ব্যাটারি রিকশা এখন শহরজুড়ে বেপরোয়া, পুলিশ ক্লান্ত!

28

মনিরুল ইসলাম মুন্না

‘প্রতিদিন সকালে ডিউটি শুরু করি ব্যাটারি রিকশা জব্দ করে। তারা এমন বেপরোয়া যে, কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা তোয়াক্কা না করে ইচ্ছেমত মূল সড়কে দাপিয়ে চলছে। এতে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটায় কিশোর চালকরা। প্রতিদিনই জব্দ করছি, একদিনে ১০/২০ টার বেশি জব্দ করতে পারি না। ড্যাম্পিংয়েও অত জায়গা নেই। আর কী করা যায়, ভাই?’
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্রধান সড়ক, অলিগলিতে নিষিদ্ধ ব্যাটারি রিকশার এত দাপট কেন? জানতে চাইলে ট্রাফিক পুলিশের এক কর্মকর্তা এভাবেই হতাশা ব্যক্ত করলেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার দাবি, অবৈধ ব্যাটারি রিকশা জব্দ করলেই বিভিন্ন মহল থেকে তদবির শুরু হয়ে যায়।
ট্রাফিক পুলিশরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা চলাচলের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে চট্টগ্রামেও সে সুযোগের আশায় তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অথচ চালকরা এটা চিন্তা করছে না যে, ঢাকার মত সড়ক, রুট এবং এলাকা চট্টগ্রাম নগরীতে নেই। ঢাকার অনেক সড়কে রিকশা চলাচল পর্যন্ত নিষিদ্ধ, অথচ এখানে সবকিছু চলাচলের সুযোগ দেয়া আছে। এসব রিকশা এত বেশি বেড়েছে, যা কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। প্রতিদিন মূল সড়কে আসলেই পুলিশ সেগুলো জব্দ করার চেষ্টা করছে। কিন্তু একদিন পর ছাড়িয়ে নিয়ে তারা আবার দাপিয়ে বেড়ায় সড়কে।
দেখা গেছে, ব্যাটারি রিকশার বেপরোয়া চলাচলের কারণে নগরীর মূল সড়কে এখন রাস্তা পার হতেও পথচারীদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। এতে প্রতিদিন দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন পথচারীরা।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, ‘অবৈধ যান যাতে শহরে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। এরপর অভ্যন্তরীণ অবৈধ যানবাহনগুলো নিয়ে কাজ শুরু করবো।’
সরেজমিনে দেখা গেছে, উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও দিন ও রাত সমানতালে প্রধান সড়কগুলো থেকে শুরু করে অলি-গলি সর্বত্র ব্যাটারি রিকশার রাজত্ব। আর এসব ব্যাটারি রিকশার বেশিরভাগ চালকই শিশু-কিশোর। এই চালকরা রাতের শহরে বেপরোয়া গতিতে রিকশা তো চালাচ্ছেই, জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধেও। আবার এসব রিকশাকে স্থানীয় থানা পুলিশ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, নাম সর্বস্ব সাংবাদিক প্রশ্রয় দেয়াতে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে। পুলিশ জব্দ করতে চাইলে, তখন তার পরিচিত ব্যক্তিকে (পুলিশ, নেতা ও সাংবাদিক) মোবাইল ফোনে ধরিয়ে দেন। এতে নিরূপায় হয়ে অনেক অবৈধ রিকশাকে ছেড়ে দিতে দেখা গেছে।
রিকশা হিসেবে এসব যানবাহন স্বীকৃতি না পেলেও নগরীর আনাচে কানাচে এসব রিকশার দৌরাত্ম্য থামানো যাচ্ছে না। এসব অদক্ষ চালকদের অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যবহারিক শিক্ষা না থাকায় যাত্রীদের সাথে চালকদের ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। ভাসমান বহু অদক্ষ রিকশা চালকদের অনেকেই জোর করে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করার অভিযোগও রয়েছে।
যাত্রীদের অভিযোগ, শিশু-কিশোররা রিকশা চালানোর ক্ষেত্রে রাস্তার উভয়দিক, ডান-বাম, সাইট, ওভারটেক কিছুই চেনে না। তবুও তারা রিকশাচালক। তারা রাস্তায় অতি দ্রæত গতিতে রিকশা চালাতে গিয়ে বহু দুর্ঘটনাও ঘটিয়েছে।
বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকার বাসিন্দা ইফতেখার উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি সৈয়দ শাহ রোড থেকে বাকলিয়া এক্সেস রোডে আসতেই দুই-তিনটি রিকশা সামনে চলে আসে। কার রিকশায় উঠবো এ নিয়ে তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় লেগে পড়ে, এমনকি একজন আরেকজনের গায়ে হাত পর্যন্ত তুলে বসে। তাদের এমন আচরণ দেখে না উঠেও উপায় নেই, যেন সংঘবদ্ধ কিশোর গ্যাং। শুনেছি, তাদেরকে ছাত্রলীগ নেতা আজিজুর রহমান আজিজ নামে একজনে প্রশ্রয় দেন।’
বায়েজিদ এলাকার রিকশা চালক নঈম উদ্দিন বলেন, ‘আমি আগে মিনিবাসের কন্ডাক্টরি করতাম। তবে সেখান থেকে ব্যাটারি রিকশায় ইনকাম ভাল হয়। আর শ্রম দেয়া লাগে কম। তাছাড়া অল্প সময়ে বেশি টাকা আয় করতে পারি। দিনের বেলায় আমরা রিকশা চালালেও রাতের বেলায় বাকি রিকশা চালকরা মিলে মোবাইলে লুডু খেলি।’
যাত্রী ও প্যাডেল চালিত রিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, নগরীতে অসাধু রিকশা মালিক চক্র রাতের বেলা অবৈধভাবে সরকারি বিদ্যুৎ দিয়ে ব্যাটারি চার্জ করেন। এ রকম কয়েক হাজার গ্যারেজ রয়েছে নগরীর বিভিন্ন এলাকায়। এরা চুরি করে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলেও সে বিদ্যুতের বিল পরিশোধ করতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুকৌশলে এসব শিশু-কিশোরদের রিকশা চালাতে বাধ্য করে চক্রটি। যার কারণে পুলিশের চোখের সামনে পড়লেও গ্যারেজ মালিকদের সখ্যতার কারণে শিশু কিশোর চালকরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এতে দিন দিন শৃঙ্খলা হ্রাস পাচ্ছে এবং বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। অন্যদিকে অবৈধ বিদ্যুৎ আর রিকশা চলাচলের কারণে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
চট্টগ্রাম মহানগরীর প্যাডেল রিকশা মালিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. মুজিবুর রহমান বলেন, ‘চট্টগ্রাম নগরীতে প্যাডেলচালিত রিকশার সংখ্যা ৭০ হাজার ১টি। এসব রিকশা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে বাৎসরিক কর দেন ৭০ লক্ষ টাকার মত। অন্যদিকে, সরকারি কোন কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাটারি রিকশা চলছে। এতে সরকার রাজস্ব হারালেও স্থানীয় নেতা, থানা-ফাঁড়িকে ম্যানেজ করেই চলছে ব্যাটারি রিকশাগুলো।’
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশ কমিশনার ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র অবৈধ রিকশাগুলোকে জব্দ করার নির্দেশ দিলেও ট্রাফিক বিভাগ নামমাত্র আটক করছে। যেভাবে আটক করার কথা সেভাবে আটক না করে আটককৃত রিকশাগুলো একদিন পর জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে ব্যাটারি রিকশার চালক-মালিকদের মাঝে কোন পরিবর্তন আসছে না।’
এদিকে ধারণক্ষমতা না থাকার কারণে বেশিদিন জব্দ করে রাখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম নগর পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহাম্মদ পূর্বদেশকে বলেন, ‘ব্যাটারি রিকশার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি। মূল সড়কে উঠলেই আমরা জব্দ করে ড্যাম্পিং করছি। দিন দিন ব্যাটারি রিকশার দৌরাত্ম্য বাড়ছে এটা সত্য। নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে। এখানে আমরা জব্দ করলেই সমাধান আসবে না। আমদানিকারকদের এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। তারা যদি আনুষাঙ্গিক যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করে, তবে দৌরাত্ম্য কমে আসবে।’