বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ও মধ্যবিত্তের আতঙ্ক

3

লিটন দাশ গুপ্ত

দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম শহরের বাসায় পোস্টপেইড মিটারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে আসছি। তবে বর্তমান বাসাটিতে বছর দুয়েক যাবৎ প্রিপেইড মিটারের মাধ্যমে অগ্রীম বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হচ্ছে। বিদ্যুতের প্রিপেইড বিল প্রদান অনেকটা মোবাইল কার্ড রিচার্জের মত। প্রতিবার রিচার্জে ২০ টি সংখ্যা চেপে, মিটারে অগ্রীম টাকা ঢুকাতে হয়, যে ভাবে মোবাইলে টাকা ঢুকাতে হয়। কিš‘ মাঝে মধ্যে দেখা যায় ২০ টি সংখ্যার বদলে ১৮০ টি সংখ্যা প্রবেশ করাতে হয় মিটারে। যেমন- চলতি বছর শুরুতে পরপর দুই বার রির্চাজ করতে হয়েছে ১৮০ টি সংখ্যা দিয়ে। এছাড়া গত বছর প্রথম তিন মাস প্রতিবার একইভাবে ১৮০ টি সংখ্যার সাহায্যে রিচার্জ করতে হয়েছে। প্রথম দিকে বুঝতাম না মাঝে মধ্যে হঠাৎ করে, কেন এত বেশী সংখ্যার সাহায্যে রিচার্জ করতে হয়। পরে বিরক্ত হয়ে অন্য জনের সাথে কথোপকথনে জানতে পারলাম, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে, বর্ধিত হারে প্রথম বার টাকা রিচার্জ করতে গেলে এত বেশী সংখ্যা চাপতে হয়। বলছিলাম বিরক্ত হয়ে অন্যজন থেকে জানতে পারলাম! এখানে বিরক্ত হবার কারণ হলো বর্ধিত হারে বিদ্যুৎ বিলে এতগুলো সংখ্যা নির্দ্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একের পর এক চাপতে গিয়ে কতবার সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তার হিসাব নাই। বলতে গেলে একবারে সফলতা অর্জন সহজে আসেনি! প্রতিবার সাহায্য নিতে হয়েছে পরিবারের অন্য সদস্য বা প্রতিবেশী কারো না কারো কাছ থেকে। কারণ এখানে ১৮০ টি সংখ্যা বাটনের সাথে আরো ১৫/২০ টি এন্টারবাটন আর ব্যাকস্পেস বাটনে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চাপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন কারণে ভুল হয়ে থাকে বা ভুল হবার সম্ভাবনা থেকে থাকে। তাই অতি সতর্কতা অবলম্বন করে রিচার্জ কাজটি সম্পন্ন করতে হয়। সতর্কতা অলম্বন করতে হয় এই জন্যে, পরপর তিন বার সঠিক সংখ্যার নম্বর চাপতে ব্যর্থ হলে মিটার লক হয়ে যায়। আর এইভাবে লক হয়ে, কত গ্রাহক জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে বা সমস্যায় পড়েছে ভুক্তভোগী মানুষগুলো দেখে বুঝতে পেরেছি ও জানতে পেরেছি। এমনকি ভুল হবার কারণে অনেক জনকে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স নিতে হয়েছে। আবার একাধিক বার ব্যালেন্স নিয়ে আর রিচার্জ করতে গিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় প্রচন্ড গরমে ফ্যান ছাড়া, রাতের আঁধারে আলো ছাড়া থাকতে হয়েছে বা বিদ্যুৎ অফিসে সরাসরি গিয়ে যোগাযোগ করে হয়রানি হতে হয়েছে। যদিও পোস্টপেইড মিটারে এতসব ঝামেলা নাই। তবে পোস্টপেইড মিটারের গ্রাহকগণ প্রিপেইড মিটারের গ্রাহকের মত এত সহজে বুঝতে পারেনা, কখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, না হচ্ছে!
যাইহোক মূল বিষয়ে আসি, যে কথা বলছিলাম বেশী সংখ্যা চেপে প্রিপেইড মিটারে রিচার্জ করতে গেলে বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি হওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। যা গত বছর থেকে অনেকবার করতে হয়েছে; এর মানে অনেকবার বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন আবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভর্তুকির চাপ সামলাতে প্রতি তিন মাস অন্তর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করা হবে। অর্থাৎ বছরে চার বার বিদ্যুতের দাম বাড়াবে, যা আগামী তিনবছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল বা আইএমএফ এর পরামর্শক্রমে নাকি এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর ক্ষেত্রে প্রচুর অর্থ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে এটা আমরা অনেকেই জানি। যদিও জ্বালানীর ক্ষেত্রে এখন আর ভর্তুকি দিতে হচ্ছেনা। অন্যদিকে গত অর্থ বছরগুলোতে বিদ্যুতখাতে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় ৪০-৪৫ হাজার কোটি টাকা করে। বর্তমানে পাইকারি হিসাবে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য প্রায় ৭ টাকা। এখন আইএমএফ এর পরামর্শ অনুযায়ী ভর্তুকি প্রত্যাহার করতে গেলে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়বে ১২ টাকার বেশী। অন্যদিকে পাইকারি পর্যায়ে ১২ টাকা হলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম হবে প্রায় ১৫ টাকা। সেই হিসাবে বাসাবাড়িতে যেমন বিদ্যুতের দামে বাড়তি টাকা গুনতে হবে, অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পাবে। এমনিতে বর্তমান সময়ে দ্রব্যমূল্যের যে উর্দ্ধগতি তা কেবল মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তের ক্ষেত্রে নয়, সর্বস্তরের নাগরিকের দূর্বিষহ জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এইদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কৃষি, ব্যবসা বাণিজ্য, শিল্প কলকারখানায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শিল্প কলকারখানায় উৎপাদনের ধারা অব্যাহত রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে বেশী। সেই হিসাবে বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণে উৎপাদন খরচ আরো বৃদ্ধি পাবে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে অনেক পণ্যের দামও বৃদ্ধি পাবে। যার চাপ বা প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। আগেই বলেছি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের হাতের নাগালের বাইরে। যেমন- চালডাল নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, জীবন রক্ষাকারী ঔষধ, গণপরিবহনের ভাড়া, নগরকেন্দ্রিক বা শহরাঞ্চলের বাড়ি ভাড়া বাড়ানো, সন্তানের শিক্ষাখাতে ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদিসহ পারিবারিক বিভিন্ন চাহিদার খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর আবার প্রতি তিন মাস পরপর বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির সাথে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসহ উল্লেখিত সকল সামগ্রীর ব্যয় বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এইভাবে বৃদ্ধির সমস্যা একশ্রেণির উ”চবিত্তের মানুষ অনুভব করতে না পারলেও নি¤œ মধ্যবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যগণ একেবারে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে।
এইদিকে ভর্তুকির পরিমাণ হ্রাস করতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ছাড়া অন্যকোন বিকল্প নাই বলা হলেও বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি প্রকৃত সমাধান নয়। তাঁদের মতে বিদ্যুৎ খাতে অনিয়ম, অপচয় রোধ, সুচিন্তিত পরিকল্পনা আর দুর্নীতি মুক্ত করে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ অনেকাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। অন্যদিকে চাহিদা না থাকলে বিভিন্ন জায়গায় একের পর এক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে এই খাতে খরচ আরো বেড়ে যাচ্ছে। এই যেমন- বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মেঘাওয়াট। অথচ উৎপাদন করে সরবরাহ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার মেঘাওয়াট। অবশিষ্ট বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বসিয়ে রাখা হয়েছে মানে অনেক খরচ চলমান রয়েছে। এইভাবে অনেকগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিষ্ক্রিয় বসিয়ে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে গ্রাহকের উপর বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ চাপিয়ে সমন্বয় করা হয়েছে। এখানে বৃদ্ধির পরিবর্তে সমন্বয় বলছি এই জন্যে, আমরা বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি বললেও সরকারের পক্ষ থেকে মূল্য বৃদ্ধি না বলে সমন্বয় করা বলে থাকে। আর সমন্বয় হোক কিংবা মূল্যবৃদ্ধি হোক; দ্রব্যমূল্যের দূর্দিনে গ্রাহকের যাতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা না হয়, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি ভালো ভাবে ভেবে বিবেচনা নিবেন, সেই আশা রাখি।

লেখক: লিটন দাশ গুপ্ত (শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক)