ভাষাসৈনিক, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠক মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী

8

রশীদ এনাম

‘মা’ তোর বদনখানি মলিন হলে, ওমা আমি নয়ন জলে ভাসি” আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি গুণ গুণ করে জাতীয় সঙ্গিতের শেষ চরণটি গাইছিলেন মিয়া ফারুকী চাচা। ভাবছিলাম জাতীয় সঙ্গিতের শেষ চরণটির কথা কতো আবেগ দিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, মায়ের মুখ মলিন হলে নয়ন জলে ভাসি কবি মা মাটির জন্য কত দরদী হলে এই এতো সুন্দর লিখতে পারেন। মায়ের মুখ মলিন হলে সত্যি আমরা জলে ভাসি। মা মানে তো একটা দেশ। এটাই সত্যিকারের দেশপ্রেম। আসলে আমরা সোনার বাংলায় বাস করি কিন্তু দেশে আজ সোনার মানুষের বড়ো অভাব। যাদের জন্য এই মা মাটি মানচিত্র আমরা পেয়েছি তাঁদেরকে আমরা আজো পারিনি সত্যিকারভাবে মূল্যায়ন করতে, স্বীকৃতি দিতে কিংবা সম্মান জানাতে। তেমনি একজন সোনার মানুষের খুঁজে বেড়িয়েছিলাম পটিয়া কচুয়াই গ্রামে। কচুয়াইগ্রামটি শ্রীমতি খালের পাশে অবস্থিত। পটিয়া শ্রীমতি খালের উৎপত্তি মুলত শ্রীমাই পাহাড় থেকে। শ্রীমতি রাণীর নাম অনুসারে শ্রীমাই পাহাড়। আদিকাল থেকে শ্রীমতি খালের পাড়ে প্রচুর পরিমাণে কচু এবং নানা রকমের সবজির চাষাবাদ হতো। কথিত আছে কচু থেকে কচুয়াই ইউনিয়ন। কোন এক পল্লী কবি চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন,
“আসল সৈয়দ যারা মাইল্যাপাড়া
হারালাতে ফকির বেশ
পটিয়াতে কচুরছড়া
চরকানাইতে ভোয়ইয়া বেশ”।
শ্রীমতি খালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিসিক শিল্প নগরী। ব্রীজের পাশে খ্রিস্ট্রান সম্প্রদায়ের উপসানালয়, অবকাশ যাপনের জন্য চমৎকার শ্রীমতি খালের বাঁধ ব্রীজের পাশে নার্শারী। রেললাইনে সারি সারি খেজুর গাছ। শ্রীমতি ব্রীজ পাড় হয়ে যে রাস্তাটি দক্ষিণ পাশে চলে গেছে সেটি কচুয়াই গ্রাম। প্রকৃতি সবুজে ঘেড়া, মসজিদ, কবরস্থান, পুকুর, ইশকুল, একটু সামনে গেলে ফারুকী পাড়া। ফারুকী পাড়ার বাতিঘর খ্যাত মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকী। কলেজ জীবন থেকে তাঁকে চিনতাম একজন কলামিস্ট হিসেবে তিনি বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ ও মাসিক পটিয়াসহ চট্টগ্রামের জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কলাম লিখতেন। মিয়া ফারুকীকে প্রথম যেদিন দেখেছি, শুভ্র বর্ণের দাড়িওয়ালা, চশমা পড়া বর্ষিয়ান এক রাজনীতিবিদ, ভাষাসৈনিক সহজ সরল বিনয়ী আপাদমস্তক একজন জ্ঞানি মানুষ। একদিন তাঁর সাক্ষাত নেয়ার জন্য কচুয়াই গ্রামে হাজির। পুকুরে শান বাঁধানো ঘাট সামনে এগিয়ে গেলে পাকা টিনশেট বাড়ি। মিয়া ফারুকী চাচাকে সালাম দিয়ে পরিচয় দেয়ার পর বুকে জড়িয়ে ধরলেন, কুশলাদি জানার পর তাঁর নিজের সংগ্রহশালায় বসালেন।
আড্ডার ফাঁকে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আমাকে আপ্যায়ন করার জন্য। ফারুকী চাচা বেশ অতিথি পরায়ন। সংগ্রহশালাটি ছিল চমৎকার বুক সেলফে তরে তরে সাজানো বই। গ্রামে এতো সুন্দর নিজস্ব পাঠাগার খুব কমই আছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখাগুলো সংগ্রহ করে কোট ফাইলের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছেন, ফাইলের উপরে পত্রিকার নাম কাটিং করে রেখেছেন। নিভৃতচারী মানুষটি যে বই পোকা দেখে বুঝা যায়। বাড়িতে বসে বসে তিনি লিখেন, অবসরে নাতী নাতনীদের সাথে খুনসুটি করেন। বেলা, নিমকি, চনাচুর সাথে ধোঁয়া উড়িত চা এসে হাজির। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বললেন, রশীদ এনাম একদিন আমি থাকবো না আমার পাঠাগার এবং সংগ্রহশালাটি থেকে যাবে কালের সাক্ষী হয়ে।
১৯৩৩ সালে ১০ফেব্রুয়ারি মিয়া ফারুকী পটিয়া চক্রশালা গ্রামে(বর্তমানে কচুয়াই ইউনিয়ন) জন্ম। পিতা শিক্ষাবিদ মাওলানা খলিলুর রহমান ফারুকী, মাতা সফুরা খাতুন। পিতা চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল ইশকুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও নিখিল ভারত কংগ্রেসের সদস্য। সে সুবাধে পড়ালেখার হাতেখড়ি গ্রামে হলেও তিনি মেট্রিক পাশ করেন মিউনিসিপাল ইশকুল থেকে। পরবর্তীতে রাজনীতি, সংগঠন, বই পড়া, এবং বাবার লাইব্রেরী দেখাশুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬১সালে খালাতো বোন রোকেয়া বেগমকে শাদি করেন। দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের জনক প্রত্যেক ছেলে মেয়ে স্ব স্বভাবে প্রতিষ্ঠিত রোকেয়া বেগম একজন রতœা গর্ভা মা। জ্যেষ্ঠ সন্তান শোয়েব ফারুকী দেশবরেণ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত আলোক চিত্র শিল্পী ও ফটো ব্যাংকের পরিচালক। ছোট ছেলে শহিদ ফারুকী টিভি ও বেতার শিল্পী পাহাড়তলী চক্ষুহাসপাতালে কর্মরত। মিয়া ফারুকীর বাবা ছিলেন একজন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর সহযোদ্ধা ও । ইশকুলবেলা থেকে বাবার সহযোদ্ধাদের সুহবতে তার মধ্যে বিপ্লবী, দেশপ্রেম মানবিক গুণাবলী হৃদয়ে বাসা বাঁধে। ১৯৪৯ সালের কথা ছাত্রজীবন থেকে মুসলীম লীগ(পরবর্তীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ) স্থানীয় ইউনিয়ন কমিটিতে যোগদান করেন। পরবর্তীতে মহকুমা, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মে তার পদচারনায় তৎকালীন অনেক বর্ষিয়ান নেতাদের সাথে তাঁর উঠা বসা ছিল।
১৯৫২ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি এবং প্রয়াত ন্যাপ নেতা আবুল মাসুদ চৌধুরী,রিজুওয়ানুল কবির আনছারীসহ আরো বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন সহ নানাভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য পটিয়ায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে পটিয়া আদর্শ ইশকুল ও রাহাত আলী ইশকুলের ছাত্রদের নিয়ে রাজপথে আন্দোলন করেন”।
চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় নিজেদের “চট্টল লাইব্রেরী” ছিল, যেখানে সন্ধ্যায় আড্ডা বসতো। সে আড্ডায় চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রবীণ রাজনীতিবিদ, আতাউর রহমান খান কায়সার, এম এ হান্নান, এম এ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, বাঁশখালীর সুলতান আহমেদসহ অনেকে থাকতেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিবুর রহমানও এই লাইব্রেরীতে এসেছিলেন। মিয়া ফারুকী ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয়দফা আন্দোলন, ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানের সময় প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে সরাসরি ভূমিকা রাখেন। তৎকালীন চট্টগ্রামে রাজপথের একজন লড়াকু ছাত্রনেতার পরিচিত লাভ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, চারিদিক কারফিউ, পাকবাহিনীরা যখন স্টিমরোলার, গণহত্যা বাড়িঘর জ্বালাও পোড়াও শুরু করেন, মার্চের শেষের দিকে পটিয়ায় পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গঠন শুরু করেন। ১৬’এপ্রিল পটিয়ায় পাকিস্তানিরা বোমা হামলা করেন এতে বেশ কয়েকজন আহত সহ ২০ জন শহিদ হন। তিনি আরো বলেন, একসময় আমরা অনেকে মিলে ধোপাছড়ি পাহাড়ে আত্মগোপন করি। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে মিলিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতাসহ সংগঠন করে দেশ রক্ষার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করি। ২৪’ মে পাকবাহিনীরা আমাদের বসতবাড়িতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক থাকায় আমাকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন পাকবাহিনীর সদস্যরা। সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। ১১ ডিসেম্বর আমাদের গ্রামের পাকিস্তানি ঘাতকরা আবদু সাত্তার, কামাল, হাকিম ও খাতুনি বেগমকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেন। পাকিস্তানিদের সাথে রাজাকার, আলবদররাও মিলে খুন, ধর্ষণ ও পাশবিক নির্যাতন শুরু করেন। এই পাক হায়েনাদের শিকার হয়েছে অনেক যুবতী ও গৃহবধূ। সে ভয়াবহ দুঃসহ স্মৃতি মনে পড়লে আজো শরীরের পশম খাড়া হয়ে যায় হৃদয়ে দাউ দাউ আগুন জ¦লে। পাকিন্তানি এবং রাজাকারদের প্রতি তীব্র ঘৃণার সৃষ্টি হয়।
গ্রামে সবাই মিয়া ফারুকীকে সমাজসেবক ও মানবিক লেখক কলামিস্ট হিসেবে সম্মান করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও নিভৃতচারী মিয়া ফারুকী কখনো মুক্তিযোদ্ধা কিংবা ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি চান নি। ২০০৪ সালে নেয়া সাক্ষাতটি ছবিসহ ডায়েরীর পাতায় খুঁজে পেলাম।মাঝখানে কতোটা বছর পেরিয়ে গেলো। একদিন জানলাম, তিনি গুরুতর অসুস্থ। দেখতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও ঢাকা থাকার কারনে মিয়া ফারুকী চাচাকে দেখতে যাওয়া হয়নি। ২০১৬ সালে ১ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে চলে যান।পটিয়া বাই পাস পেরিয়ে একটু সামনে গেলে ছোট একটা দিঘীর পাশে কবরস্থান। মিয়া ফারুকির সমাধিটি সবুজ ঘাসে ঢাকা। কচুয়াই আজিমপুর গ্রামে যাওয়ার পথে মিয়া ফারুকী চাচার এপিটাফটা চোখে পড়ে। জলছবির মতো চোখের সামনে ভেসে উঠে নিভৃতচারী ভাষা সৈনিক দিপ্তীমান গুণিমানুষটির চেহারা। মিয়া ফারুকী চাচার বড়ো ছেলে আলোকচিত্র শিল্পী শোয়েব ফারুকী ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলাম চাচা কি মু্িক্তযোদ্ধা বা ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ? শোয়েব ভাই অভিমান করে বললেন, “ভাষাসৈনিক/ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দূরের কথা পটিয়ার সাবেক এক জনপ্রতিনিধি বলেছিলেন বাবার নামে সড়কের নামকরণ করে দিবেন। কেউ কথা রাখেন নি এটা সত্যিই লজ্জার”। মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীরাই ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমীক এবং সোনার বাংলার সোনার মানুষ। তাঁর অষ্টম মৃত্যুবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু তনয়া মানবতার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীসহ সম্মানিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে সবিনয় নিবেদন, মিয়া আবু মোহাম্মদ ফারুকীকে মুক্তিযোদ্ধা ও ভাষাসৈনিকের স্বীকৃতিসহ তাঁর নিজ গ্রামে সড়কের নামকরণসহ তাঁর পাঠাগার ও সংগ্রহশালাটি সংরক্ষণ করা হোক।

লেখক : লেখক ও গবেষক, সদস্য বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী