ভারতে সব নজর এখন রাজনীতির দুই ‘পাল্টুরামে’র দিকে

7

ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না, গতকাল মঙ্গলবার এটা যতই স্পষ্ট হয়ে উঠছে ততই রাজনৈতিক মহলের ‘ফোকাস’ সরে আসছে দেশের দুই প্রবীণ রাজনীতিকের ওপর। ঘটনাচক্রে তাদের দুই জনের ঘন ঘন রাজনৈতিক সঙ্গী বদলানোর পুরনো অভ্যাস আছে। এবার তারা ঠিক কী করেন সে দিকেই সারা ভারত প্রবল উৎকণ্ঠা ও আগ্রহের সঙ্গে নজর রাখছে।
তারা হলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার ও অন্ধ্রের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী এন চন্দ্রবাবু নাইড়ু। তাদের দুই জনের দল- যথাক্রমে জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) ও তেলুগু দেশম পার্টির (টিডিপি) সমর্থন ছাড়া বিজেপির পক্ষে যে কেন্দ্রে সরকার গড়া সম্ভব নয়, সেটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠতেই রাতারাতি তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ভীষণ বেড়ে গেছে। আর তারা সত্যিই শেষ পর্যন্ত বিজেপিকে সমর্থন করেন, নাকি আরও একবার ‘পাল্টি’ খান, সেটা নিয়েও জল্পনা বাড়ছে।
এর কারণ নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়ু দুই জনই ভারতীয় রাজনীতির খুব পুরনো ‘পাল্টুরাম’ হিসেবে পরিচিত। পাল্টি শব্দটা হিন্দিতেও প্রচলিত, যার মানে হলো ডিগবাজি খাওয়া। সেই থেকেই এই ‘পাল্টুরাম’ শব্দের উৎপত্তি।
আসলে নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়ু, দুই জনই তাদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এতবার বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছেন এবং ধরেছেন যে রাজনীতির পর্যবেক্ষকরাও খেই হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ‘পাল্টুরাম’ শব্দটা তাদের নামের সঙ্গে সেঁটে বসে গেছে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের
যেমন, এবারের লোকসভা নির্বাচনেই জেডিইউ ও টিডিপি দু’টি দলই বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের অংশ হিসেবে ভোটে লড়েছে। বিহারে ও অন্ধ্রে যথাক্রমে জেডিইউ ও টিডিপি’র সঙ্গে বিজেপির আসন সমঝোতাও হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে নির্বাচনের ফল বেরোনোর পরেও এই দুটি দল বিজেপিকে সমর্থন করতে বাধ্য থাকবে।
ভারতে নির্বাচনের আগে যে সব ‘প্রাক-নির্বাচনি সমঝোতা’ হয়, ভোটের পরেও কোনো একটা জোটের সেই দলগুলোকে একসঙ্গে থাকতে হবে, তার কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। পরিস্থিতি অনুযায়ী, ধরা যাক এনডিএ জোটের কোনো দল ভোটের ফল বেরোনোর পর প্রতিপক্ষ ইন্ডিয়া জোটে যোগ দিতেই পারে কিংবা উল্টোটাও অনায়াসেই ঘটতে পারে। দেশের রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়ে তাদের সমর্থন কোন দল বা জোটের দিকে, সেটা জানালেই যথেষ্ঠ।
এখন ভারতে নির্বাচনি ফলের যে ‘ট্রেন্ড’ বা প্রবণতা তাতে দেখা যাচ্ছে বিজেপির পক্ষে এককভাবে গরিষ্ঠতা পাওয়া খুব মুশকিল। সরকার গড়তে হলে তাদের এনডিএ’র অন্য শরিকদের সমর্থন লাগবেই।
গতকাল মঙ্গলবার ভারতীয় সময় বিকাল পাঁচটায় নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, বিজেপি জিতেছে বা এগিয়ে আছে দেশের মোট ২৪৪টি আসনে। এখন পার্লামেন্টে গরিষ্ঠতার জন্য চাই অন্তত ২৭২টি আসন। কিন্তু সেই ‘ম্যাজিক নম্বরে’র চেয়ে বিজেপি অন্তত ২৮ ধাপ পিছিয়ে।
এবার দেখা যাক জেডিইউ বা টিডিপি’র আসন সংখ্যা। ঠিক বিকাল পাঁচটায় নীতিশ কুমারের দল বিহারের ১২টি আসনে ও চন্দ্রবাবু নাইডুর দল অন্ধ্রের ১৬টি আসনে জিতেছে বা এগিয়ে আছে। অর্থাৎ এই দুই দলের ঝুলিতেও আসছে ঠিক ২৮ টির মতো আসন। ফলে এই দু’জনের সমর্থন পেলে তবেই বিজেপির পক্ষে অনায়াসে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গড়া সম্ভব হবে।
এরপর চিরাগ পাসোয়ানের লোক জনশক্তি পার্টি (৫ টিতে এগিয়ে), একনাথ সিন্ধের শিবসেনা (৬ টিতে এগিয়ে), জয়ন্ত চৌধুরীর রাষ্ট্রীয় লোকদলের (৪ টিতে এগিয়ে) মতো আরও কয়েকটি ছোট শরিক দলের সমর্থন পেয়ে গেলে সেই সরকার নিঃসন্দেহে আরও মজবুত হবে।
কিন্তু সরকার গড়ার চাবিকাঠি যে তারপরও চন্দ্রবাবু নাইড়ু ও নীতিশ কুমারের হাতেই থাকবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চন্দ্রবাবু নাইড়ুর রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বলে, বিজেপিকে ‘ল্যাজে খেলানোর’ ইতিহাস তার খুবই পুরনো। সেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় থেকে তিনি এটা করে আসছেন। বাজপেয়ীর বিজেপি সরকারকে সমর্থনের বদলে একের পর এক সুবিধা তিনি আদায় করেছেন, আবার একটা পর্যায়ে বিজেপির সঙ্গ ছাড়তেও দ্বিধা করেননি।
৭৪ বছর বয়সী চন্দ্রবাবু নাইড়ু নরেন্দ্র মোদির প্রায় সমবয়সী। তিনি হলেন অন্ধ্রের প্রবাদপ্রতিম চিত্রতারকা ও এককালের মুখ্যমন্ত্রী এন টি রামারাওয়ের (এনটিআর) জামাতা। কিন্তু নিজে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য বিখ্যাত শ্বশুরের সঙ্গে ‘রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা’ করতেও দ্বিধা করেননি। একটা সময় চন্দ্রবাবু ছিলেন অবিজেপি, অকংগ্রেস ‘তৃতীয় ফ্রন্টে’র শীর্ষ নেতা, আবার পরে চলে আসেন বিজেপি শিবিরে। মাঝে বহুদিন বিজেপিকে ছেড়ে দিলেও এবারে নির্বাচনের ঠিক আগে তিনি তেলুগু চিত্রতারকা পবন কল্যাণকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি’র হাত ধরেন।
কিন্তু ভোটের পরেও চন্দ্রবাবু বিজেপির সঙ্গেই থাকবেন তার কোনো গ্যারান্টি নেই। অন্তত তার ট্র্যাক-রেকর্ড তাই বলে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, ৭৩ বছর বয়সী নীতিশ কুমারের সম্পর্কেও প্রায় একই কথা খাটে। সেই ২০০৫ সাল থেকে গত আঠারো বছর ধরে তিনি একটানা বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে কখনও তার দল জেডিইউ এর বিধানসভায় গরিষ্ঠতা ছিল, কখনও আবার ছিল না। তাতে কিন্তু নীতিশ কুমারের মুখ্যমন্ত্রী থাকায় কোনো সমস্যা হয়নি। কখনও বিজেপির হাত ধরে, কখনও কংগ্রেস-আরজেডির মতো দলের হাত ধরে তিনি ঠিকই পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করে নিয়েছেন। গত এক দশকেই তিনি দুই বার বিজেপির হাত ধরেছেন এবং দুই বার আরজেডি-কংগ্রেস জোটের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। চন্দ্রবাবু নাইড়ুর পর রাজনীতির ‘সেরা পাল্টুরাম’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
বিজেপির সঙ্গে নীতিশ কুমারের শেষ সমঝোতা হয়েছে লোকসভা নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগেই। কিন্তু নির্বাচনের ফলে বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সেই সমঝোতা ভোটের পরও টিকবে- এমন নিশ্চয়তা নেই। কারণ চরিত্রটির নাম নীতিশ কুমার।

এখন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা অনেকগুলো সম্ভাবনার কথা বলছেন। যেমন-

এক.
বিজেপিকে সমর্থনের বিনিমিয়ে নীতিশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইড়– তাদের নিজ নিজ রাজ্যের জন্য (বিহার ও অন্ধ্র) হাজার হাজার কোটি টাকার বিশেষ অর্থনৈতিক প্যাকেজ দাবি করতে পারেন।

দুই.
বিজেপি তাদের দুই জনকেই উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদে আসার প্রস্তাব দিতে বাধ্য হতে পারে (যে পদে এক সময় ভারতে দেবীলাল বা লালকৃষ্ণ আদবানির মতো রাজনীতিকরা ছিলেন)। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক তো এমনও বলছেন- চন্দ্রবাবু বা নীতিশ বিজেপিকে সমর্থনের বিনিময়ে প্রধানমন্ত্রীর পদও দাবি করে বসতে পারেন।

তিন.
বিরোধীদের জোট ‘ইন্ডিয়া’ও এনডিএ থেকে এই দুই জনকে ভাঙিয়ে নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করতে পারে। শেষ পর্যন্ত যদি দেখা যায় এনডিএ ও ইন্ডিয়ার আসন সংখ্যা বেশ কাছাকাছি তাহলে এই সম্ভাবনা খুবই জোরালো। কারণ সে ক্ষেত্রে হয়তো নীতিশ ও চন্দ্রবাবু মিলে পাশা উল্টে দেওয়ারও ক্ষমতা রাখবেন।
ভারতীয় রাজনীতির এই দুই বর্ষীয়ান দিকপাল শেষ পর্যন্ত কী পদক্ষেপ নেবেন সে উত্তর কেবল তারাই জানেন। কিন্তু এই মুহূর্তে তারা দুজনই পাদপ্রদীপের নিচে। তাদের প্রতিটি পদক্ষেপে তীক্ষè নজর রাখছে কোটি কোটি ভারতীয়।