ভোটের মাঠে দাপুটে তিন নেতার পতন

24

রাহুল দাশ নয়ন

‘কত সুন্দর লাগেরে বন্ধু, কত সুন্দর লাগে। আমি বেঈমান না, আমি মোনাফেক না। আমি বাপকে বলি বাপ, মাকে বলি মা।’ গত বছর জুন মাসে কক্সবাজার পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী মাহবুবুর রহমানের নির্বাচনী প্রচারণায় দেয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের বক্তব্যটি ভাইরাল হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে না করতে দেয়া আলোড়িত এই বক্তব্যে উদ্ভুদ্ধ হয়েছিলেন নেতাকর্মীরা। কিন্তু এক বছরের মাথায় উল্টোটাই দেখতে হলো মুজিবকে। যার পক্ষে এবং যার বিপক্ষে এই বক্তব্য দিয়েছিলেন উভয়পক্ষই প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মুজিবুর রহমানকে ধরাশায়ী করতে এক হয়ে কাজ করেছেন।
কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী বলেন, ‘উনি আমার পক্ষে থাকলেও অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেন নাই। উনার আশপাশের মানুষরাই সম্পর্ক ভালো থাকতে দেয়নি। আমার বিরুদ্ধে যিনি নির্বাচন করেছেন উনাকেও উনি প্রার্থী করিয়েছেন। যা আমার সে সময়ের প্রতিপক্ষ প্রার্থীও বলবে। অর্থাৎ ডুয়েল পলিসি করেছেন তিনি। নয়তো জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের কেন্দ্রে নৌকার প্রার্থী হিসেবে পৌর নির্বাচনে আমি ৭০ ভোট পেতাম না।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের মতো একইভাবে ধরাশায়ী হয়েছেন সভাপতি এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরীও। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমানকেও পরাজয় ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে। কক্সবাজার আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাচনে ভাতিজা ব্যারিস্টার হানিফ বিন কাশেমের কাছে পরাজিত হয়েছেন। কক্সবাজার সদরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান হেরেছেন সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আবছারের কাছে। মিরসরাই উপজেলা নির্বাচনে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমানকে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন এনায়েত হোসেন নয়ন। প্রথম ধাপের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দাপুটে এই তিন নেতা ক্ষমতার প্রভাব, সুষ্ঠু ভোট ও দলীয় কোন্দলের কারণেই পরাজিত হয়েছেন বলে মনে করছেন ভোটাররা।
দলীয় নেতাকর্মী ও ভোটাররা জানান, ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী ও মুজিবুর রহমানকে পুনরায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক করা হয়। এই দুইজন নেতৃত্বে থাকাকালীন সময়ে বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য ও সাংগঠনিক বিশৃঙ্খলা করেছেন বলে অভিযোগ ছিল। যে কারণে জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিবর্তন চেয়েছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু কেন্দ্র দুইজনকেই পুনরায় বহাল রাখে। যা নিয়ে নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও ভোটের মাঠে ভাতিজাকে ছাড় না দেয়ার বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি কুতুবদিয়াবাসী। ২০০৬ সালে কুতুবদিয়ায় ব্যারিস্টার হানিফ বিন কাশেমের ভাই এরশাদুল হাবিব রুবেলকে জায়গা ও রাজনৈতিক বিরোধে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাÐের জবাব দিতেই এডভোকেট ফরিদের বিরুদ্ধে ভোটে প্রার্থী হন কাশেম। এছাড়াও তরুণ আইনজীবী হিসেবেও ভোটারদের নজরে পড়েন কাশেম। জেলা সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগসহ নানাবিধ কারণে গত পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত করা হয়। যা নিয়ে তিনি কক্সবাজারে অনেক সিনিয়র নেতার সাথে বিরোধে জড়ান। এবার উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হলে মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে একাট্টা হন স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরোয়ার কমল, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহীনুল হক চৌধুরী মার্শাল, পৌরসভার মেয়র মো. মাহাবুবুর রহমান চৌধুরী। এই তিনজন মিলে স্থানীয় চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদ সদস্য, কাউন্সিলর, ইউপি মেম্বারদের উপর প্রভাব বিস্তার করেন। এই তিন নেতার নির্দেশনা অমান্য করলে আগামীতে বরাদ্দ বঞ্চিত হবেন এমন শঙ্কা থেকেই মুজিবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরোয়ার পূর্বদেশকে বলেন, ‘কুতুবদিয়ায় তরুণ নেতৃত্বকেই বেছে নিয়েছে ভোটাররা। পরাজিত প্রার্থী শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকায় কিংবা রাজনৈতিক কারণে এটা হতে পারে। মানুষ আসলে নেতৃত্বের ভিন্নতা চায়। কক্সবাজার সদরে এমপি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র মিলে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের বরাদ্দ দেয়া-নেয়া নিয়ে নানামুখী চাপে রেখেছিল। মুজিব ভাইয়ের অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু উনি নৌকার বিরুদ্ধে কখনো যাননি। যে নেতা কখনো নৌকার বিরুদ্ধে করেনি এটা হিসেবে নিয়ে হলেও সবাই খুশি থাকতে পারতো। অথচ সবাই উল্টো উনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। দায়িত্বশীল একজন নেতার বিরুদ্ধে করে আসলে আওয়ামী লীগরই ক্ষতি করা হয়েছে। একজন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের জন্য উপজেলা চেয়ারম্যান পদটি খুব বেশি বড় পদ নয়। সবাই মিলে উনাকে জয়ী করাতে পারলেই বরং সবাই সম্মানিত হতো।’
কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পরাজয়ের বিষয়ে কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মো. মাহবুবুর রহমান চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ‘তৃণমূলে যারা দীর্ঘদিন রাজনীতি করেছে তারা অবহেলিত। তারা ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী দেয়া নিয়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে। এই বাণিজ্য অনেকেই মেনে নিতে পারে নাই। এছাড়াও প্রস্তাবিত জেলা কমিটিতে ত্যাগী নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে নেতাকর্মীরা। যে কারণেই উনি পরাজিত হয়েছেন।’
মিরসরাইয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করেছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান। শেখ আতাউরকে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বানাতে গিয়ে অনেক নেতার বিরুদ্ধে গিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। জেলা পরিষদের সদস্যও হন শেখ আতাউর। একসময়ে দুই নেতার মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলেও তা এখন বিলীন। সাংগঠনিক কারণে দুইজনের মধ্যে বিরোধ বেড়েছে। যে কারণে উপজেলা নির্বাচনে এনায়েত হোসেন নয়নের পক্ষেই ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও তাঁর ছেলে সংসদ সদস্য মাহবুবুর রহমান রুহেল।
পরাজয়ের বিষয়ে জানতে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমানের মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে নির্বাচনের আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মিরসরাইয়ের ঘরে ঘরে প্রচারণায় গিয়ে দেখছি সব আওয়ামী লীগ। এই আওয়ামী লীগ সেই আওয়ামী লীগ নেই। বর্তমান বাস্তবতা ও ১৯৭১ সালের বাস্তবতা ভিন্ন। আমাদের অভিভাবকের (ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন) কাছে হয়তো আমার প্রয়োজনীয়তা কমেছে। এসব কথা বলতে গেলে লম্বা হয়ে যাবে। অগ্রহণযোগ্য কথা চলে আসবে।’