বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের কর্মবিরতি অচলাবস্থা সৃষ্টি করে দাবি আদায় কাম্য নয়

2

সরকার সকল শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য সার্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে। গত বছর এ এ স্কিম সীমিত আকারে চালু করলেও এবছর সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ের সকল শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য চালু করা হয়েছে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দও রাখা হয়েছে। তবে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য চালু করা হয়েছে ‘প্রত্যয়’ নামের পেনশন কর্মসূচি। যা ১ জুলাই থেকে চালু করা হয়েছে। বাজেটে এ নিয়ে প্রস্তাবনা আসার পর থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারিরা প্রত্যয় পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে পৃথক পৃথকভাবে সভা-সমাবেশ করে আসছে। গত সোমবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহবানে পূর্ণদিবস ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি পালন করেছে। ফেডারেশনের এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের কর্মচারি ফেডারেশনও। জানা যায়, দেশের ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়েছে। শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন সার্বিকভাবে আন্দোলন মনিটরিং করছেন। ফেডারেশনের সভাপতি আকতারুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, প্রত্যয় পেনশন স্কিম প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত তাদের আন্দোলন চলবে। তিনি জানান, এ আন্দোলন শুধু তাদের জন্য নয়, নতুন প্রজন্মের যেসব মেধাবী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশায় আসবে তাদের জন্যই করছি। অপরদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে-স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা এবং তাদের অধীন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানগুলোর চাকরিতে ১ জুলাই থেকে যারা যোগ দেবেন, তাদের জন্য এ কর্মসূচি প্রযোজ্য হবে। এক্ষেত্রে ওইসব প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান পেনশন ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে। তবে এ কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সুবিধা ‘কমবে’ এমন আশঙ্কায় ব্যবস্থাটি প্রত্যাহারের দাবিতে শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু করেছেন।
জানা গেছে, ‘প্রত্যয়’ পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা (দুটির মধ্যে যেটি কম) বেতন থেকে কেটে নেওয়া হবে। এর সঙ্গে সমপরিমাণ অর্থ প্রদান করবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা। এই অর্থ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিপরীতে সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের অ্যাকাউন্টে জমা হবে। যেমন, এ স্কিমে ৩০ বছর মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে একজনের বেতন থেকে যাবে ৯ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর মোট চাঁদা হবে ১৮ লাখ টাকা। জমাকৃত অর্থের পরিমাণ ও মেয়াদের ভিত্তিতে অবসরকালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী পেনশন ভোগ করবেন। সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি যদি ৭৫ বছর বয়সে মারা যান, তাহলে অবসরের ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা তার জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ। বলা হচ্ছে, এই পেনশন কর্মসূচি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় এর অর্থ আয়করমুক্ত, শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ।
তবে সিদ্ধান্তটিকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়ে এর বিরোধিতা করছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন। তাদের বিরোধিতার জায়গাটি অবশ্যই খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তাদের বক্তব্যের যৌক্তিকতা বিবেচনা করা দরকার। আমরা লক্ষ করে আসছি, গত দু’মাসে বেশ কয়েক দফা কর্মবিরতিও পালন করেছেন তারা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, সোমবার থেকে এ কর্মবিরতি অনির্দিষ্টকালের জন্য শুরু হয়েছে। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধসহ ‘প্রত্যয়’ স্কিম প্রত্যাহারে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বেশ কয়টি কর্মসূচি দিয়েছে। এর আগের দিনও পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করেন তারা। শিক্ষকদের এ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে কর্মচারিরাও আন্দোলনে নামছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন করে সেশনজট তৈরির শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ শঙ্কার যৌক্তিকতাও রয়েছে, কারণ গত দু’মাসে শিক্ষকরা কর্মবিরতি পালন করলেও পূর্বনির্ধারিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এবারের কর্মসূচিতে ক্লাস, পরীক্ষা ও দাপ্তরিক কর্মকাÐ বন্ধ রয়েছে। বন্যাসহ নানা কারণে এমনিতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একাডেমিক ক্যালেন্ডার পিছিয়ে গেছে, তার ওপর শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি যে শিক্ষার্থীদের পাঠগ্রহণকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা বলাই বাহুল্য। আমরা মনে করি, শিক্ষকরা তাদের ন্যায্য পাওনা আদায় কিংবা অন্যায্য যেকোন কিছুর জন্য আন্দোলন করতেই পারেন, তবে তা যেন শিক্ষা কার্যক্রম অচল করে না হয়। আমরা যতটুকু জেনেছি, আন্দোলনকারি শিক্ষকরা সরকারের কোন পর্যায়ে কারো সাথে কোনরকম আলোচনা না করেই আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েছেন অথবা সরকারের তরফ থেকেও শিক্ষকদের সাাথে কোন যোগাযোগ হয়নি। আমরা মনে করি, প্রত্যয় পেনশন স্কিমের ব্যাপারে কারো আপত্তি থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ বের করা উচিৎ। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে শিক্ষা কার্যক্রমে অচলাবস্থা সৃষ্টির মত আন্দোলন মোটেই কাম্য নয়। এরপরও বলা যায়, এ পেনশন স্কিম আসলেই বৈষম্যমূলক কিনা কিংবা এর মাধ্যমে শিক্ষিত জাতি গড়ার কারিগরদের সুযোগ-সুবিধা আসলেই হ্রাস পাচ্ছে কিনা, তা শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের খতিয়ে দেখা উচিত। আশার কথা, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। আমরা আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার আশু সমাধান হবে। শিক্ষকদের দাবির ন্যায্যতা থাকলে তা বিবেচনা করবে সরকার-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।