বিপ্লব পরবর্তী রাষ্ট্রীয় সংস্কার

11

অমল বড়ুয়া

রাষ্ট্রহীন মানুষ প্রথমে সংগ্রাম করেছিল খাদ্য-সংগ্রহ ও হিংস্র জীবজন্তু আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আত্মরক্ষার্থে। কারণ, তখনও মানবজীবন ছিল অসহায় ও দীনহীন। আর দশলক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাসদের আগুন আবিষ্কার মানুষকে সাহসী ও প্রত্যয়ী করেছিল, যা মানবসভ্যতাকে আধুনিকতার দিকে এগিয়ে নিতে বড় ভূমিকা রেখেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে আফ্রিকায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠে হোমো স্যাপিয়েন্সরা আর পঞ্চাশ হাজার বছর আগে থেকে আচরণগত আধুনিকতার প্রমাণ দিতে শুরু করে তারা। এক সময়ের এই যাযাবর মানুষ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হয়ে গড়ে তোলে সমাজব্যবস্থা। খ্রিস্টপূর্ব ১৩ হাজার অব্দে নিওলিথিক বিপ্লবের সাথে সাথে শুরু হয় উৎপাদনমুখী পশুপালন ও কৃষি উৎপাদন। তারও কিছু পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে মিশরে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রব্যবস্থা। ভারত-উপমহাদেশে রাষ্ট্র উদ্ভবের প্রাক-পর্ব ধরা হয় খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ থেকে ৬০০ অব্দের বৈদিকযুগকে। অর্থাৎ রাষ্ট্রের আদি রূপের আবির্ভাব ঘটে পরবর্তী বৈদিক যুগে। এটি হল পূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রাক-পর্ব বা রাষ্ট্রপ্রতিম রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা প্রায়-রাষ্ট্র (Proto-state) পর্ব। রাষ্ট্রের আবির্ভাব ঘটল আরও পরে দ্বিতীয় নগরায়নের পর্বে খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৪০০ অব্দে। রাষ্ট্র ছিল তখন রাজার হস্তগত, তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই ছিল শেষ কথা। রাজা স্বৈরচারি হলে প্রজারা বিদ্রোহ করতো, অধিকার আদায়ে বিপ্লব করতো। তাই বলা যায় বিপ্লব মানব ইতিহাস জুড়ে ঘটেছে। এর ফলে মানুষের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিকাশ ও অগ্রগতিতে বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
আধুনিক সভ্যতায় তখনই বিপ্লব সংঘটিত হয় যখন জনসাধারণ চলমান শাসক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন, পরিমার্জন সাধনের জন্য বিদ্রোহ করে। কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সামাজিক সম্পর্কসমূহের গুণগত পরিবর্তনকেই বিপ্লব আখ্যা দিয়েছেন। বাংলা ‘বিপ্লব’ কথাটার মানে ‘বিপরীত দিকে গমন করা’। বিপ্লব শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে গৃহিত যার মূল অর্থ বিপরীত দিকে লাফ দেওয়া। বিপ্লবের সাথে বিকল্পের রয়েছে দারুণ মিথস্ক্রিয়া। এরিস্টটলের কথায় সেই বিকল্পের সন্ধান পাই। এরিস্টটল দুই ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লবের কথা বলেছেন- প্রথমত: এক সংবিধান থেকে অন্য সংবিধানে পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন এবং দ্বিতীয়ত: একটি বিরাজমান সংবিধানের সংস্কার। সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য বিপ্লবের প্রথম সূত্রপাত ঘটে ১২১৫ সালে ব্রিটেনে রাজা বা রাণীর ক্ষমতা সীমিত করার জন্য, যা ‘ম্যাগনা কার্টা’ নামে পরিচিত। ১৬৮৮ সালের নভেম্বর মাসে ইংল্যান্ডে ঘটে আরেকটি বিপ্লব, যার নাম ‘গ্লোরিয়াস রেভুল্যুশন’। রাজা তৃতীয় জেমস পদত্যাগ করলে তাঁর মেয়ে দ্বিতীয় মেরি ও তাঁর ডাচ স্বামী স্ট্যাডহোল্ডার উইলিয়াম (তৃতীয়) অফ অরেঞ্জকে ক্ষমতায় বসাবার মধ্য দিয়ে এই বিপ্লব ঘটেছিল। ইংল্যাÐে বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৮৮৮ সালে।
১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বিপ্লব অর্থে ‘রেভুল্যুশন’ শব্দটির ব্যবহার শুরু হয়। চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে গ্রহ-নক্ষত্রের আবর্তন বা ঘোরা অর্থে ইংরেজিতে Revolution ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। ত্রয়োদশ শতক থেকে ফরাসি ভাষায় revolucion কথাটির ব্যবহার ছিল। ‘সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার আকস্মিক পরিবর্তন’ অর্থে ‘রেভুল্যুশন’ শব্দটি ১৬৮৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা পায়। রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের আহবানে বিপ্লবের সূত্রপাত হতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। ১৭৬০ সালে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয় ব্রিটেনে, যা চলমান ছিল ১৮৪০ সাল পর্যন্ত। আমেরিকান বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৭৭৬ সালে; ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই বাস্তিল দুর্গ পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসী বিপ্লবের শুরু। এই বিপ্লবের মাধ্যমে প‚র্বের রাজতন্ত্রের প্রথা ভেঙ্গে প্রজাতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ক্যাথলিক চার্চের গোঁড়ামি ভেঙ্গে নিজেদের পুনর্গঠন করতে বাধ্য হয়। ফরাসি বিপ্লবের মূলনীতি ছিল- ‘স্বাধীনতা, সমতা, ভ্রাতৃত্ব’। ১৯১৪ সালের ২৮শে জুন অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্দের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। হত্যাকারী গাভরিলো প্রিন্সিপ নামের ছাত্রটি ছিলেন ‘তরুণ বসনিয়া’ দলের সদস্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরী শাসন থেকে মুক্তিই ছিল যাদের লক্ষ্য। যুদ্ধের পর সবাই ভেবেছিল- এমন মানবসৃষ্ট দুর্যোগের আর পূনরাবৃত্তি ঘটবে না, কিন্তু বিজয়ী ও পরাজিত শক্তিগুলো এমন সব কান্ড করতে থাকে যা সদ্য সমাপ্ত যুদ্ধের চেয়ে ভয়াবহ এবং পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরী করেছিল। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।
১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে রাশিয়ার শেষ জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনের অবসান ঘটে। ১৯১৭ সালে অক্টোবরের বিপ্লবের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে উৎখাত করে বলশেভিক সরকার গঠিত হয়। এর পরের কয়েক বছর বলশেভিকদের সাথে বলশেভিক বিরোধীদের গৃহযুদ্ধে জয়ী হয়ে বলশেভিকরা ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠন করে। ১৯১৮ সালে জার্মান বিপ্লব সংঘটিত হয়। মূলত: ১৯১৮ সালে যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এর উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রতিক্রিয়ার ফলে নাৎসি পার্টির আবির্ভাব ঘটে। নাৎসি পার্টি ১৯৩০-এর দশকে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে। ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে হাঙ্গেরিয়ান প্রজাতন্ত্র বিপ্লবের কারণে উল্টে যায় এবং হাঙ্গেরিয়ান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র তৈরি হয়। এই সব বিপ্লবের কারণ ছিল পশ্চিমা দেশসমূহের জাতপাত ও আভিজাত্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যে বিভক্ত নিশ্চল সমাজব্যবস্থা। এই বিভক্ত সমাজকে কার্ল মার্কস নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্র’; মার্কসের মতে, জীবন ছিল নিয়তির হাতে ছেড়ে দেওয়া উদ্যমহীন মর্যাদাহীন, আটকে পড়ে থাকা উদ্ভিদমার্কা জীবন। এই বিপ্লব শুধু ইউরোপ আমেরিকায় সীমাবদ্ধ ছিলনা। এর প্রভাব এশিয়াকেও সংক্রমিত করেছিল। ১৯৪৫ সালের আগস্টে ঘটে ভিয়েতনাম বিপ্লব। ১৯৪৮ সালে বিপ্লবের ছোঁয়ায় বিভক্ত হয়ে যায় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া। ১৯৪৫ সালে মাও সে তুং-এর নেতৃত্বে চীনে সংঘটিত বিপ্লবের রেশ ধরে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জন্ম হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী ভারতীয়দের বিপ্লবের মুখে ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তির পরাজয় ঘটে। মূলতঃ ১৭৫৭ সালে এই ব্রিটিশরা বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে (মীরজাফর গংদের সহযোগিতায়) দুইশ বছর শোষণ-শাসনের মাধ্যমে ভারতবাসীকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল।
১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবা-বিপ্লবের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্রী শাসক ফুলগেনসিও বাতিস্তার পরাজয় ঘটে এবং ফিদেল ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন প্রবর্তিত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে বিপ্লব ঘটিয়ে নয় মাস যুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে ‘ইসলামী বিপ্লবের’ মাধ্যমে ইরানি জনগণ প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো ইরানি রাজতন্ত্রকে উৎখাতের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক-শক্তির জন্ম দেয়। সব বিপ্লবে জড়িয়ে আছে জনগণ।
জনগণ অর্থ কেবল একশ্রেণির জনগোষ্ঠি নয়। জাত, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, শ্রেণি, লিঙ্গ, আচার, ব্যবহার, ভাষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি নানান ভাবে বিভক্ত সকল জনগণ। সকল প্রকার সামাজিক বৈচিত্র্যের ঊর্ধ্বে নিজেদের একক ও অখন্ড রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি হিসাবে জনগণ রাষ্ট্রের মালিক; রাষ্ট্রের ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’র অধিকারী। রাজনৈতিক পরিমন্ডলে সামাজিক বৈচিত্র ও পরিচয় মুখ্য নয়- হোক তা ধর্মীয়, ভাষাগত অথবা সাংস্কৃতিক। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে জনগণই হলো প্রধান ও মুখ্য। তাই জনগণের মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা উপভোগে কোনো দল বা গোষ্ঠী তা রাজনৈতিক হোক বা ধর্মীয়, বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তা বিপরীত মতাদর্শের হলেও। আর এতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেই জনগণ বিদ্রোহ-বিপ্লবে সর্বাত্মক সংস্কারের দিকে ধাবিত হয়।
জনগণের রাজনৈতিক বিপ্লব বা গণতান্ত্রিক বিপ্লব রাষ্ট্রযন্ত্রের একচেটিয়া শাসনব্যবস্থাকে খোলনলচে পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘সার্বভৌম ক্ষমতা’ জনগণের হাতে ফিরিয়ে আনে। জনগণই রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস বলার অর্থ নিজেদের ঐক্য ও অখন্ডতা রক্ষার জন্য একটি গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে ‘জনগণ’ একটি ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠি’ হিসাবে নিজেদের অস্তিত্বকে ঘোষণা করে একটি সর্বজনীন রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে হাজির হয়। একচেটিয়া শাসনব্যবস্থা হতে বিলুপ্ত নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও আদর্শকে পুনঃস্থাপনে সর্বাত্মক বিপ্লব কার্যকর ভূমিকা রাখে। এই সর্বাত্মক বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সাতটি বিষয়- সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, আদর্শগত বা বুদ্ধিবৃত্তিক, শিক্ষামূলক এবং আধ্যাত্মিক। এই বিষয়গুলোকে পরিকল্পনা মাফিক ধীরে তবে দৃঢ়তার সাথে পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের দ্বারা রাষ্ট্রের সংস্কার ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে হয়। রাগ-অনুরাগ, হিংসা-প্রতিহিংসা ভুলে এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় সকল অংশীজনকে সম্পৃক্ত করতে হয়। কাউকে বাদ দিয়ে বা পেছনে রেখে রাষ্ট্রীয় সংস্কার সম্ভব নয়।
সংস্কার একটি চলমান ও ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, এর চলমানতা বজায় রাখতে হবে। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজের সামগ্রিক পরিবর্তন সময়সাপেক্ষ। তড়িগড়ি রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন সাধন করা গেলেও মানুষের মন ও দৃষ্টিভঙ্গী এবং সেই সঙ্গে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয় না। যার ফলে রাজনৈতিক বিপ্লবের সুফলগুলো সাময়িক আকার ধারণ করে অর্থাৎ দীর্ঘ মেয়াদী সুফল পাওয়া যায় না। ফলে সংস্কার এমনভাবে হতে হবে যাতে এর প্রভাবে নাগরিক হৃদয়, দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়ে সর্বপ্রকারের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্য অপসারিত হয়। ব্যক্তির বোধ-বোধি ও মননকে সকল বাধা, নিষিদ্ধ প্রবৃত্তি ও বিবেচনা থেকে মুক্ত রাখতে হবে। যাতে মানসিক প্রক্রিয়া এমনভাবে সুবিন্যস্ত হয় যে ব্যক্তি নিজে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেগুলির অপসারণে উদ্যোগ নেয়।

লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক