মরণফাঁদেও পরোয়া নেই

2

তুষার দেব

অত্যধিক অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে নগরীর বৃহৎ ও ব্যস্ততম শপিং মল বা বিপণিকেন্দ্রসহ বেশির ভাগ স্থাপনা। মরণফাঁদ জেনেও পরোয়া করছেন না সংশ্লিষ্ট ভবন-মালিক কিংবা ব্যবসায়ীরা। মৃত্যু-ঝুঁকি নিয়েই প্রতিদিন হাজার হাজার ক্রেতার সমাগম ঘটছে এসব বিপণিকেন্দ্রে। বাধা-বিপত্তি ছাড়াই চলছে বাণিজ্যিক ভবনের আবাসিক ব্যবহার। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ সতর্ক করার পরও ঝুঁকি এড়ানোর কোনও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। একপ্রকার ‘অনিবার্য পরিণতি’ মেনে নিয়েই এসব ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিনের কারবার চলছে। এছাড়া ঘনবসতিপূর্ণ বিভিন্ন এলাকায় মৃত্যু-ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছে সাধারণ মানুষ।
ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় বাণিজ্যিক স্থাপনা ও আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা গুদাম স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা লংঘন করেই শত শত কেমিক্যাল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান ও গুদাম গড়ে তোলা হয়েছে। নগরীর আছাদগঞ্জ, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, খাতুনগঞ্জ, আগ্রাবাদ সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক মার্কেটসহ বিভিন্ন ব্যস্ত এলাকায় টিনশেড ও ঘিঞ্জি পরিবেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন কেমিক্যাল এবং স্পিরিটের দোকান ও গুদাম। এসব দোকান ও গুদাম মালিকদের অনেকেরই অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। আবার যারা ছাড়পত্র সংগ্রহ করেছেন সেখানেও রয়েছে গোলমাল। অন্যের অগ্নি-নিরাপত্তা সরঞ্জাম প্রদর্শন করেই সংগ্রহ করা হয়েছে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র। কেউবা ছাড়পত্র নেয়ার পর সেটা আর নবায়ন করেননি।
জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান পূর্বদেশকে বলেন, প্রতিবছর অগ্নি-দুর্ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। তাই এবার আমরা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে বিভিন্ন স্থাপনায় বিদ্যমান অগ্নি-নির্বাপন ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করছি। পরিস্থিতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্টদের সতর্ক ও জরিমানা আরোপ করা হবে। অগ্নিনির্বাপন ও অগ্নিঝুঁকি এড়ানোর কৌশল সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে শীঘ্রই ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্সের সমন্বয়ে অভিযান পরিচালনার উদ্যোগ নেয়া হবে।
ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্র জানায়, গত শুক্রবার ছুটির দিনে অগ্নি-দুর্ঘটনার অত্যধিক ঝুঁকিতে থাকা রিয়াজউদ্দিন বাজারে আগুন লাগা ভবনটির কর্তৃপক্ষের কাছে অগ্নি-নিরাপত্তা ছাড়পত্র নেই। মার্কেট কর্তৃপক্ষ কিংবা ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে অগ্নি-দুর্ঘটনা এড়ানোর কোনও পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। মার্কেটে থাকা দোকানে প্রতিদিন কয়েক হাজার ক্রেতার সমাগম ঘটে। কিন্তু মার্কেটের নির্গমন পথ হিসেবে ব্যবহৃত সিঁড়ি সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। এর আগে রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেনে অভিযান পরিচালনাকালে দেখা গেছে, সেখানে ছোট-বড় একশ’ ৪০টি মার্কেটে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান রয়েছে। বেশির ভাগ দোকানে পোশাক-আশাক, প্রসাধনী, কাপড় ও ইলেকট্রনিক্স মালামাল বিক্রি করা হয়। মার্কেটের গলিগুলো এতই সংকীর্ণ যে মানুষের হাঁটা-চলারও সুযোগ নেই। কোথাও দখল করে নেয়া হয়েছে গলির একাংশ। কোথাও চলাচলের পথেই অবৈধভাবে দোকান তুলে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দু’জন মানুষ হাঁটা যায় না-এমন গলিপথও রয়েছে কোন কোন মার্কেটে। এসব মার্কেটে কখনো আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি-নির্বাপক গাড়ি ও কর্মীরা প্রবেশ করার সুযোগ নেই। মার্কেট ঘিরে থাকা বৈদ্যুতিক তারগুলো ঝুঁকিপূর্ণভাবে এলোমেলো অবস্থায় আছে। মার্কেটের ওপরের তলার কক্ষগুলো গুদাম এবং আবাসিকের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাছাড়া, মার্কেটের ভেতরে বা আশপাশে আগুন নেভানোর মত পানির কোন উৎস নেই। রাতের বেলা গেটগুলো বন্ধ থাকে। ফলে, মধ্যরাতে দুর্ঘটনা ঘটলে ভেতর থেকে কোনও মানুষ বেরিয়ে আসারও সুযোগ নেই।
বিভাগীয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের হিসাবে, ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে এক হাজার সাতশ’ ৮৩ টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব অগ্নিকান্ডের আটশ’ ৮৭টি ঘটেছে বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। শতকরা হিসেবে যা প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া তিনশ ৯০টি সিগারেট ও একশ’ ৪৭টি চুলার আগুন থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়েছে। একইসময়ে চট্টগ্রাম জেলায় ছয়শ’ ৭০টি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে অগ্নিকান্ড ঘটে তিনশ’ ৩২টি। এছাড়া বিভাগের আওতাধীন কুমিল্লায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে ছয়শ’ ৩৫টি, নোয়াখালীতে দুইশ’ ৯৮টি, রাঙ্গামাটিতে একশ’ সাতটি, বান্দরবানে ৪০টি ও কক্সবাজারে একশ’ ৭৯টি। গত এক বছরে চট্টগ্রামে আগুনে ক্ষতি হয়েছে সাত কোটি ৪০ লাখ ৮২ হাজার টাকার সম্পদ। শুধু চট্টগ্রামে গত এক বছরে আগুনে মারা গেছেন সাতজন। এছাড়া আহত হয়েছেন অন্তত ১৯ জন। বিভাগওয়ারী হিসাবে চট্টগ্রাম কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় একই সময়ে আগুনে ক্ষতির শিকার হয়েছে শত কোটি টাকার সম্পদ। এ সময়ে আগুনে মারা গেছেন ৭৫ জন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। ২০২২ সালে এক হাজার ছয়শ’ ১৩ টি আগুনের ঘটনা ঘটেছিল চট্টগ্রাম বিভাগে। এসব ঘটনায় দগ্ধ হন ৪২ জন, মারা যান ১৪ জন।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় উপ-পরিচালক আনিসুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে গত বছর যেসব অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগই বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে। যার অন্যতম কারণ ওভারলোডিং। বিভিন্ন ভবনে বৈদ্যুতিক ক্যাবল যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলো উপযুক্ত মানের নয় বা লোড নিতে পারছে না। ফলে আগুনের সূত্রপাত হচ্ছে সেখান থেকেই। এছাড়া বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বৈদ্যুতিক যে সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা হয়না। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহারের ফলে সেখান থেকে সৃষ্ট গোলযোগেও অগ্নিকান্ডের ঘটনা বাড়ছে।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের গত ৮ ফেব্রæয়ারি রাত পৌণে দশটার দিকে ব্যস্ততম রিয়াজউদ্দিন বাজারের আমতল এলাকার এম এইচ চৌধুরী প্লাজা ভবনের পাঁচতলায় আগুন লাগে। যেখানে কয়েকটি তলা মিলে পোশাক বিক্রয় প্রতিষ্ঠান ‘রাজস্থানের’ বিক্রয়কেন্দ্র ও গুদাম রয়েছে। তারও আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি নগরীর সবচেয়ে জনবহুল ও ব্যস্ততম জহুর হকার্স মার্কেটের পণ্যের গুদামে অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি নগরীর আন্দরকিল্লায় সমবায় মার্কেটে আগুন লেগে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ওই বছরের ১২ জানুয়ারি রিয়াজউদ্দিন বাজারের নুপুর মার্কেটে, ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর একই এলাকার হোটেল সফিনায়, ২০২০ সালে ৩০ আগস্ট চৌধুরী প্লাজায় এবং ২০১৯ সালে ১৯ অক্টোবর জহুর হকার্স মার্কেটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছিল।