বায়ুদূষণ: প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা

5

অমল বড়ুয়া

বর্তমান বিশ্ব পরিবেশ দূষণের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সম্মুখীন। পরিবেশ দুষণ বলতে বায়ু, পানি, মাটি, শব্দদুষণের বিষয়কে নির্দেশ করে। আর এর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর ও মারাত্মক দূষণ হচ্ছে বায়ু। কারণ, বায়ু ছাড়া জীবন অকল্পনীয়। জীবের শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়া ব্যাহত হলেই জীবন মৃত্যু শঙ্কায় নিপতিত হয়। তাই জীবনের জন্য অপরিহার্য এই বায়ুদূষণ মানবজাতির জন্য অশনি সংকেত। বায়ুদূষণ হল বায়ুমন্ডলে এমন সব পদার্থের উপস্থিতির কারণে হওয়া দূষণ যা মানুষ এবং অন্যান্য জীবের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, কিংবা জলবায়ু বা পদার্থের ক্ষতি করে। বায়ুদূষণ বায়ুমন্ডলের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে পরিবর্তন করে দেয়। বায়ুদূষণ বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি, অ্যালার্জি থেকে শুরু করে এমনকি মানুষের মৃতু্যুর কারণ হতে পারে; এটি প্রাণী এবং খাদ্য ফসলের মতই অন্যান্য জীবন্ত প্রাণীর, প্রাকৃতিক পরিবেশ বা মানবসৃষ্ট কৃত্রিম পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে। মানুষের ক্রিয়াকলাপ এবং প্রাকৃতিক ঘটনা উভয়ের কারণে বায়দুষণ হতে পারে। বায়ু দূষণের কারণ হতে পারে-গাড়ি ও কল-কারখানা থেকে নির্গত ধোয়া, জ্বালানি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কার্বন-মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, মহাজাগতিক ধুলিকণা, অগ্ন্যিৎপাতের ফলে নিঃসৃত সালফার-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। বায়ুদূষণের অনেক প্রভাবক বা উৎস একইসঙ্গে গ্রীনহাউজ নির্গমনেরও উৎস, যেমন- জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো।
বায়ুদূষণ শ্বাসনালির সংক্রমণ, হৃদরোগ, দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি, স্ট্রোক এবং ফুসফুসের ক্যান্সার সহ দূষণজনিত বেশ কয়েকটি রোগের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য ঝুঁকির কারণ। বায়ুদূষণের সংস্পর্শে আইকিউ স্কোর বা বুদ্ধ্যঙ্ক হ্রাস, মেধার দুর্বলতা, মানসিক ব্যাধি যেমন বিষন্নতা এবং প্রসবকালীন ক্ষতিকারক স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। কেবল জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বহিঃস্থ বায়ুদূষণের ফলে বছরে ৩ দশমিক ৬১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে, যা এটিকে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান নিয়ামক করে তুলেছে, এর মধ্যে কেবল অ্যানথ্রোপোজেনিক ওজোন এবং পিএম ২ দশমিক ৫ এর কারণে ২ দশমিক ১ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বস্তুকণা পিএম-২ দশমিক ৫ হলো বাতাসে থাকা সব ধরনের কঠিন ও তরল কণার সমষ্টি, যার বেশির ভাগই বিপজ্জনক। মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক বিভিন্ন ধরনের রোগ যেমন-প্রাণঘাতী ক্যানসার ও হৃদযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে পিএম-২ দশমিক ৫। ডবিøউএইচও বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইন বলছে, পিএম ২ দশমিক ৫ নামে পরিচিত ছোট ও বিপজ্জনক বায়ুকণার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। তবে এর চেয়েও কম ঘনত্ব উল্লেখযোগ্য স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের অনেক শহরের বাতাসে এসব কণার মারাত্মক উপস্থিতি রয়েছে। এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনাল সাময়িকীতে প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্ব জুড়ে প্রায় ১৩ কোটি ৫০ লাখ মানুষের অকালমৃত্যুর সঙ্গে ঐ সূ² কণার সম্পর্ক রয়েছে।
এনটিইউ বলেছে, দূষণ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় ঐ সময়ের মধ্যে বিশ্বে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে এশিয়ায়। ১৯৮০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এশিয়ায় এসব ঘটনায় ৯ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি মানুষের অকালমৃত্যুতে ভ‚মিকা রেখেছে পিএম- ২ দশমিক ৫ দূষণ; যাদের বেশির ভাগই মারা গেছেন চীন ও ভারতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, শুধু বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বিশ্ব জুড়ে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। সিংগাপুরের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টির বায়ুর গুণমান ও জলবায়ুর ওপর চালানো এই গবেষণাকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিস্তৃত ও বৃহৎ পরিসরের বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ এই গবেষণায় এনটিইউর গবেষকেরা স্বাস্থ্যের ওপর বস্তুকণা-২ দশমিক ৫-এর বিশাল প্রভাবের চিত্র হাজির করতে প্রায় ৪০ বছরের ডেটা ব্যবহার করেছেন।
বায়ুদূষণ প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটায়, বা ৬১ দশমিক ৬ বছরের বৈশ্বিক গড় আয়ু হ্রাস (এলএলই) ঘটায়। ২০০৮ সালের ব্ল্যাকস্মিথ ইনস্টিটিউট বিশ্বের সবচেয়ে দুষিত স্থানের প্রতিবেদনে ঘরের ভেতরে বায়ুদূষণ এবং নিম্নমানের শহুরে বায়ুর গুণমানকে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ বিষাক্ত দূষণ সমস্যা হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার ২ শতাংশ কিছুটা পরিমাণে হলেও নোংরা বাতাসে শ্বাস নেয়। বায়ুদুষণের কারণে উৎপাদনশীলতা হ্রাস এবং জীবনমানের অবনতি হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বছর ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে বলে অনুমান করা হয়।
২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে চীনে বিভিন্ন সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি এবং ডিভাইস উৎপাদন ও নির্মাণ খাত মোট বায়ুদূষক নির্গমনের ৫০ শতাংশ এর বেশি দখল করে রেখেছে। বায়ুদূষণের নৃতাত্তি¡ক তথা মানব সৃষ্ট উৎসসমূহ হলো- জীবাশ্ম-জ্বালানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং বায়োমাস পাওয়ার প্ল্যান্ট যা বৃহৎ পরিসরে ধোঁয়া উৎপন্ন করে থাকে, কাঠ, ফসলের বর্জ্য এবং গোবরের মতো প্রথাগত বায়োমাস ও নগর বর্জ্য পোড়ানো। তাছাড়া অপরাপর মানব সৃষ্ট যে উৎস রয়েছে সেগুলো হলো- রং, চুলের স্প্রে, বার্নিশ, অ্যারোসল স্প্রে এবং অন্যান্য দ্রাবক থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া। এগুলো দুষণের জন্য যথেষ্ট হতে পারে; ২০১০-এর দশকে লস অ্যাঞ্জেলেস অববাহিকায় উদ্বায়ী জৈব যৌগ থেকে সৃষ্ট দুষণের প্রায় অর্ধেক দূষণের উৎস ছিল এসব সামগ্রী। পারমাণবিক অস্ত্র, বিষাক্ত গ্যাস, জীবাণু যুদ্ধ এবং রকেট জাতীয় সামরিক সম্পদগুলোও দূষণে দায়ী। কৃষিজাত নির্গমন এবং মাংস উৎপাদন বা পশুসম্পদ থেকে নির্গমন বায়দুষণে যথেষ্ট অবদান রাখে। মোটর গাড়ি, সামুদ্রিক জাহাজ এবং বিমান সেইসাথে রয়েছে রকেট এবং এসবের উপাদান ও ধ্বংসাবশেষের পুনঃপ্রবেশ, নিষ্কাশন গ্যাস এবং গাড়ির বায়ুদূষণ বাহ্যিকতা থেকে বাতাসে প্রবেশ করে। এগুলো আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রধান নিয়ামকও। অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো বৃক্ষ-নিধন। বায়ুদুষণের প্রাকৃতিক উৎস সমূহ হলো- পৃথিবীর ভূত্বকের মধ্যে তেজস্ক্রিয় ক্ষয় থেকে সৃষ্ট রেডন গ্যাস; দাবানল থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং কার্বন মনোক্সাইড; প্রাকৃতিক উৎস থেকে ছড়ানো ধুলো।
বায়ুদূষণ সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ মেট্রোপলিটন এলাকায় অধিক হয়, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যেখানে শহরগুলো দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পরিবেশগত বিধিমালা তুলনামূলকভাবে শিথিল বা একেবারেই নেই। নগরায়নের ফলে দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মমন্ডলীয় শহরগুলোতে মানবসৃষ্ট বায়ুদূষণের কারণে অকাল মৃত্যুহার দ্রুত বৃদ্ধি পায়। অর্গানাইজেশন ফর ইকোনিমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেনট (ওইসিডি)-এর মতে, ২০৫০ সালের মধ্যে বহিঃস্থ বায়ুদূষণ (কণা পদার্থ এবং সমতল স্তরের ওজোন) বিশ্বব্যাপী পরিবেশগতভাবে সম্পর্কিত মৃত্যুর শীর্ষ কারণ হয়ে উঠবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। আর বায়ুদূষণজনিত এই অপমৃত্যু প্রতিরোধে দরকার সচেতনতা। এই বিশ্বের বুকে মানুষসহ সকল জীবকে সুরক্ষায় বায়ুদূষণজনিত পরিবেশ দুষণরোধে কার্যকর ভুমিকা পালনে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো মানবজীবন মারাত্মক বিপদে পড়বে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট