরও এক ভাইকে এনেছি। সেও ভালো চাকরি করছে। বর্তমান সময়ে যারা দ্রæত চাকরি পাচ্ছে তারা কিছুটা চলতে পারছে। আর যারা চাকরি পাচ্ছে না তাদের জীবন কাটছে কষ্টে’।
এমন কষ্ট স্বত্তে¡ও দেশ বিমুখ হয়ে অনেকেই প্রবাসে রয়ে যাচ্ছেন। তাদেরই একজন কুমিল্লার বৃদ্ধ সাহাব উদ্দিন। চায়না টাউন মার্কেট এলাকায় ইলেক্ট্রিক ও মিস্ত্রি’র কাজ করেন। তিনি বলেন, ‘দুই ছেলে এক মেয়েকে এখানে চাকরি করেই মানুষ করেছি। ভালো চাকরি করছি। বাপের এক সন্তান হয়েও আজকে ৩০ বছর বিদেশে। জায়গা সম্পত্তিও আছে। তবুও প্রবাস ছেড়ে দেশে থাকতে ইচ্ছে করে না। যা আয় করি সব দেশে পাঠিয়ে দিই। সেখানে থাকলে মানুষের সাথে ঝগড়া হয়, বিরোধ হয়। এগুলো ছেড়ে এখানেই ভালো আছি’।
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ট্রলিম্যানের চাকরি করা আবু সাঈদ বলেন, ‘টিউমার কোম্পানি এনে কাজ ছাড়া প্রায় ৫ মাস রেখেছে। পরে সে কোম্পানির বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। মালয়েশিয়া সরকার এই কোম্পানিকে বাতিল করেছে। এখন আমরা এটুডব্লিউ নামে একটি কোম্পানীর অধীনে বিমানবন্দরে কাজ করছি’।