মানবকল্যাণ হোক মানব চরিত্রের উত্তম বৈশিষ্ট্য

4

বাবুল কান্তি দাশ

‘পড়শীরা তোর নিপাত যাবে তুই বেঁচে সুখ খাবি বুঝি ? যা ছুটে যা, তাদের বাঁচা—- তারাই যে তোর বাঁচার পুঁজি।’ এই হচ্ছে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের ধর্ম এবং কর্ম। মানব চরিত্রে এর ব্যতয়ে মানুষ কিন্তু মানুষে থাকে না। তার মধ্যে আশ্রয় নেয় কুপ্রবৃত্তি সঞ্জাত পাশবিক চরিত্র। মানব কল্যাণে মানুষের জীবন। জীবনের কল্যাণে নিবেদন গুণই মানুষের মানবিকতা। মানুষ মানুষের উপকার করতে পারে হৃদয়ের ভালবাসা দিয়ে। একমাত্র মনের ভাব প্রকাশ করার মধুর বাক্য মানুষেরই রয়েছে। মানুষের মানবিক গুণাবলী দিয়ে পৃথিবী জয় করতে পারে অতি সহজে। মানুষের প্রতিটি বাক্যে আচরণে রয়েছে এহেন গুণাবলী। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব আজ এই চরিত্র থেকে অনেকাংশে দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমাগত। আজকের পৃথিবীতে চারিদিকে মানুষের কাজ ও ব্যবহার এত অ-মানবিক যে, মনে হয়, যে গুণে মানুষ নিজেকে মানুষ বলতে পারে, তারা আজ বিপন্ন। মানুষের মানবিক সত্তা ক্রমক্ষীয়মাণ, বিশেষত ক্ষমতাবান লোকেদের মধ্যে— যা চুইয়ে আসছে সাধারণ্যেও। আজ মানবতার সারস্বত চর্চা যতটুকু, চর্যা তার এতটুকুও নয়। অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছেন মানুষের মরণ আমাকে বড় আঘাত করে না, করে মনুষ্যত্বের মরণ দেখিলে। মানবিক মূল্যবোধ, মানবিকতা মানুষের চরিত্র থেকে ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে । মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মানব চরিত্রের যে শ্রেষ্ঠতম বৈশিষ্ট্য তা আজ হিংসা বিদ্বেষের তমসাচ্ছন্ন চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। মনে হয়, মানুষ নামের প্রজাতিটি সম্ভবত গুরুমস্তিষ্কের এমন এক বিবর্তনের পথে চলেছে, যেখানে রিপুর প্রাবল্য মহতী আবেগকে নিষ্ক্রিয় করে হিংস্রতার পথে ধাবমান। প্রাগিতিহাস বলে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে মানুষ-পূর্ব মানব-প্রজাতি নিয়েনডারথালের অন্তর্ধানের জন্য অন্যতম দায়ী মানুষই। অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির বলে মানুষ নিয়েনডারথালের সঙ্গে সহ-বাস করেও শুধু নিজের প্রতিদ্ব›দ্বী রাখবে না বলে তাদের শেষ করে দিল। সেই হিংস্রতার বীজ বাহিত হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছে বিপরীত মনের স্ব-প্রজাতিকে হত্যা করতে তার এতটুকু সঙ্কোচ হয়নি। শুধু যে অস্ত্রবলে সে শক্তিমান হয়ে উঠেছে তা নয়, খাদ্য ও জলের মতো দৈনন্দিন আবশ্যক প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত অভাব তৈরি করে, মানুষকে না খাইয়ে অপুষ্টির শিকার বানিয়েছে, মেরেছে পরোক্ষ ভাবে। মানুষের মধ্যে আসুরিক প্রবৃত্তির যে প্রবণতা আজকের সঞ্চয়োন্মাদ সমাজে ক্রমাগত তা বেড়েই চলেছে। নিজ নিজ স্বার্থ ব্যতিরেক অন্যকিছু ভাবা কেমনজানি স্বভাববিরুদ্ধ! চোখের সামনে পড়ে থাকা দুঃস্থ অসুস্থ লোক থেকে মুখ ফিরিয়ে সদর্ভে চলে যাচ্ছে নিজ স্বার্থ সিদ্ধির উদগ্র বাসনায়। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বেমালুম ভুলে যাচ্ছে মানবতা বিবর্জিত আজকের সভ্য সমাজ! সহযোগিতা সহভাগিতায় পথচলায় যে আনন্দ এবং মানবচরিত্রের সর্বোত্তম বৈশিষ্ট্য। পরিশীলিত পরিশুদ্ধ জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে মানুষের চরিত্রে যে দেবত্ব ভাব বিরাজমান তার প্রকাশই মানুষকে মহীয়ান ও গরীয়ান করে তুলে। তা’তেই নিহিত মানুষের মহত্ত¡। মানবকল্যাণ ব্যতিরেক এই মহত্ত্বে উন্নীত হওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে সেই মহামানবকে দেখেছিলেন, যার চৈতন্য আলোকের মতো মহাবিকিরণের দিকে চলেছে— জ্ঞানে কর্মে ভাবে। সেই প্রসারণেই তার মহত্ত¡। কিন্তু আজকের মানুষ চলেছে কোথায়! তথ্যসর্বস্ব জ্ঞান যত বাড়ছে, মন বিকশিত না হয়ে আত্মমগ্ন হচ্ছে, স্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। মানুষের চাহিদার শেষ নেই, অবশ্যই তা এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। কিন্তু ক্ষুদ্র আরামের মধ্যে জড়ত্বপ্রাপ্ত হয় বিবেক, মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। মানুষ আজ ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারী সহ-মানুষের শিকার, নির্দ্বিধায় হত্যায়ও যারা বিচলিত হয় না। মানবিক বোধের এই ক্রমবিলুপ্তই কি ভবিতব্য? অসহায় নিপীড়িত দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ভালোবাসা মথিত হৃদয়ে তাদেরকে যোগ্য করে তোলাই হোক আমাদের লক্ষ্য। মানবকল্যাণে নিজেকে যত সম্পৃক্ত রাখব ততবেশী ভালোবাসা জাগ্রত হবে। আর এই ভালোবাসায় সবকিছু জয় করা সম্ভব। যুদ্ধ সংঘাত এর মাধ্যমে আদায় হয়, জয় করা যায় না। জয় করতে প্রয়োজন ভালোবাসা। ভালবাসা কখনও দুর্ব্বল নয়। ভালবাসা কখনও আত্মরক্ষায় অপারগ নয়। ভালবাসার সঙ্গে থাকে প্রবল পরাক্রম। একটা গরু তার বাছুর কে ভালবাসে। সেই বাছুরের কোন ক্ষতি যদি কেউ করতে চাই, তাহলে কিন্তু সে তাকে ছেড়ে দেবে না। আবার, আমরা আমাদের ছেলেকে ভালবাসি বলে তাকে কি শাসন করি না ? যাকে ভালবাসা যায়, তার ভালর জন্যই মানুষ তার উপর কঠোর হয়। যে-ভালবাসা দুর্বলতার প্রশ্রয় দিতে জানে, অথচ প্রয়োজন মত শাসন করতে পারে না-সে ভালবাসা ক্লীবত্বদুষ্ট । অবশ্য, মানুষের নিয়ন্ত্রণের জন্য খানিকটা প্রশ্রয়ও সময়-সময় দিতে হয়, কিন্তু দুর্ব্বলতাজনিত প্রশ্রয় দান এবং নিয়ন্ত্রণী কৌশল-হিসাবে সচেতনভাবে মাত্রামত প্রশ্রয় দান-এই দুইয়ের মধ্যে তফাৎ আছে। আজ স্নেহ প্রীতি ভালোবাসার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে বলা যায় অন্ধ হয়ে প্রজন্মকে বরবাদ করে দিচ্ছি । অন্যের কৃষ্টি সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যকে ধার করে এনে তা যখন প্রয়োগে প্রবিষ্ট হব তখন ভাবনায় নিতে হবে তা আমার কৃষ্টি সংস্কৃতি বৈশিষ্ট্যের সাথে যায় কিনা । অন্যথায় একুল ওকুল দুকুল হারিয়ে হা-হুতাশ করতে হবে। আর যখন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটবে তখন হয়ত তা নিরাকরণ দুরূহ হয়ে উঠবে । সময়ের এক ফোঁড় অসময়ে দশ ফোঁড় না হয়ে ফোঁড় অসীম হয়ে উঠতে পারে! পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অনেক সময় অনেক কিছু এদিক সেদিক করতে হয় । দেখতে হয় সেই করাটা আমার বৈশিষ্ট্য ও অস্তিত্বের পক্ষে কতটুকু সহায়ক । এই ভাবনা না থাকলে কখনো কখনো তা সংহারমূর্তি ধারণ করে। একমুঠো ভালোবাসা নিয়ে আমরা যদি পারিপার্শ্বিকের পাশে দাঁড়াতে পারি তাহলে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অস্হির এই সমাজ হয়ে উঠবে প্রীতি ও আনন্দের আকর ভূমি।

লেখক : প্রাবন্ধিক