বিগত দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং এশিয়ার অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতি

8

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

মানব সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়। প্রতিটি দেশ কঠোর পরিশ্রমের ভেতর দিয়ে নিজ নিজ দেশকে উন্নয়নের চরম শিখরে নিয়ে গেছে। আসলে উন্নয়নের শেষ কোথায়? কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যের নিরিখে উন্নত অর্থনীতির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হলেও এ সংজ্ঞার পরিবর্তন এসেছে। যখন একাধিক দেশের সাথে একটি দেশের অর্থনীতিকে তুলনা করা হয় তখন যে দেশের অর্থনীতিতে বসবাসরত মানুষেরা অধিকভাবে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সেই দেশের অর্থনীতিকে উন্নত অর্থনীতি বলা হয়। আবার আধুনিক প্রযুক্তিতেও পরিবর্তন এসেছে। যেমন- প্রত্যাহিক জীবনে যখন মানুষ গাড়ী, টেলিভিশন, ফ্রিজ, কম্পিউটার, মোবাইল ইত্যাদি ব্যবহার করতো না বা এসব পণ্য আবিষ্কার হয়নি তখনও বলা হতো যে ইউরোপের দেশগুলো হয় উন্নত। অর্থাৎ ইউরোপের অর্থনীতি হয় উন্নত। কাজেই বলা যায়, নির্দিষ্ট সময়ে বিদ্যমান দেশগুলোর সাথে পরস্পর তুলনামূলক যে দেশেগুলো বা যে সব দেশের অর্থনীতি এগিয়ে থাকে সেই দেশগুলো উন্নত দেশ বা সে সব দেশের অর্থনীতি উন্নত। অন্যভাবে বলা যায়, এগিয়ে থাকা দেশগুলো উন্নত।
সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির দ্রæত উন্নতি ঘটেছে। এগিয়ে থাকা দেশগুলো আরো এগিয়ে গেছে। আর পিছিয়ে থাকা দেশগুলো বা অনুন্নত দেশগুলো কোন কোন সময় প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে, আবার কোন কোন সময় প্রযুক্তিকে এড়িয়ে গেছে। তবে যে সব দেশ প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে সেই সব দেশ অনুন্নত থেকে উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে গেছে। এরূপ একটি দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে ও নব্বই এর দশকে প্রযুক্তিকে গ্রহণ করতে চায়নি বাংলাদেশ। এজন্য খেসারতও দিতে হয়েছে। এশিয়ার প্রতিটি দেশ আধুনিক প্রযুক্তিকে গ্রহণ করার সাথে সাথে আর্থ-সামাজিক অবস্থারও পরিবর্তন করেছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে এশিয়ার অনেক দেশ আশানুরূপভাবে এগিয়ে যেতে পারেনি। এদিক থেকে বাংলাদেশ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে আছে।
এশিয়া মহাদেশের কিছু উন্নত দেশকে বাদ দিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে ছিল দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশ। আর অনুন্নত দেশগুলোর মধ্যে ছিল মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভূটান, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশ। উন্নয়নশীল দেশগুলো খুবই দ্রæত উন্নত দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর অনুন্নত দেশগুলোও উন্নয়শীল দেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। যদি ১৯৭১ সালকে স্টাডিং পয়েন্ট হিসেবে মনে করা হয় তবে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ কতটুকু এগিয়ে যেতে পেরেছে তা বুঝার জন্য বাংলাদেশের সাথে ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ভূটান ও ভিয়েতনামের তুলনা করলে স্পষ্ট দেখা যাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই মাথাপিছু জিডিপি (Gross Domestic Product-GPD) তে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আনবিক শক্তির দুইটি দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। বিগত দুই দশক ধরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অনেক ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, নারীর ক্ষমতায়ন, সাক্ষরতার হার ইত্যাদির ন্যায় অনেক বিষয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। IMF (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে টানা চার বছর ধরে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে। আর টানা আট বছর ধরে পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। এদেশের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এখন ২ হাজার ৬২১ ডলার। আর ভারতের মাথাপিছু মোট দেশজ উৎপাদন ২ হাজার ৬১২ ডলার, পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৭১ ডলার। এ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৬ সাল থেকে। ২০১৬ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ১ হাজার ৬৫৯ ডলার। আর এসময়ে পাকিস্তানের জিডিপি ছিল ১ হাজার ৪৬৮ ডলার। ২০২০ সালে এসে ভারতকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে ভারতের জিডিপি ছিল ১ হাজার ৮৭৭ ডলার। আর এ সময়ে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ১ হাজার ৮৮৮ ডলার। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর হিসাব অনুযায়ী, পাকিস্তান থেকে মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশের (২,৬২১-১৪৭১) = ১১৫০ ডলার এবং ভারত থেকে (২,৬২১-২,৬১২) = ৯ ডলার বেশি।
বিগত দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অগ্রগতির সুফল মিলেছে। কোভিডের আগ পর্যন্ত স্থিতিশীলভাবে অর্থনীতি এগিয়ে গেছে। শুধু মাথাপিছু আয় নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নসহ অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়েছে। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা প্রয়োজন। মাথাপিছু জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি দেশের নির্দিষ্ট সময়ে নিজ দেশের অভ্যন্তরে যত টাকার উৎপাদন ও সেবা সৃষ্টি হয়, তাকে এদেশের মোট জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করলে মাথাপিছু জিডিপি পাওয়া যায়। এই মাথাপিছু জিডিপিতে প্রবাসীদের আয় সহ দেশের বাইরের আয় যোগ হয় না। আর যদি দেশের অভ্যন্তরে মোট উৎপাদন ও সেবার সাথে প্রবাসীদের আয় ও দেশের বাইরের আয় যুক্ত হয়ে মোট যে পরিমাণ আয় পাওয়া যায় ঐ পরিমাণ আয়কে সংশ্লিষ্ট দেশের জনসংখ্যা দ্বারা ভাগ করা হলে মাথাপিছু আয় পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসেবে, বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয়ের ৯৬ শতাংশই আসে দেশের অভ্যন্তর থেকে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ৩১৬ ডলার। আর ২০২২-২৩ অর্থ বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় হয় ২ হাজার ৬২১ ডলার। গত এক দশকে মাথাপিছু আয় প্রায় দ্বিগুণ করেছে বাংলাদেশ। আবার ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকেও বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করা যায়। একটি দেশের মানুষ কতটা সম্পদশালী, তা বোঝার জন্য ক্রয়-ক্ষমতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়। নিজের আয় দিয়ে একজন ব্যক্তি কী কী জিনিস কিনতে পারেন তা দেখা হয় ক্রয় ক্ষমতার ভিত্তিতে। এজন্য ক্রয় ক্ষমতার সমতাকে বিবেচনা করা হয়। ইহাকে ক্রয়ক্ষমতার সমতা বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি (PPP) বলে। এই PPP এর ভিত্তিতে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। আর ভারতের চেয়ে পিছিয়ে আছে। মাথাপিছু জিডিপিতে বাংলাদেশ, ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে- তা খুবই খুশীর ব্যাপার। এটি উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ সূচক, কিন্তু একমাত্র নয়। মাথাপিছু আয় সমভাবে বণ্টিত হয়েছে কিনা, মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, রপ্তানি, অবকাঠামো ইত্যাদিও উন্নয়নের সূচক হিসেবে বিবেচনায় আনতে হয়। কিন্তু এসব সূচকের দিক থেকে বাংলাদেশ ভারত থেকে পিছিয়ে আছে।
গড় আয়ুর দিক থেকে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ দশমিক ৪ বছর। আর ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর এবং পাকিস্তানে ৬৯ বছর। তাছাড়া মোট শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ, ভারতে ২৩ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২০ শতাংশ।
এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও এশিয়ার অন্য একটি দেশ ভিয়েতনামের চেয়েও পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আর ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৭৫ সালে। অথচ ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের মাথাপিছু গড় আয় ৪ হাজার ৩১৬ ডলার। মাত্র ১০ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে ভিয়েতনামের অর্থনীতির আকার বিশ্বের ৩৭ তম। আর ১৭ কোটি মানুষ নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ৪১ তম। ভিয়েতনামে শিক্ষার হার ৯৬.১ শতাংশ, বাংলাদেশে ৭৪ শতাংশ। ভিয়েতনামে দারিদ্র্যের হার ২.৯৩ শতাংশ, বাংলাদেশে ১৮.২ শতাংশ। ভিয়েতনামে মূল্যস্ফীতি ৩.৫৯ শতাংশ, বাংলাদেশে ৯.৪৯ শতাংশ। ভিয়েতনামে বেকারত্ব ২.৩০ শতাংশ আর বাংলাদেশে ৫ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে ৪ বছর পর স্বাধীনতা পেয়েও ভিয়েতনাম আমাদের তুলনায় এগিয়ে গেছে। অবশ্য বর্তমান ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে বাংলাদেশে উন্নয়নও দ্রুত গতিতে বাড়বে। ২০৪১ সালের পূর্বেই বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছে যাবে।

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, ইউএসটিসি