বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য

5

কমরুদ্দিন আহমদ

২২শে শ্রাবণ, আজ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী। বাংলা ১৩৪৮ সালের বাইশে শ্রাবণ (ইংরেজি ৭ আগস্ট-১৯৪১) কলকাতায় পৈতৃক বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, গীতিকার,প্রাবন্ধিক আরো কতকী! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১২৬৮ বাংলা সালের পঁচিশে বৈশাখ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মা সারদা সুন্দরী দেবী। রবীন্দ্রনাথের পূর্বপুরুষেরা খুলনা জেলার রূপসা উপজেলার পিঠাভোগে বাস করতেন। মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকেন। সংগঠন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সংগীতজ্ঞ, প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ভাষাবিদ, চিত্রশিল্পী-গল্পকার।
আট বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৮৭৪ সালে ‘তত্ত¡াবোধিনী পত্রিকা’য় তার প্রথম লেখা কবিতা ‘অভিলাষ’ প্রকাশিত হয়। অসাধারণ সৃষ্টিশীল লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে সমসাময়িক বিশ্বে তিনি খ্যাতি লাভ করেন। লিখেছেন বাংলা ও ইংরেজি ভাষায়। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় তার সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের পাঠ্যসূচিতে তার লেখা সংযোজিত হয়েছে। ১৮৭৮ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কবিকাহিনী’ প্রকাশিত হয়। এ সময় থেকেই কবির বিভিন্ন ঘরানার লেখা দেশবিদেশে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পেতে থাকে। ১৯১০ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থে’র ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
লেখালেখির পাশাপাশি তিনি ১৯০১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর থেকে তিনি সেখানেই বসবাস শুরু করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২১ সালে গ্রামোন্নয়নের জন্য ‘শ্রীনিকেতন’ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্বভারতী’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে, পাবনা, নাটোরে এবং উড়িষ্যায় জমিদারিগুলো তদারকি শুরু করেন কবি। শিলাইদহে তিনি দীর্ঘদিন অতিবাহিত করেন। এখানে জমিদার বাড়িতে তিনি অসংখ্য কবিতা ও গান রচনা করেন। ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে সপরিবারে কবি বোলপুরে শান্তিনিকেতনে চলে যান।
১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। কবি দুই হাজার গান রচনা করেছেন। অধিকাংশ গানে সুরারোপ করেন। তার সমগ্র গান ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে’ রয়েছে। কবির লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত। ভারতের জাতীয় সংগীতটিও কবির লেখা।
জীবিতকালে তার প্রকাশিত মৌলিক কবিতাগ্রন্থ হচ্ছে ৫২টি, উপন্যাস ১৩, ছোটগল্পের বই ৯৫টি, প্রবন্ধ ও গদ্যগ্রন্থ ৩৬টি, নাটকের বই ৩৮টি। কবির মৃত্যুর পর ৩৬ খÐে ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ প্রকাশ পায়। এছাড়া ১৯ খÐের রয়েছে ‘রবীন্দ্র চিঠিপত্র।’ ১৯২৮ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত কবির আঁকা চিত্রকর্মের সংখ্যা আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে এক হাজার ৫৭৪টি চিত্রকর্ম শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভবনে সংরক্ষিত আছে। কবির প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী দক্ষিণ ফ্রান্সের শিল্পীদের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে প্যারিসের পিগাল আর্ট গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হয়।
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। বাংলা সাহিত্যের আধুনিকায়নে তার ভূমিকা অপরিসীম। তিনি বাংলা সাহিত্যে ইউরোপিয়ান সাহিত্যের বিভিন্ন উপাদান এনে বাংলা সাহিত্যের নবায়ন করেছেন এবং বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে বাংলা সাহিত্যের একটি নতুন মাত্রা দাঁড় করিয়েছেন। আজকের এই নিবন্ধটিতে আমি আপনাদের কাছে বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করবো :
বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক অবদান রয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা। দীর্ঘ ১২ বছর পারিবারিক জমিদারির কাজে শিয়ালদহ ও শাহজাদপুরে থাকাকালীন সময়ে তিনি ‘ আমার সোনার বাংলা ‘ কবিতাটি লিখেন। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প রচয়িতা এবং বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তার লেখনীতে বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটেছে। তার ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলোর সমতুল্য।
তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন। অভিলাষ তার প্রথম প্রকাশিত পত্রিকা।১২৮৪ বঙ্গাব্দে মাত্র ১৬ বছর বয়সে ” ভিখারিনী ‘ গল্প রচনার মাধ্যমে ছোটগল্প লেখক হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে। এরপর থেকে তিনি জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৪ বছরে তিনি অখÐ গল্পগুচ্ছে সংকলিত ৯৫ টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। এর বাইরেও “সে “, “গল্পসল্প” এবং “ লিপিকা” গ্রন্থে’ রয়েছে তার আরও গল্প সংকলিত হয়েছে।
“মুসলমানির গল্প” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সর্বশেষ গল্প। পারিবারিক জমিদারি তদারকির সূত্রে বাংলাদেশে বসবাসের সময়টি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার স্বর্ণযুগ। “সোনার তরী” কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলোও তিনি একই সময়ে রচনা করেছেন। গল্পকার হিসেবে তিনি যেমন বরেণ্য , ঔপন্যাসিক হিসেবেও বাংলা সাহিত্যে তার স্থান সুনির্দিষ্ট। তার রচিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে “চোখের বালি”, “গোরা”, “ চতুরঙ্গ” , “ ঘরে- বাইরে”, “ শেষের কবিতা”, “যোগাযোগ” বাংলা উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।
বাংলা নাটক রচনার ক্ষেত্রেও রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠত্ব অবিসংবাদিত। তার রচিত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হলঃ “রাজা”,”অচলায়েতন”, ”ডাকঘর “, “ মুক্তধারা”, “ রক্তকরবী ”।
মাত্র ১৫ পনেরো বছর বয়সে তার প্রথম কাব্য “ বনফুল” প্রকাশিত হয়।”গীতাঞ্জলি“ এবং অন্যান্য কাব্যের কবিতার সমন্বয়ে স্ব-অনূদিত “ ঝড়হম ঙভভবৎরহমং” গ্রন্থে’র জন্য ১৯১৩ সালে প্রথম এশীয় হিসেবে তিনি নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। বাংলা ছোটগল্পের তিনি পথিকৃৎ ও শ্রেষ্ঠ শিল্পী। “ মানসী”, “সোনার তরী”, “চিত্রা”, “ক্ষণিকা” , “ বলাকা” , “ পুনশ্চ “, “ জন্মদিনে “, “শেষ লেখা “, তার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ।
বাংলা গানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান :
বাংলা সাহিত্য আর গান একটি অন্যটির পরিপূরক। সাহিত্য ছাড়া গান অচল। ভালমানের কবি- সাহিত্যিকরাই গান লিখে থাকেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক গান লিখেছেন। তার এই গানগুলো আজ ও গাওয়া হয়। বাংলা চলচ্চিত্রে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অনেক গান রয়েছে। বাংলা গানে তার অবদান অনস্বীকার্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কিছু বিখ্যাত সঙ্গীত রয়েছে সেগুলো হল।
আমার হিয়ার মাঝে, মাঝে মাঝে তব, ভালবেসে সখি নিভৃতে, তুমি রবে নিরবে, মম চিত্তে নিতি নিত্তে, দারিয়ে আছো তুমি আমার, আমি তোমার সঙ্গে, মনোমোর মেঘের সঙ্গী, আমারো পরানোও যাহা চায়,খোলা হাওয়া, তুই ফেলে এসেছিস কারে, সকল দুখের প্রদীপ, যখন পারবে না মোর, শ্রাবণের ধারার মতো, একলা চল রে, তোমার অসীমে, সেদিন দুজনে, হঠাৎ দেখা, ও যে মানে না মানা, পুরনো সেই দিনের কথা, কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, আমি চিনিগো চিনি তোমারে, আমার রাত পোহাল, যে রাতে মোর দুয়ারগুলি, চোখের আলোয় দেখছিলাম, একটুকু ছোঁয়া লাগে, আগুনের পরশমণি, প্রাণ ভরিয়ে তৃষ্ণা হরিয়ে, পাগল হাওয়ায় বাদল দিনে, মায়াবন বিহারিণী, ভালোবাসি ভালোবাসি, প্রাণ যায় চক্ষু না চায়, তুমি রবে নিরবে, মায়াবন বিহারিণী, দাঁড়িয়ে আছো তুমি গানেরও ওপারে, জাগরণে যায় বিভাবরি, প্রেমেরও জোয়ারে, আধেকো ঘুমে নয়ন চুমে, আমার ভিতর ও বাহিরে, সখি ভাবনা কাহারে বলে, তোমার হল শুরু আমার হল সারা, চোখে আমার তৃষ্ণা, আমার রাত পোহাল, আমার মল্লিকা বনে ইত্যাদি।
বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখা এই কবি ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট ( ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ এ শ্রাবণ) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার ৮০ বছরের জীবনে ৫২ টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮ টি নাটক, ১৩ টি উপন্যাস, ৯৫ টি ছোট গল্প, ১৯১৫ টি গান, ৩৬ টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্য সংকলন করেছেন। উনি ২০০০ টির বেশি ছবি একেছেন। ওনার লেখা দুটি গান দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। বাংলা সাহিত্যের সকল শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন।
তিনিই প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি। তিনি বহুমুখি প্রতিভার অধিকারী। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, উপন্যাসিক, সঙ্গীতকার, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তিনি বাঙালির গর্ব। বাংলা সাহিত্যে তার এই অতুলনীয় অবদানের জন্য দুই বাংলার কোটি কোটি বাঙালি শ্রদ্ধার সাথে তাকে আজীবন স্মরণ করবে।

লেখক : কবি ও গবেষক, কলেজ শিক্ষক