মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর শান্তি ও সম্প্রীতির আদর্শে উজ্জীবিত হোক মানবতা

4

আজ ১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। ইসলামের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ও ঐতিহাসিক দিন। বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে এদিনটির রয়েছে আলাদা মাধুর্য, পবিত্রতা ও গাম্ভীর্য। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আওয়াল মাসের এ দিনে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবী মানবতার মুক্তির দিশারী, সকল মানুষের জন্য সর্বোত্তম চরিত্র ও আদর্শ হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন। মক্কার জমিনে সম্ভ্রান্ত কুরাইশ বংশের হাশেমিয় শাখায় আবদুল্লাহর ঔরশে মা আমিনার গর্ভে তিনি এ পৃথিবীতে আগমন করেন। পৃথিবীবাসীর জন্য দয়া, মানবতা, শান্তি, সাম্য, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক চিরন্তন বিধান নিয়ে মহানবী পৃথিবীতে আগমন করেন। মহান আল্লাহ প্রদত্ত অনন্য ও অদ্বিতীয় বহুমুখী গুণ আর ঐশী জ্ঞান দিয়ে তিনি দুনিয়াবাসীকে সঠিক পথের সন্ধান দেন। নবুয়াত প্রকাশের পর মাত্র ২৩ বছরে সকল পাপাচার, ব্যভিচার, বাতুলতা ও অসত্যের মূলোৎপাটন করেন তিনি। নবুয়াতের প্রকাশের পূর্ব থেকে জীবনের শেষ ক্ষণ পর্যন্ত মহানবীর সাধনা ছিল মানবতার কল্যাণ। যেজন্য তাঁকে পবিত্র কুরআনে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ অর্থাৎ আল্লাহর সকল সৃষ্টি জগতের করুণার আঁধার বলা হয়েছে। তিনি নিজ ধর্ম নয় শুধু, পৃথিবীর তাবৎ ধর্মাবলম্বীর কাছে সর্বশেষ নবী হিসাবে সর্বোচ্চ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। তাঁর কাছে ধর্মের বিধান যেমন গুরুত্ব এবং আবশ্যকীয় ছিল, তেমনি অন্য ধর্মের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা ও সমীহ ছিল অদ্বিতীয় দৃষ্টান্ত। পবিত্র মসজিদে নববীর এক কোণায় একদল খ্রিস্টানকে তিনি যেমন তাদের উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলে, অনুরূপ একদল ইহুদীকে মসজিদে নববীতে রাত কাটানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। সুযোগ দিয়েছিলেন ইহুদীদেরও। এসময় ইহুদীদের এক সদস্য মসজিদে মলমূত্র ত্যাগ করে রাতে পলায়নের পরও নবীজি তাদের ডেকে এনে ক্ষমা ও আতিথেয়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এছাড়া মদিনার সনদ, হুদায়বিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয় থেকে শুরু করে সকল যুদ্ধ বিগ্রহে অমুসলিমদের প্রতি, তাদের নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধদের প্রতি যে মানবিক আচরণের শিক্ষা দিয়েছিলেন তা আজও বিরল উদাহরণ। মহানবীর এসব উদাহরণের ফলে বিশ্ববাসী ইসলামকে সহজেই গ্রহণ করেছিলেন, ফলশ্রুতিতে স্বল্পসময়ে পুরো বিশ্ব ইসলামের করতলে এসেছিল। আজ দুঃখ ও লজ্জার সাথে আমাদের বলতে হয়, নবীজির আদর্শ ও শিক্ষা থেকে মুসলমানরা আজ অনেকটা বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। কথায় কথায় ধর্মের দোহায় দিয়ে সম্প্রীতি, শান্তি ও জাতীয় ঐক্য বিনষ্টের চেষ্টা করা হচ্ছে। ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। ইসলামের প্রচারক ও সুফিসাধকদের মাজারে হামলা হচ্ছে, অপরদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরেও চলছে আক্রমণ। যা ইসলামের শাশ্বত আহবান ও সৌন্দর্যকে বিনষ্ট করছে। আজ মুসলমানদের কাছে নতুন সময় ও দিনের শুভাগমন ঘটেছে। আজকের এ দিনে ইতিহাসের পাতায় আরো একবার চোখ বুলাতে হবে, দেখতে হবে মুসমলমানদের গৌরবজনক অধ্যায়, সোনালী দিনগুলো।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম মুসলিম প্রধান দেশ। ঐতিহাসিকভাবে মহানবীর বংশধর ও সুফিসাধকদের মাধ্যমে এদেশের মানুষ ইসলামে দীক্ষিত হয়েছে। ফলে এদেশের সিংহভাগ মানুষ সুন্নি মুসলমান। যাদের কাছে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব অন্যান্য যেকোন ধর্মীয় দিবস থেকে বেশি তাৎপর্যবহ। ফলে মহানবীর আগমন দিবস ১২ রবিউল আউয়াল আসলেই ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমান মহানবীর প্রতি ভালোবাসার সবটুকু উজার করেন। জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী মাহফিলসহ আলোচনা সভা, হামদ-নাত, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, ফাতেহা ইত্যাদির মাধ্যমে দিবসটি উদযাপন করেন। এবার তার ব্যত্যয় ঘটবে না। নানা আয়োজনে এ দিবসটি উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে ধর্মপ্রাণ মুসলমান। পাশাপাশি চট্টগ্রামে প্রতিবছরের ন্যায় অনুষ্ঠিত হবে জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এ জুলুসে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন ও জুলুসের আয়োজন কর্তৃপক্ষের সূত্রে জানা গেছে, এবার আয়োজনের ব্যাপ্তি না থাকলেও জুলুসে অংশগ্রহণকারী মানুষের সংখ্যাও বাড়েেব। তাদের ধারণা এবার পঞ্চাশ লাখের অধিক ধর্মপ্রাণ মানুষ জুলুছে অংশগ্রহণ করবে। আমরা আশা করি এতো ব্যাপক লোকের সমাগম যেন সুশৃঙ্খল হয় সেই ব্যাপারে প্রশাসন যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তি জীবনে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মতো আদর্শজন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যায় না। উক্ত আদর্শ এবং অনুরণীয় চরিত্রের অধিকারী প্রিয়নবীর কথা, কাজ এবং স্বীকৃতি মুসলমানদের জন্য সুন্নত হিসেবে পরিগণিত। একজন মুসলমানকে উত্তম হিসেবে পরিচয় দিতে হলে নবীর যাবতীয় কর্মকান্ড মেনে চলতে হবে। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, আল্লাহর ফেরেস্তারা মহানবীর উপর দরুদ পাঠ করেন মহানবীর নামে। এ পবিত্র নাম উচ্চারিত হবার সাথে সাথে মুসলমানদের দরদ পাঠ ওয়াজিব। পাঁচওয়াক্ত নামাজের মধ্যে মহানবীর দরুদ পাঠ বাধ্যতামূলক। প্রত্যেক মুসলমানকে নিজের জীবন, ধনদৌলত, মা-বাবা, সন্তান-সন্ততির চেয়ে মহানবীকে অধিক ভালোবাসতে হবে। নবীর প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা হলো আল্লাহর কোরআন নির্দেশিত আদেশ-নিষেধ মেনে চলে মহানবীর আচরিত বিষয়গুলোকে জীবনে বাস্তব রূপদান করা। অন্তরের ভালোবাসা এবং বাস্তবে তার প্রকাশই প্রকৃত নবী প্রেমিকের পরিচায়ক। ইসলামের আদর্শের বাস্তব রূপ দিয়েছেন মহানবী (সা.)। তাঁর সুন্নতসমূহকে জীবনে বাস্তবায়িত করতে একজন মুসলমান প্রকৃত নবীপ্রেমিক ও প্রকৃত সুন্নি হিসেবে নিজেকে বাস্তব জীবনযাত্রায় উপস্থাপন করে পারে। এদেশের মুসলমানদের মধ্যে প্রকৃত নবীপ্রেম তৈরি হোক এবং ইসলামের প্রকৃত অসা¤প্রদায়িক চেতনা ও সম্প্রীতির উন্মেষ ঘটুক- এটি সকলের প্রত্যাশা।