বেড়েছে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা

9

মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছে। গত জুন শেষে হাতে রয়েছে তিন লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার মতো। ওই সময় পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ২১ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। মাত্র ছয় মাস আগে গত ডিসেম্বর শেষে যা ছিল ২ লাখ ৭৭ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। গত ৬ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মানুষের হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বৃদ্ধির মোটাদাগে তিনটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ধারাবাহিক উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে সব পর্যায়ে খরচ বেড়েছে। ফলে মানুষের হাতে তুলনামূলক বেশি টাকা রাখতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা ব্যাংকে জমা হয় কম। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা কয়েকজন ব্যক্তির দুর্নীতি সামনে আসায় অনেকে সতর্ক হয়ে হাতে টাকা ধরে রাখতে পারেন। তৃতীয়ত, ব্যাংকে জমা টাকা সময়মতো ফেরত পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে আস্থাহীনতার কারণে একটি অংশ নিজের কাছে রাখতে পারেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী সার্কুলেশনে থাকা নোটের মধ্যে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সারাদেশে ১১ হাজারের মতো ব্যাংক শাখার ভল্টে ১৫ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকার মতো আছে। বাকি ৩ লাখ ৩ থেকে ৩ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার মতো রয়েছে নিজের কাছে, ঘরের আলমারি, সিন্দুক কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ঈদকে কেন্দ্র করে সব সময় মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকে। গত জুনের মাঝামাঝি ছিল ঈদুল আজহা। ঈদের আগে ১৩ জুন বৃহস্পতিবার সার্কুলেশনে থাকা টাকার পরিমাণ বেড়ে ৩ লাখ ২৫ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকায় ওঠে। সাধারণত সব সময় ঈদের পরের সপ্তাহে আবার প্রচুর টাকা ব্যাংকে ফেরত আসে। তবে এবার এ ক্ষেত্রে ধীরগতি দেখা যাচ্ছে। ঈদের পরের দুই সপ্তাহে ব্যাংকে ফিরেছে মাত্র ৪ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। গত রোজার ঈদ কেন্দ্র করে গত ১১ এপ্রিল সার্কুলেশনে ছিল ৩ লাখ ৫ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা। তবে কয়েক দিনের ব্যবধানে ২৫ এপ্রিল তা কমে ২ লাখ ৯১ হাজার ১৪২ কোটি টাকায় নামে। পরের সপ্তাহে আরও কমে ২ মে ২ লাখ ৮৮ হাজার ১৯৭ কোটি টাকায় নেমেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ঈদ কেন্দ্র করে সব সময় সার্কুলেশন বাড়ে। তবে ঈদের পরই তা আবার দ্রæত ব্যাংকে ফেরত আসে। এবার টাকা ফেরত আসছে কম। অথচ ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন ডিজিটাল লেনদেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্যাশলেস প্রচারণাসহ বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে নগদ টাকা রাখার প্রবণতা কমার কথা।
দীর্ঘদিন ধরে অনলাইন মাধ্যমে লেনদেন বাড়ানোর চেষ্টা করছে সরকার। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মোট লেনদেনের অন্তত ৭০ শতাংশ ‘ক্যাশলেস’ করার ঘোষণা দিয়েছে। ক্যাশলেস হলে একদিকে ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি কমে, অন্যদিকে টাকা ছাপানোর খরচ বেঁচে যায়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ায় অনিশ্চয়তা থেকে মানুষ নিজের কাছে বেশি করে নগদ টাকা রাখতে পারে। এমনিতেই ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে। এ অবস্থার উন্নয়ন করতে না পারলে ব্যাংকগুলো সরকারি-বেসরকারি খাতে চাহিদা মতো ঋণ দিতে পারবে না। তিনি বলেন, পরিস্থিতি উত্তোরণের জন্য আস্থা ফেরানো খুব জরুরি। আর এ জন্য সবার আগে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সমঝোতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মে পর্যন্ত এক বছরে ব্যাংক খাতের আমানত ৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ বেড়ে ১৭ লাখ ৬০৮ কোটি টাকা হয়েছে। সা¤প্রতিক কোনো বছরে এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি। তবে ছাপা টাকার পরিমাণ রয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো। সাধারণত আমানতের বেশির ভাগ হয়ে থাকে অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, সা¤প্রতিক পরিস্থিতির কারণে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। এই পরিসংখ্যান পরে পাওয়া যাবে। কেননা, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন ব্যাংক বন্ধ ছিল। নিরাপত্তাজনিত কারণে বেশির ভাগ এটিএম বুথ বন্ধ রাখা হয়। আবার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় ডিজিটাল লেনদেন হয়নি। অস্থিরতার কারণে বাড়তি সতর্কতা হিসেবে অনেকেই এখন তুলনামূলক হাতে বেশি টাকা রাখেন বলে তিনি মনে করেন।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে টানা পাঁচ দিন বন্ধ থাকার পর গত ২৪ জুলাই বুধবার থেকে সীমিত পরিসরে ব্যাংক লেনদেন শুরু হয়। ওই দিন ব্যাংকে টাকা জমার চেয়ে উত্তোলন হয় অনেক বেশি। সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো এক দিনেই ধার করে ২৯ হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধারের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৫২১ কোটি টাকা।