ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতিক ছিলেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার এল.কে. সিদ্দিকী

11

মোহাম্মদ ইউসুফ

সাবেক মন্ত্রী ও ডেপুটি স্পীকার ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকীর আজ (১ আগস্ট ২০২৪) ১১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুবার্ষিকীতে রোটারি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অবিভক্ত জেলা গভর্নর প্রয়াত এল কে সিদ্দিকীর স্মৃতির প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।
আবুল হাসনাত লুৎফুল কবির সিদ্দিকী ওরফে এল কে সিদ্দিকী একজন ব্যতিক্রমধর্মী চরিত্রের নেতা ছিলেন। দল-মত-নির্বিশেষে সর্বমহলে তাঁর পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল। স্বাধীনতার পর বিগত ৫০ বছরে সীতাকুÐবাসী দু’জন মন্ত্রী পেয়েছিল। এদের একজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন-বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী মরহুম লায়ন এম আর সিদ্দিকী। আরেকজন হলেন তাঁরই আত্মীয় জিয়া সরকারের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার এল.কে. সিদ্দিকী। তিনি সীতাকুÐ এলাকা থেকে চার বার বিএনপি’র এমপি নির্বাচিত হন এবং দু’বার মন্ত্রী ও একবার ডেপুটি স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। এম.আর সিদ্দিকীর পর জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ছিলেন এল.কে. সিদ্দিকী। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর জাতীয় পর্যায়ে এখনও সীতাকুন্ডের আর কোনো রাজনৈতিকনেতা ওঠে আসেননি। ইঞ্জিনিয়ার এল. কে. সিদ্দিকী ছিলেন বিএনপি’র একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা। দলীয়গন্ডির বাইরেও তাঁর এখনো অসংখ্য ভক্ত-অনুরক্ত রয়েছে। দীর্ঘদিন দলীয় রাজনীতিতে নিষ্ক্রীয় থাকলেও সীতাকুন্ডের বিএনপি রাজনীতিতে তার প্রচন্ড প্রভাব ছিল। এখনও সীতাকুন্ড বিএনপিতে তার বহু অন্ধসমর্থক রয়েছে।
ইঞ্জিনিয়ার এল.কে. সিদ্দিকী ছিলেন একজন প্রথাবিরোধী ভিন্নপ্রকৃতির রাজনৈতিক নেতা। সকলপ্রকার অনিয়ম ও ঘুষ-দুর্নীতির বিপরীত শিবিরে ছিল তাঁর শক্তিশালী অবস্থান। শুধু কথা নয়, তিনি কাজে বিশ্বাসী ছিলেন। অত্যন্ত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ এ মানুষটি ছিলেন আকাশচুম্বি ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার মধ্যে কোনো ভন্ডামী ও বহুরূপিতা ছিল না। কথা-বার্তা ও আচার-আচরণে আভিজাত্যের প্রভাব থাকলেও তিনি যা বলতেন ; লুকোচুরি না করে স্পষ্টভাষায় বলতেন। ছলচাতুরি কিংবা মোসাহেবী তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না।
মিথ্যেআশ্বাস দিয়ে কাউকে ঘোরানোর বদাভ্যাস তাঁর ছিল না। মন্ত্রী-এমপি থাকাকালীন তিনি কখনও সন্ত্রাস,চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ কোনো অপকর্মকে প্রশ্রয় দিতেন না। নিজদলের সন্ত্রাসীরাও তাঁর কাছে যাওয়ার সাহস পেতো না। আশির দশকের গোড়ায় তিনি মাদক ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সীতাকুন্ডের বড়দারোগাহাট থেকে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী ম্যারাথন র‌্যালির আয়োজন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। দলীয় হাইকমান্ডের অন্যায়প্রস্তাবে সম্মত হননি বলে তাঁকে বিএনপি’র সর্বশেষ সরকারের মন্ত্রীত্ব পর্যন্ত হারাতে হয়- এমন জনশ্রুতিও রয়েছে। যেকোনো বিষয়ে নীতি-নৈতিকতার অবস্থান থেকে কখনো তিনি একচুলও নড়েননি। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ব্যতিক্রমধর্মী ও অনুকরণীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন।
ইঞ্জিনিয়ার এল. কে. সিদ্দিকী ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলার দক্ষিণ রহমতনগর গ্রামের সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবুল মনসুর লুৎফে আহমেদ সিদ্দিকী। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি সীতাকুন্ড আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে প্রথমবিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। ঢাকার আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারি- এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬০-৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি একই কলেজের ছাত্রসংসদের ভিপি ছিলেন। শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি প্রায় ৬ বছর গ্যামন্স ইস্ট পাকিস্তান লিমিটেড-এ কাজ করেন। অতপর তিনি ১৯৬৬Ñ৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘স্বল্পমূল্যে গৃহায়ন’ বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী হিসেবে লিবিয়ায় দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিপুলভোটে জয়লাভ করেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিদ্যুৎ,পানিসম্পদ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি সেচ, পানিসম্পদ ও বন্যানিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়ে প্রায় ৩ বছর তিনি অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২-৯৩ রোটাবর্ষে তিনি রোটারি ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট ৩২৮০ এর গভর্নর ছিলেন। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদেরও তিনি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন এবং জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকারের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ খ্রিস্টাব্দে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সমাজসেবায় শেরেবাংলাপদক, মাওলানা ভাসানী জাতীয় পুরস্কার ও স্বর্ণপদক লাভ করেন। তিনি আগ্রাবাদ মহিলা কলেজ, ভাটিয়ারি বিজয়স্মরণী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ ও সীতাকুন্ড বালিকা মহাবিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৯Ñ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, কোষাধ্যক্ষ, আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, দলীয় চেয়ারম্যানের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ও সর্বশেষ কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
এল.কে. সিদ্দিকীর তিনপুত্র ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। বড়ছেলে ব্যারিস্টার আফফান আহমেদ সিদ্দিকী, মেঝছেলে কানাডাপ্রবাসী আর্কিটেক্ট আকসিন আহমেদ সিদ্দিকী ও ছোটছেলে আমেরিকাপ্রবাসী আইটি ইঞ্জিনিয়ার এহলান আহমেদ সিদ্দিকী আর একমাত্র মেয়ে জাপানপ্রবাসী ইবতেসাম সিদ্দিকী ওরফে মুনা সিদ্দিকী।
লেখক: প্রধান-সম্পাদক
সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম