মধু পূর্ণিমা : জয় হোক মানবতার

3

অপু বড়ুয়া

বৌদ্ধরা বছরে অনেক ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকেন। প্রতিটি বৌদ্ধ ধর্মীয় উৎসব সাধারণত গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশে প্রচলিত বাংলা ক্যালেন্ডার এর হিসাব মোতাবেক পূর্ণিমা তিথিতেই সকল ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হয়। প্রধান প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অন্যতম এই মধু পূর্ণিমা সারা বিশ্বের বৌদ্ধ প্রধান দেশে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে ও সাড়ম্বরে দিনব্যাপী উৎসব মুখর ভাবে পালন করেন। এই পূর্ণিমা বাংলা বর্ষের ভাদ্র মাসে সংগঠিত হয়েছিল বলে অনেকের কাছে ভাদ্র পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে এই মধু পূর্ণিমা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। সে এক সময় গৌতম বুদ্ধ কোশাম্বী শহর সংলগ্ন গোসিতারাম বিহারে অবস্থান করছিলেন। এমন সময় একটি পাত্র সংক্রান্ত বিনয়ের সামান্য বিষয় নিয়ে বিহারে অবস্থানরত ভিক্ষু বিনয়ধর ও ভিক্ষু ধর্মকথিক দু’জন প্রাজ্ঞ নিষ্ঠাবান ও পরীক্ষিত ভিক্ষুর মধ্যে ঝগড়া একে অপরের সাথে তুমুল কথা কাটা-কাটি হয়। তখন এই বিহারে অবস্থানরত অন্যান্য ভিক্ষুগণ এতে আপনা-আপনি জড়িয়ে যান এবং দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়েন। বৌদ্ধ ভিক্ষু বলে কথা, তাঁদের সম্পর্কের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে ধাবিত হলে অনন্ন্যোপায় হয়ে মহামানব বুদ্ধ দুই পক্ষের ভিক্ষুদের ডেকে পাঠালেন এবং ঝগড়া মিমাংসা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। কিন্তু দুই দলের ভিক্ষুরা এতই কঠোর হলেন যে, তারা বুদ্ধের আদেশ-নির্দেশ পর্যন্ত মানতে নারাজ। ফলে, বুদ্ধের মহান প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমতাবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের শিক্ষা দেওয়ার জন্যে বুদ্ধ নিজ বাসস্থান কোশাম্বীর গোসিতারাম বৌদ্ধ বিহার ছেড়ে তিনি একাকী পার্শ্ববর্তী পারিলিয়্যক বনে চলে যান। দলছুট পারিলিয়্যক নামক একটি হাতির নামে এ পাহাড়ের নাম করন হয়। সেখানে তিনি একাই বর্ষাবাস পালন শুরু করলেন। অঘোর বন জংগল উঁচু নিচু পাহাড় আশে পাশে গাছ গাছালি চাঁদ সূর্যের মুখ দেখা পাওয়া কঠিন ব্যাপার। পুরো এলাকা জন মানব শূন্য। অসীম সাহস আর মনোবল নিয়ে বুদ্ধ মগ্ন নিজ তপস্যায়। শুনে অবশ্যই অবাক হওয়ার কথা-বনের হিং¯্র প্রাণি বুদ্ধের কাছে নত হয়ে সেবায় মনোনিবেশ করতে লাগলো। জঙ্গলের পশু ও পাখিরা বুদ্ধের জন্যে নিয়মিত খাদ্য আর পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে লাগলো। দলছুটের পারিলিয়্যক হাতিটি বুদ্ধকে অন্য হিং¯্র প্রাণির ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করার জন্যে সারাক্ষণ বুদ্ধের পাশে পাহারায় বসে থাকে। হাতিটি ফাঁকতালে আবার পাহাড়ের ফল-ফলাদি এনে দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করে। এ যেন এক কাল্পনিক পটভূমি তবে ঘটনাটি পুরা-পুরি সত্যি। বুদ্ধের জন্যে নিবেদিত হাতির এই সেবা কার্যক্রম গাছের ডালে বসা এক বানর দেখে দেখে বানরের মনে অন্য রকম এক খুশি উৎপন্ন হলো।
বানরও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো আমিও ভগবান বুদ্ধের সেবায় নিয়োজিত হবো। কিন্তু কী ভাবে? সে উদ্দেশ্যে বানর অনেক চিন্তা ভাবনা করে বনে জঙ্গলে অনেক ঘোরা-ঘুরি করে বুদ্ধের জন্যে খুঁজতে লাগলো পাকা উত্তম ফলাদি। কিন্তু খাওয়ার কিছু না পেয়ে বানরের মন খারাপ হলো কী দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করবে। বানর আশা ছাড়েনি এগাছ থেকে ওগাছে লাফা-লাফি খাদ্য খুঁজে হয়রান। আগ্রহের কমতি নেই বানরের,ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল সু-উচ্চ গাছে একটি মৌচাক। অন্তত: মৌচাকের মধু দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করা যাবে। বানর ভাবে বুদ্ধ মৌচাকের মধু গ্রহণ করবেন কিনা। তবুও অনেক শ্রদ্ধা ভরে গাছ থেকে নিয়ে বড় মৌচাকটি বানর বুদ্ধকে দিলেন,কিন্তু বুদ্ধ তা গ্রহণ করলেন না। বানরের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন উদয় হলো,কেন বুদ্ধ মৌচাক গ্রহণ করলেন না। হঠাৎ বানরের মনে একটি বিষয় বোধগম্য হলো, বানর নিজে মৌচাকের ভিতরের কীড়া ও ডিম ফেলে দিয়ে অধির আগ্রহে আবার শ্রদ্ধাভরে বুদ্ধের কাছে নিয়ে এলো। তখন বুদ্ধ বানরের শ্রদ্ধা দেখে বিমোহিত হলেন এবং বানরের আনা মৌচাকটি সাদরে গ্রহণ করে বুদ্ধ তৃপ্তি সহকারে মধু পান করলেন। বানরের মৌচাক বুদ্ধ গ্রহণ করলেন এবং তৃপ্তি সহকারে বুদ্ধ মধু পান করলেন এ দৃশ্য বানর দেখে খুবই খুশি হলো। বনের পশু বানর মনে মনে ভাবলো আজ আমার মন বাসনা পূর্ণ হলো। সেই বানরের আনন্দ কে দেখে। এগাছ থেকে ওগাছে আবার এডাল থেকে ওডালে শুধুই লাফাতে থাকে। এমন এক সময় গাছের ডাল ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল বানরটি। তখন বানরটির মৃত্যু হলো। বুদ্ধ তাঁর দিব্য দৃষ্টিতে দেখলেন বুদ্ধকে মধু দানের প্রভাবে সে বানরটি দেবলোকে পুর্নজন্ম গ্রহন করেছে।
এদিকে বুদ্ধ কোশাম্বীর গোসিতারাম বিহার ছেড়ে যাওয়া দায়ক-দায়িকদের মোটেও কাম্য নয়। অতপর কোশাম্বীর এলাকাবাসীর তথা গোসিতারাম বৌদ্ধ বিহারের দায়ক-দায়িকাবৃন্দ মন্দিরে অবস্থানরত দ্বিধা-বিভক্ত ভিক্ষুদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করলেন এবং প্রকাশ্যে ঘোষণা দিলেন যদি তথাগত বুদ্ধকে পুনরায় অত্র বিহারে ফেরত আনতে অপারগ হন তাহলে গ্রামবাসী ভিক্ষুদের সব ধরনের সেবা, ছোয়াইং দেওয়া বন্ধ করে দিবেন। তাই করলেন। ভিক্ষুরা মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। একদিন ভিক্ষুরা আর উপায়ন্তর না দেখে দ্বিধা বিভক্ত সব ভিক্ষু জোট বেধে প্রায় পাঁচ শতাধিক ভিক্ষু এক হয়ে সবাই পারিলিয়্যক নামক বনে বুদ্ধের কাছে গেলেন। বুদ্ধের কাছে সবাই ক্ষমা প্রার্থনা করে করজোড়ে বুদ্ধকে কোশাম্বীর গোসিতারাম বৌদ্ধ বিহারে চলে আসার বিনীত অনুরোধ জানালেন। তখন বুদ্ধ সবার উপস্থিতিতে বললেন-মানুষের অজ্ঞতা ও অনাচারে যখনই পৃথিবীতে নেমে আসে নিকষকালো অন্ধকার,তখন প্রদীপের আলোর মত নিপতিত মানুষের মনে-প্রাণে জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন যে,মানুষ জন্মে বড় নয়,মানুষ কর্মেই বড়। প্রাণ সর্বজীবের নিকট সবচেয়ে প্রিয়,তাই প্রাণ হনন থেকে বিরত হও। অতএব সকল প্রকার পাপকর্ম বর্জন করো,সৎকর্ম সম্পাদন করো এবং নিজের চিত্তকে পরিশুদ্ধ করো। তবেই আসবে প্রকৃত মুক্তি। মানুষ নিজেই নিজের মুক্তিদাতা। অন্তরে জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করো,দেখবে তখন আত্মপর সব সমান।
হে ভিক্ষুগণ! তোমরা যদি মনে কর,তোমরা তোমাদের ভুল বুঝতে পেরেছ তাহলে আমি অবশ্যই আমার বাসস্থান কোশাম্বীর গোসিতারাম বিহারে ফিরে যাব। তখন উপস্থিত ভিক্ষুগণ দায়ক-দায়িকা সকলে সমস্বরে সাধুবাদ প্রদান করলেন। বুদ্ধ মন স্থির করলেন তিনি ফিরে আসবেন। পারিলিয়্যক বন ছেড়ে বুদ্ধ চলে যাবেন তা কোন মতে মেনে নিতে পারছেন না বুদ্ধের সেবক পাহারদার বনের হাতিটি। বুদ্ধকে হাতিটিকে ফেলে আসতেই হচ্ছে। হাতিটি বার বার বুদ্ধের পথ রোধ করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। বুদ্ধ ক্রমান্বয়ে হেঁটেই চলেছেন। কথায় আছে,বন্যেরা বনে সুন্দর ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও বিশালাকার হাতিটি আর গ্রামের দিকে এগুতে পারলো না। সত্যি সত্যি বুদ্ধ পারিলিয়্যক বন ছেড়ে চলে আসা সেবক হাতি সহ্য করতে পারলো না। পথেই লুটিয়ে পড়ে মারা গেল হাতিটি। সবাই অবাক হলো। বুদ্ধ দিব্য চোখে দেখলেন- এই সঞ্চিত পুণ্যের প্রভাবে হাতিটি তুষিত স্বর্গে পুনর্জন্ম নিলেন। এমন একটি পূর্ণিমা দিনে বানর বুদ্ধকে মধু দান করে স্বর্গবাসী হয়ে ছিলো বলে তখন থেকে আমরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা এই পূর্ণিমাকে মধু পূর্ণিমা হিসেবে বুদ্ধ আখ্যায়িত স্মরণিয় দিনটি আমরা শ্রদ্ধা ভরে পালন করি।
এই পূর্ণিমা দিনে ভোর সকালে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী শিশু কিশোর যুবক যুবতি বৃদ্ধ বৃদ্ধা সবাই নতুন কাপড় পড়ে উত্তম ফলাদি, মধু, ধুপ-বাতি, ওষুদ, ফুলসহ পূজা নিয়ে নিজ নিজ বৌদ্ধ বিহার প্রাঙ্গণে গমন করেন। উপস্থিত দায়ক-দায়িকরা পূজনীয় ভিক্ষুর কাছ থেকে অষ্টশীল-পঞ্চশীল গ্রহণ করেন। বেলা ১১টায় শেষ হয় প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় বৌদ্ধ বিহারে ছোট বড় সকলে মিলিত হয় প্রদীপ পূজা আর সমবেত প্রার্থনায়। সন্ধ্যা রাতে কোন কোন বিহারে চলে বৌদ্ধ কীর্তন কিংবা পালাগান। এই পূর্ণিমায় ধর্মপরায়ণ বানরের মত সাধারণ বৌদ্ধগণ দেবলোকে পুনর্জন্ম লাভের আশা করেন মনে প্রাণে। বৌদ্ধ ধর্ম মানব ধর্ম। গৌতম বুদ্ধের মানবতা সর্বব্যাপী। বুদ্ধ প্রজ্ঞার প্রদীপ হাতে মৈত্রীর, করুণা, প্রেম ও অহিংসার বারতা নিয়ে এসে মানুষকে জাগ্রত করেছিলেন শুনিয়েছিলেন অমৃতের বাণী। কেবল ভিক্ষুদের জন্য ধর্মোপদেশ দিয়েছেন তা নয়, গৃহী বা সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য, তাদের সংসার জীবন সুখী ও সমৃদ্ধ করার উপদেশ দিয়ে গেছেন গৌতম বুদ্ধ। ¯েœহ, মায়া, মমতা, দয়া, করুণা, সহমর্মিতা, অন্যের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা, ভ্রাতৃত্ববোধ, সামাজিক ন্যায়বোধ, সামাজিক কল্যাণ, নৈতিকতা ইত্যাদি সবগুলোই মানবধর্ম। শীলবান দায়ক-দায়িকা শীল পালনের মাধ্যমে স্বর্গে গমন করেন। ধ্যানের মাধ্যমে নির্বাণ সুখ কামনা করেন। সবার জানা- বুদ্ধ নিজেও কঠোর তপস্যা ধ্যান করে সম্বোধি লাভ করেছেন মহামানব জগৎপূজ্য বুদ্ধ হয়েছেন। বুদ্ধ মানে মহাজ্ঞানী। বুদ্ধ বলেছেন- প্রত্যেকের মধ্যে বুদ্ধ হওয়ার মহান শক্তি বিরাজমান। যে সকল কাজ করলে মহাজ্ঞান অর্জন করা যায় তাই করতে হবে,কঠিন হলেও তা সকলের দ্বারা সম্ভব। সাধনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। জগতে সকল প্রাণি সুখি হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। শুভ সুন্দর হোক আজকের শুভ মধু পূর্ণিমা তিথি।
লেখক : গীতিকার- বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন