মহিলার জরায়ু স্থানচ্যুত নিরাময়ে হোমিওপ্যাথি

21

ডা. প্রধীর রঞ্জন নাথ

মহিলাদের জরায়ু সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ হতে পারে। ইহার মধ্যে জরায়ু নেমে আসা অন্যতম। রোগটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি বা একাধিক সন্তানের জন্মের জন্য হতে পারে। জরায়ুর প্রায় সবটাই যোনির মধ্যে ঝুলে থাকে।

জরায়ু নেমে আসার কারণ :
* গর্ভাধান, সন্তান প্রসব অথবা গর্ভপাত ইত্যাদি বশতঃ জরায়ু-ধারক বন্ধনী ও পেশীগুলো শিথিল হয়। প্রসব কিম্বা গর্ভপাতের পর জরায়ুর আকৃতি স্বাভাবিক (সাব ইনভলিউসান) হতে বিলম্ব ঘটলে জরায়ু-বন্ধনী ও পেশীগুলোর শিথিলতা দূর হতে বিলম্ব হয় এবং জরায়ু অধিকতর ভারী ও রিটোভার্টেড অবস্থায় থাকে। এমতাবস্থায় মলত্যাগকালে কুন্থন, কাশি, প্রসবের পর শীঘ্র শীঘ্র উঠে বসা ইত্যাদি কারণে জরায়ু নিচে নেমে আসে।
* জন্মগত কারণে হতে পারে। কখনো কখনো ব্লাডার নিচের দিকে নেমে আসে বলে তার সঙ্গে জরায়ুও নিচে নেমে যায়। আবার কখনো রেকটাম নিচের দিকে নেমে আসে এবং তৎসহ জরায়ু নিচের দিকে নেমে আসে।
* প্রসবকালে পেরিনিয়াম ছিন্ন হলে রোগের প্রবণতা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। উল্লেখিত কারণসমূহ ব্যতীত অর্ধেক পরিশ্রম, ভারোত্তোলন, অধিকক্ষণ উবু হয়ে বসা, লাফালাফি করা ইত্যাদি কারণেও জরায়ু স্থানচ্যুত হয়ে নিচে আসতে পারে। ভগ্নস্বাস্থ্য রোগিনীদের পেশীগুলোর সাধারণ দুর্বলতা ও শিথিলতা ঘটে থাকে বলে তাদের গর্ভধান প্রভৃতি না হলেও উপরোক্ত কারণাদিবশতঃ এই রোগ হতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে জরায়ু সহসা বহির্গত হয়ে পড়ে।
জরায়ু স্থানচ্যুত বা নেমে আসার প্রকারভেদ ঃ তিনটি ডিগ্রি বা ক্রমে এইরূপ স্থানচ্যুতি সংঘটিত হয়ে থাকে।
* প্রথম ডিগ্রী : ক্রমে জরায়ু তার পেশীসমূহের শিথিলতারবশতঃ নিম্নাভিমুখে ঝুঁকে যৌনিমধ্যে স্বাভাবিকাবস্থা অপেক্ষা কিঞ্চিৎ অধিক নিম্নে নেমে পড়ে।
*দ্বিতীয় ডিগ্রী : জরায়ুর অধিকাংশ যোনিমধ্যে প্রবেশ করে, এমনকি তার কতক অংশ যোনি হতে বহির্গত হয়েও পড়ে, এরূপ ক্ষেত্রে সচরাচর সুপ্রা-ভ্যাজাইনাল সার্ভিক্স দীর্ঘতর হয়।
*তৃতীয় ডিগ্রী : তৃতীয় ডিগ্রিতে সমগ্র জরায়ুটি যোনিপথে বর্হিগত হয়ে পড়ে। ইহাকে প্রেসিডেন্সিয়া বলে। এরূপক্ষেত্রে উরু ও বস্ত্রাদিসহ ঘর্ষণের ফলে জরায়ুর গাত্রে ক্ষতাদির উদ্ভব হয়। জরায়ু নিম্নাভিমুখে নামতে থাকলে তার আকর্ষণে মুত্রস্থলী, ডিম্বকোষ, ফ্যালোপিয়ান টিউব, যোনিগাত্র, অন্ত্র ও মলভান্ড প্রভৃতিও নিচের দিকে নেমে পড়ে।

ইহার লক্ষণ : জরায়ু স্থানচ্যুত সাধারণতঃ অতি ধীরে ধীরে সংঘটিত হয়ে থাকে। রোগীর পিঠে এবং কোমরে বেদনার লক্ষণ দেখা যায়। অনেক সময় প্রদাহ হয় এবং প্রদাহ বেশী হলে জ্বর হতে পারে। যদি জরায়ু অধিক পমিাণে নেমে আসে তবে পায়খানা প্রসাবে অসুবিধা হতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে পেলভিক ক্যাভিটিতে সেপটিক হতে পারে এবং এ থেকে ধীরে ধীরে ক্যানসার হতে পারে। ব্যথা দাঁড়াতে, চলতে ও ভারোত্তোলন করতে গেলে বৃদ্ধি পায় ও শয়নাবস্থায় হ্রাস পায়, পুনঃপুনঃ মুত্রবেগসহ মূত্রকৃচ্ছতা, এমন কি মূত্ররোধ, কখনো কখনো হাঁচিতে, কাসিতে, অসাড়ে মূত্রপাত, মলত্যাগে কষ্ট এবং ঋতুস্রাবের নানা প্রকার বিপর্যয় ও নানাবিধ মানসিক বিকারাদি প্রকাশ পায়। জরায়ু অধিক মাত্রায় নিচের দিকে নেমে আসলে সহবাসে অসুবিধা হতে পারে।

আনুষঙ্গিক চিকিৎসা ব্যবস্থা : রোগের কারণাদি সম্বন্ধে অবহিত হয়ে সাবধান হতে হবে। দিবারাত্রের মধ্যে যতদুর সম্ভব অধিকক্ষণ রোগিনীর শয়ন করে থাকা বিধেয়। জরায়ু অধিক নি¤েœ নেমে পড়লে রোগিনীকে কোমর উঁচু করে শয়ন করে সাবধানে জরায়ুটিকে ঠেলে স্বাভাবিক এন্টিভার্টেড অবস্থায় আনয়ন করে উপযুক্ত পেসারি ব্যবহার করতে হয়। এন্টিভার্টেড জরায়ুর পোল্যাপস হতে পারে না। উপরোক্ত ব্যবস্থাদিসহ উপযুক্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সর্বক্রমের পোল্যাপসাস নির্দোসরূপে আরোগ্য হয়ে থাকে। পেসারির সাহায্য গ্রহণের প্রয়োজন প্রায়ই হয় না।

হোমিওপ্যাথিক প্রতিবিধান : পোল্যাপসাস বা জরায়ু নেমে আসা প্রতিকারে হোমিওপ্যাথিতে ফলদায়ক ওষুধ আছে। নির্দিষ্ট মাত্রায় লক্ষণ সাদৃশ্যে নিম্নলিখিত ওষুধ ব্যবহারে এই রোগ আরোগ্য লাভ করে। যথাÑ
* বেলেডোনা : জনন ইন্দ্রিয়ে স্পর্শকাতরতার ভাব, মনে হয় যেন তলপেটের যাবতীয় পদার্থ বের হয়ে পড়বে। যোনিমুখে উত্তাপ এবং শুষ্কভাব। কুচকির চারিদিকে টান পড়ার মত অনুভূতি। নি¤œ অস্থিতে বেদনা। ভিতরে অসহ্য বেদনা।
* সিপিয়া : বস্তিকোটরের যন্ত্রসমূহ শিথিল, নিম্নদিকে ঠেলা মারা বেদনা, মনে হয় সবকিছুই বোধ হয় যোনিদ্ধার দিয়ে বের হয়ে আসবে ইত্যাদি লক্ষণে এই ওষুধ উপযোগী।
* কোনিয়াম : ঋতুস্রাবে অত্যন্ত কষ্ট অনুভব করা, উরুদেশে টেনে ধরার মত বেদনা। স্তনদ্বয় ঝুলে পড়ে। ঋতু¯্রাব বিলম্বিত এবং সামান্য ভগদেশ স্পর্শকাতর। জরায়ু মুখ এবং জরায়ু গ্রীবায় কঠিনতর ভাব। ডিম্বাশয় প্রদাহ, ডিম্বকোষ বর্ধিত এবং স্ফীত, কেটে ফেলার ন্যায় বেদনা। মুত্র ত্যাগের পর শ্বেত প্রদর।
* লিলিয়ামটিগ : জরায়ুর যে কোন প্রকার স্থানচ্যুতির লক্ষণে ইহা ব্যবহার করা যায়। বিশেষ করে রোগী যদি মনে করে যে পেটের সব কিছু যোনিপথ দিয়ে বেরিয়ে আসবে এবং এইজন্য রোগী হাত দিয়ে পেট চেপে রাখে বা পেটটি উপরে তুলে রাখতে চেষ্টা করে, বারবার প্রসাব ত্যাগের ইচ্ছা কিন্তু চলাফেরা না করলে প্রসাব বের হয় না, উচু নিচু স্থানে হাঁটতে না পারলে প্রস্রাবের বেগ হয় না ইত্যাদি লক্ষণে ইহা ব্যবহার করা যায়।
* অরাম মিউর ন্যাট : জরায়ু গ্রীবার কঠিনতা। বালিকাদের বুক ধড়ফড় করে। তলপেটের শীতলতা। পুরাতন জরায়ুর প্রদাহ, জরায়ু নির্গমন। জরায়ু ও যোনিমুখে ক্ষত। জরায়ুর আপেক্ষিক সংকোচনসহ প্রদর স্রাব।
* ক্রিয়োজোট : যোনিপথে ক্ষতকর চুলকানি, যোনি ওষ্ঠে জ্বালা পোড়াভাব এবং স্ফীতিভাব। ঋতুকালে কানে কম শোনে, কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ করে। ঋতুস্রাব থেমে থেমে হয়। ঋতুস্রাবের পর বেদনার বৃদ্ধি।
* গ্রাফাইটিস : কোষ্ঠকাঠিন্যসহ অনেক বিলম্বে ঋতু প্রকাশ, স্রাব ফ্যাকাশে এবং অল্প পরিমাণ, উর্ধউদরে ছিঁড়ে ফেলার ন্যায় ঋতুকালে স্বরভঙ্গ। ডিম্বেকোষ, জরায়ু ও স্তনদ্বয় স্ফীত তৎসহ পিঠের বেদনা।
* লাইকোপোডিয়াম : নিয়মিত সময়ের অনেক পর ঋতুস্রাব, দীর্ঘকাল স্থায়ী এবং প্রচুর। যোনিদ্বার শুস্ক, সঙ্গমকালে ব্যথা লাগে। ডান ডিম্বাশয় বেদনা। বাহ্য জনন ইন্দ্রিয়ের শিরা স্ফীত, যোনি পথে জ্বালা।
* হাইড্রাসটিস : জরায়ুর গ্রীবায় হাজাও ক্ষতবৎ। প্রদরস্রাব, অতিস্রাব। যোনি কপাটে চুলকানি তৎসহ প্রচুর প্রদরস্রাব, গণোরিয়া রোগযুক্ত।
* ফাক্সিনাস আমেরিকানাস : জরায়ু ভারী বোধ হয়, মনে হয় জরায়ু বের হয়ে আসবে, বেদনার অনুভব, অস্বস্তিবোধ ইত্যাদি লক্ষণে প্রযোজ্য। উপরোক্ত ওষুধ ছাড়াও ইগ্নেসিয়া, ল্যাকেসিস, নেট্রাম মিউর, প্ল্যাটিনা, সিকেলি, পডোফাইলাম, ক্যাল্ক কার্ব, সিনেসিও, স্ট্যানাম, পালসেটিলা উল্লেখযোগ্য। তারপরেও চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ সেবন করা উচিত।

লেখক : হোমিও চিকিৎসক ও প্রাবন্ধিক