ভারত উপমহাদেশে প্রথম ইসলামের আগমন

16

ড. মুহম্মদ মাসুম চৌধুরী

চট্টগ্রাম শহরকে বলা হয় ‘মদিনাতুল অলি’ বা অলির শহর। এখানে পীর আউলিয়া দরবেশের আগমনের কারণে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে একথা সকলে জানলেও ইসলামের প্রচারের প্রারম্ভে উপমহাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের মাঝে আগমন ঘটেছে তা অনেকে জানে না।
বাংলাদেশে শুরুতে ইসলামের আগমন হয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত সমুদ্র বন্দর সাদকাওয়ান, সমান্দর, যা আজকের স›দ্বীপ ও চট্টগ্রামের বন্দরে। এই অঞ্চলে ইসলাম প্রারম্ভে আগমনের কারণে এর গুরুত্ব অনেক বেশী।
ইসলামের সূচনাকালে যে চট্টগ্রামে ইসলামের প্রচার হয়েছে এ বিষয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত না হলেও বহু পুরানো তথ্য উপাত্ত, আরব ভৌগোলিক, পর্যটক, মানচিত্র, দলিল-দাস্তাবেজ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়েছে তা হতে আমরা অনেক উপাদান পাই।
উদাহরণস্বরূপ এখানে কয়েকটি প্রাচীনতম আরবী গ্রন্থের উল্লেখ করা যেতে পারে। সুলায়মান-তাজেরের ‘সিলসিলতু তাওয়ারিখ’ আরব বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রথম পুস্তকরূপে পরিগণিত হয়ে থাকে। হিজরী ২৩৭/৮৫১ সালে রচিত এই গ্রন্থে ভারত ও চীনের বিবরণ রয়েছে এবং সামুদ্রিক দ্বীপাঞ্চলের কথাও এতে স্থান পেয়েছে। মূলত এটি সুলায়মান ও আবু জাইদ হাসান সাইরাফীর যৌথ রচনা। এই গ্রন্থে পরিবেশিত মূল্যবান তথ্য হতে প্রমাণিত হয় যে, তিনি চট্টগ্রামের এসেছিলেন। আরব ভৌগোলিক ইব্নে খোরদাজবে রচিত ‘কিতাবুল মাসলিক ওয়াল মাসালিক’ পুস্তকে বাংলাদেশ পর্যন্ত আরবদের আগমন পথের বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। ইব্নে খোরদাজবে হিজরী ৩০০/৯১২ সালে ইন্তেকাল করেন। (সূত্র : এ.কে. এম মহিউদ্দিন রচিত চট্টগ্রামে ইসলাম পৃষ্ঠা : ৮)
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চল ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। আরবস্থানের বিভিন্ন বাণিজ্যিক নৌযান বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে চলাচল করত। তখন চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে চীন গমন করতো। মহানবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনায় হিজরতের পূর্বেই ৬১৭ খৃস্টাব্দে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াহাব (রা)’র নেতৃত্বে বাদশাহ নাজজাশির দেওয়া জাহাজে করে আরব হতে চার জন সাহাবী চট্টগ্রামে আগমন করেন। তাদের নাম : (১) হযরত তামীম আনসারী (রা.) (২) হযরত কায়স ইব্ন ছায়করী (রা.) (৩) হযরত উরওয়াহ ইবনে আছম (রা.) (৪) হযরত আবু কায়েস হারিস (রা) তাঁরা চট্টগ্রাম বন্দরে ইসলাম প্রচার করেন চার বছর। পরে চীনে চলে যান।
খলিফাতুল মোসলেমিন ‘আমিরুল মোমেনিন হযরত ওমর ফারুক (রা.)’র শাসনামলে আরব হতে সাতজন তাবেয়ীর একটি দল ইসলাম প্রচারে চট্টগ্রাম আগমন করেন। তাঁরা হলো : (১) হযরত মোহাম্মদ মামুন (রা.) (২) হযরত মোহাম্মদ মোহাইমেন (রা.) (৩) হযরত আবু তালেব (রা.) (৪) হযরত মোহাম্মদ মুর্তুজা (রা.) (৫) হযরত আবদুল্লাহ (রা.) (৬) হযরত হামিদ উদ্দিন (রা.) (৭) হযরত হোসেন উদ্দিন (রা.)। তাঁরা সর্বপ্রথম নও মুসলিমদের নিয়ে দেয়াং পাহাড়ের পাশে ঈদের নামাজ আদায় করেন। পরবর্তীতে আরও পাঁচটি দল চট্টগ্রামে ইসলামের প্রচারের জন্য আগমন করেন। (সূত্র : জামাল উদ্দিন রচিত ‘বার আউলিয়ার চট্টগ্রাম’ দ্র: )
প্রথম সাহাবী যার নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বুকে ইসলামের আগমন হয়েছে তাঁর সম্পর্কে আমাদের জানা দরকার। তাই আবু ওয়াক্কাস (রা.) সম্পর্কে লিখতে চাই ইতিহাস কী বলে।
কোন কোন ঐতিহাসিক মনে করেন, প্রথম ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে নবম ব্যক্তি হলো হযরত সা’দ ইব্ন আবু ওয়াক্কাস (রা.)। হযরত আবু বক্কর (রা.)’র আহবানে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে তিনি পঞ্চম ব্যক্তি। তাঁর দুই ভাই যথাক্রমে উমাইর ইবনে ওয়াক্কাস (রা.) এবং আমের ইব্ন মালিক প্রকাশ ইবনে ও ওয়াক্কাস ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারীদের মধ্যে ১৫তম ও ৪৫তম। সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) প্রথম মুসলিম যিনি ইসলামের জন্য প্রথম তীর চালান। প্রথম তাঁর হাতে একজন কাফির নিহত হন।
এই সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) ছিলেন মহানবী হযরত মোহাম্মদ (দ.)’র মা আমিনা (রা.)’র ভাই, প্রিয় নবী (দ.)’র মামা। তিনি ১৭ বছর বয়সেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। কেউ কেউ সাদকে হযরত আমিনার ভ্রাতুষ্পুত্র বলেও উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত মুহাদ্দিস মোহাম্মদ আবাদানের মত অনুযায়ী হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াহাব (রা.) রাসুল (দ.)’র নবুয়তে প্রকাশিত হওয়ার পঞ্চম বছর হাবশায় হিজরত করেন। নবুয়াত প্রকাশের ৭ম বছরে কয়েকজন সাহাবী ও হাবশী মুসলমান দু’টি সমুদ্রগামী জাহাজ নিয়ে চীনের পথে যাত্রা করেন। ৬১৭ খ্রীস্টাব্দে প্রিয় নবী (দ.)’র হিজরতের ৬ বছর আগে তাঁরা হাবশা যাত্রা করেন এবং ৬২৬ খ্রীস্টাব্দে হিজরী তৃতীয় সালে চীনে উপস্থিত হন। তাঁরা ৪/৫ বছরের পথ ৯ বছরে অতিক্রম করেন। অর্থাৎ সাড়ে ৮ বছর প্রতিমধ্যে ইসলাম প্রচারে অতিবাহিত করেন। (সূত্র : ফারুক মাহমুদের ‘ইতিহাসের অন্তরালে, পৃষ্ঠা : ৯৬)
আধুনিক লেখক ও গবেষক বাশার নঈম উদ্দীন লিখেছেন, ‘ইসলামের সুবেহ সাদিকের আলোক রশ্মি যখন মরু-আরবের সমগ্র আকাশে পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি আলোক আঁধারির কুহেলী মুহূর্তেও মুসলমানরা সাগর মরু আর পাহাড় পর্বত অতিক্রম করে দিগন্তের পথে ছুটেছিল। আর তাইতো দেখি পৃথিবীর আর একপ্রান্তে বিশ্বনবী (দ.)’র সাহাবী ও মাতুল ওহাব (রা.) চীনের ক্যান্টন বন্দরে কর্মক্লান্ত দেহে শান্তির শয্যা গ্রহণ করেছেন। সাহাবী হযরত আক্কাস (রা.) ঠিক একই সময়ে মাহমুদ বন্দরে এবং সাহাবী তামীম আনসারী (রা.) মাদ্রাজের ১২ মাইল দক্ষিণে মেলাপুয়ে চিরনিদ্রায় নিরবচ্ছিন্ন অবসর গ্রহণ করেছেন। ঐ সব অঞ্চলে তাঁদের মাজার আজও বিদ্যমান। কাজেই এটা সহজে অনুমেয় যে, আবিসিনিয়ায় ইসলাম প্রচার করেই মুসলমানরা সেখানে তাঁদের গতিরুদ্ধ বা সীমায়িত করেনি। আবিসিনিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে তাঁরা পৌঁছেছিল এবং এভাবেই ভারত মহাসাগরের উত্তর উপকূল ও দক্ষিণাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। (সূত্র : বাশার মঈন উদ্দিন, সাগর বিজয় ও আমেরিকা আবিস্কারে মুসলমান, পৃ: ২২)
আল্লাহর রাসুল (দ.)’র মক্কী জীবনেই সাহাবীরা পৃথিবীর পূর্ব দিকে ইসলামের বাণী নিয়ে এসেছিলেন। নবীজীর মামা ইবনে ওহাব চীনে, হযরত ওয়াক্কাস চট্টগ্রাম বন্দরে এবং তামীম আনসারী মাদ্রাজের মেলাপুরে আগমন করেন।
বাংলাদেশের গবেষক ফারুক মাহমুদ লিখেছেন, প্রাচ্য জগতে ইসলামেরা দাওয়াত পাঠাতে আল্লাহর রাসুল (দ.) তাঁর মামা, মা আমেনার চাচাতো ভাই এবং কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের পিতা সাহাবী হযরত আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব (রা.) কে প্রেরণ করেন। মক্কায় কুরাইশদের হাতে নির্যাতিত মুসলমানদের আবিসিনিয়ার হাবশায় হিজরত শুরু হয় নুবয়াতের প্রথম বছর। সপ্তম বছর হযরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) সম্রাট নাজজাশীর দেওয়া সমুদ্রগামী জাহাজ নিয়ে বের হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন সাহাবী হযরত কায়েস ইবনে হুয়াইফা (রা.), হযরত উরওয়াহ ইবনে আছাছা এবং হযরত আবু কায়েস ইবনে হারিছ (রা.) তিনি আরো লিখেছেন, ‘চীনা ভাষায় সেদেশে ইসলামের আগমন সম্পর্কিত যেসব তথ্যসূত্র রয়েছে, তা থেকে জানা যায় যে, খ্রীস্টিয় ৬২৬ সালের কাছাকাছি এক সময়ে চীন উপকূলে ইসলাম প্রচারকগণ অবতরণ করেন। দলনেতা হযরত আবু ওয়াক্কাস (রা.) ক্যান্টন বন্দরে অবস্থান করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোয়াংটা মসজিদটি পরবর্তীককালে ভক্তদের প্রচেষ্টায় সুরম্যরূপ লাভ করে। এখনো সমুদ্রতীরে সুউচ্চ মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মসজিদের অদূরেই তাঁর মাজার প্রায় চৌদ্দশ বছর ধরে চীনা মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা পবিত্র ও প্রিয় জিয়ারতগাহরূপে গণ্য হয়ে আসছে। তাঁরা ঐ দু’টির নাম রেখেছেন ‘পূর্ব পুরুষের মসজিদ এবং পূর্ব পুরুষের মাজার। অন্য দু’জন সাহাবী উপকূলীয় কুফীন প্রদেশের চুয়ান চু বন্দরের নিকটবর্তী লিং নামক পাহাড়ের উপর সমাহিত রয়েছেন। চতুর্থ জন দেশের অভ্যন্তর ভাগে চলে গিয়েছিলেন বলে উল্লেখ আছে। (সূত্র : ফারুক মাহমুদের ‘ইতিহাসের অন্তরালে’ পৃষ্ঠা : ৯৩,৯৪ ও ৯৫) সহায়ক গ্রন্থ ‘চট্টগ্রামে ইসলাম’ লেখক, এ.কে এম মহিউদ্দিন।

লেখক : কলাম লেখক, রাজনীতিক