ব্যাংকের লকার সিস্টেম এবং প্রসঙ্গ কথা

35

মোহাম্মদ শাহজাহান

গ্রাহকরা মূলত ব্যাংকের লকার ভাড়া করেন মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র এবং অলংকারসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র সংরক্ষণের জন্য।
এতদিন দেশের ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের কাছে ছোট ও মাজারি লকারের চাহিদা বেশি ছিলো। এখন দেখা যায় গ্রাহকরা ব্যাংকে বড় লকার ভাড়া নিচ্ছেন বেশি। ছোট এবং মাঝারি লকার ছেড়ে দিয়ে মূল্যবান জিনিসপত্র স্থানান্তর করছেন বড় লকারে।
স¤প্রতি দেশের একটি বেসরকারি ব্যাংকের লকার থেকে স্বর্ণ গায়েব হওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে যে যার মতো করে লিখে যাচ্ছেন। এখানে লকার সিস্টেমের বিষয়টা বেশিরভাগ মানুষ না জানার কারণেই এটাকে সাধারণ মানুষের কাছে ঘোলাটে করে যাচ্ছেন। এখানে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অভিযোগকৃত গ্রাহকের লকারে থাকা সম্পদের বিষয় এবং পরিমাণ সম্পর্কে না জানার কারণে বিভিন্ন সময়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য (সম্পদের পরিমাণ) প্রদানের বিষয়টিও উঠে এসেছে। মূলত লকার সম্পর্কে জানার বিষয়টা হচ্ছে- প্রতিটি লকার খোলার জন্য ২টি চাবির প্রয়োজন হয়। যার একটি গ্রাহক ও অপরটি ব্যাংকের নিকট থাকে। গ্রাহকের চাবি ব্যতীত শুধুমাত্র ব্যাংকে রক্ষিত চাবি দিয়ে কোনভাবেই লকার খোলা সম্ভব নয়। ব্যাংকিং নিয়ম অনুযায়ী গ্রাহককে তাঁর লকারের মূল চাবি বুঝিয়ে দেয়া হয়। লকারে রক্ষিত মালামাল ও তার পরিমাণ সম্পর্কে একমাত্র গ্রাহক ব্যতীত ব্যাংকার বা অন্য কোন ব্যক্তির জানার সুযোগ নেই। মোদ্দা কথা ভাড়াকৃত লকারে রাখা পণ্যের সমস্ত দায়-দায়িত্ব কিন্তু গ্রাহকের। গ্রাহকরা কী রাখছেন, ব্যাংকের পক্ষে তা দেখার অথবা যাচাই-বাছাই করারও কোনো প্রকার সুযোগ নেই। গ্রাহক ব্যাংকে গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তা চাবির দুটি অংশের সমন্বয়ে লকারের তালা খুলে থাকেন। গ্রাহক লকার ব্যবহারের সময় সেখানে কারো উপস্থিত থাকার কোনো সুযোগ নেই। তবে অনেকেরই অভিযোগ হচ্ছে, লকারে কী আছে সেটি দেখার সুযোগ না থাকায় অনেক গ্রাহক সেবাটির অপব্যবহার করছেন বলে রীতিমতো প্রশ্ন থেকে যায়। অভিযোগ আছে লকারে নগদ ডলারসহ বিদেশী মুদ্রা রাখা হচ্ছে। দেশে ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে লকারে বিদেশী মুদ্রা রাখার প্রবণতাও এক প্রকার ভূমিকা রাখছে বলে অনেকেই মনে করেন। তাছাড়া ডলার এবং স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র রাখার কারণেই মূলত ব্যাংকগুলোতে বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংক পর্যবেক্ষকরা। তবে এখানে সুস্পষ্ট যে, গ্রাহকরা লকারে কী রাখছেন, সেটি ব্যাংকের পক্ষে জানা সম্ভব নয় এবং জানার নিয়ম নেই। এক্ষেত্রে নীতিমালা হলো, লকারে থাকা জিনিসপত্রের দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ গ্রাহকের। এখন গ্রাহকরা যদি আইনে অনুমোদিত নয় এমন সব জিনিসপত্রও লকারে রাখেন তাহলে এখানে ব্যাংকারদের করার কিছুই নেই। এখন কোনো গ্রাহক যদি ডলারসহ আইন বিরুদ্ধী কোন সরঞ্জাম লকারে রাখেন, সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও কিছু করার নেই। দেশে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রায় সবগুলোরই লকার সেবা রয়েছে। তবে যেসব ব্যাংকের রিটেল সেবা বিস্তৃতি ও গ্রাহকের সংখ্যা বেশি, সেগুলো লকার সেবার দিক থেকে বেশ এগিয়ে রয়েছে। আমরা জানি স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের লকার সেবা দিয়ে আসছে এর মধ্যে গত দুই দশকে সেবাটি সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করেছে। এখানে জানার বিষয় হচ্ছে-লকারে কী আছে, সেটি অনুসন্ধান করতে চাইলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আদালতের অনুমতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের উপস্থিতিতে লকার খুলতে পারেন। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেরও (এনবিআর) এই ক্ষমতা রয়েছে। এখানে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের লকার সিস্টেমের কিছু তথ্য উল্লেখ্য করছি। ২০২১ সালে Reserve Bank of India ব্যাংকের লকারের ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন নিয়ম চালু করেছে। যা জানুয়ারি, ২০২২ সাল থেকে কার্যকর হয়েছিল। এই নতুন নিয়মের উদ্দেশ্যই হল, গ্রাহকদের মূল্যবান সম্পত্তি, গয়না, টাকাপয়সা যেন চুরি বা ডাকাতি না হয়।তবে কোনও গ্রাহক প্রতিবার লকার খোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংক মারফৎ ই-মেইল এবং এসএমএস গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যাবে। এই পদ্ধতির প্রধান কারণই হল, জালিয়াতি আটকানো। তাছাড়া ব্যাংক সর্বাধিক ৩ বছর কোনও গ্রাহককে লকার ভাড়া দিতে পারবে। এছাড়াও ভারতের কেন্দ্রীয় আরেকটি নিয়ম বাধ্যতামূলক করেছে। তা হলো- লকারে কারা আসছেন, যাচ্ছেন এবং সেই সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে ধরে রাখতে হবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে। এই ফুটেজ ৬ মাস পর্যন্ত সংরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করার নিয়ম রয়েছে। যাতে কোনো রকম জালিয়াতি, চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটলে পুলিশ সেই ফুটেজ দেখে সহজে তদন্ত করতে পারে।
ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ লকার সেবাটি এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। কেননা প্রতিবেশী ভারতে লকার সেবার বিষয়ে নীতিমালা জারি রয়েছে। এদিকে আমাদের বাংলাদেশে সেবাটির বিস্তৃতি হয়েছে একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের উপর ভর করে। লকার সেবাকে আরো বেশি নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত করতে হলে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দরকার। এর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক্ষেত্রে তদারকি বাড়ানো হলে দেশের ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি গ্রাহকরাও লকারের বিষয়ে সচেতন হবে।