বান্দরবানের পর্যটনে ধস

7

মো. শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান

পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএফ) নামক সশস্ত্র সন্ত্রাসী তৎপরতায় অশান্ত বান্দরবান। গেলো ২২ সালে ১৮অক্টোবর থেকে কেএনএফ সন্ত্রাসী কর্মকান্ড শুরু করে। প্রায়ই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে কেএনএফের পাল্টাপাল্টি গুলির ঘটনা ঘটছে। কেএনএফ আর নিরাপত্তা বাহিনীর বন্দুকযুদ্ধে সেনা সদস্য নিহত হন। তবে গেলো মাসের ৬এপ্রিল থেকে বান্দরবানের রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি উপজেলায় চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান। কারণ গেলো ২-এপ্রিল বান্দরবানের রুমা সোনালী ব্যাংকে ডাকাতি, ম্যানেজারকে অপহরণ, মসজিদে হামলা এবং পুলিশের অস্ত্র লুটের ঘটনা এবং ৩ এপ্রিল দুপুরে বান্দরবানের থানচি উপজেলার সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় এ পর্যন্ত ৯টি মামলায় ২৫জন নারীসহ ৮৭জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।তবে ৬এপ্রিল থেকে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচিতে চলছে যৌথবাহিনীর অভিযান এবং এখনও চলমান রয়েছে।যার ফলে ভয়ে আর আতংকে পর্যটক শূন্য হয়ে পড়ছে বান্দরবানে। তবে পাহাডে বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কর্মকান্ডের কারণে চলমান পরিস্থিতিতে পর্যটকরা বান্দরবান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।এতে করে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটন সংশ্ল্ষ্টি ব্যবসায়ীদের মাঝে দেখা দিয়েছে চরম হতাশা। ধস নেমেছে বান্দরবান জেলার পর্যটন শিল্পে। ছাড়াও গেলো ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিতেও হোটেল-মোটেলগুলো ছিল না বুকিং এবং বান্দরবানের দর্শনীয় স্থানগুলো ছিল পর্যটক শূন্য।
এদিকে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বান্দরবানের হানাহানির নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সংগঠনের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং চাঁদাবাজির দ্ব›দ্ব। এদের মধ্যে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস), জনসংহতি সমিতি (জেএসএস সংস্কার), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ), ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক),মগ পার্টি ও কেএনএফ অন্যতম। বিশেষ করে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় কেএনএফের দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। সীমান্তবর্তী রুমায় কেএনএফ প্রশিক্ষণকেন্দ্র গড়ে তুলেছে বলেও জানিয়েছেন অনেকে। সম্প্রতি ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে আটজন কেএনএফ সদস্য নিহত হওয়ায় তারা কিছুটা পিছু হটেছে। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে,গেল ২২ সালে ১৮অক্টোবর প্রথম কেএনএফের সঙ্গে সেনাবাহিনীর রুমা উপজেলার মৌয়াছিপাড়ায় গোলাগুলি হয়। এতে এক সেনাসদস্য নিহত হন। অক্টোবর থেকে যৌথ অভিযানে ২ কেএনএফ সদস্য এবং কেএনএফের গুলিতে মগ পার্টির তিনজন নিহত হন। গত ১২ মার্চ কেএনএফের গুলিতে সেনাবাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন এবং দুই সেনাসদস্য আহত হন। ৭এপ্রিল ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক গ্রুপের গুলিতে কেএনএফের আট সদস্য নিহত হন।৭মে রুমা উপজেলার দূর্গম দার্জিলিং পাড়ায় গোলাগুলিতে কেএনএফের ১ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়।এর আগে গত ২৮ এপ্রিল রুমা উপজেলার রেমাক্রী প্রাংসা ইউনিয়নের জঙ্গলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে কেএনএফের গোলাগুলিতে ২জন সশস্ত্র সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয়েছিল। ২২ এপ্রিল রুমা উপজেলার দুর্গম মুনলাই পাড়ায় সেনাবাহিনী সঙ্গে গোলাগুলিতে কেএনএফের ১জন সশস্ত্র সদস্যের মারা যায়। এসময় ঘটনাস্থল থেকে কেএনএফ সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্যবহৃত বিপুল পরিমাণে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়।
অপরদিক পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বান্দরবানের রুমা,থানচি ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় পর্যটন স্পটগুলো পর্যটকদের আকর্ষনীয় হলেও কেএনএফ এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে এবং যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান থাকায় ভয়ে আর আতংকে পর্যটকের দেখা মিলছে না এবং পর্যটকেরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবে জেলার নীলাচল, মেঘলা, প্রান্তিক লেক, নীলগিরিসহ অন্যান্য পর্যটন স্পটগুলো খোলা থাকলে নেই কোন পর্যটক। ব্যবসায়ীরা আরোও জানান, কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) কর্তৃক রুমা ব্যাংক ডাকাতি, পুলিশের অস্ত্র লুট, থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংক ডাকাতির পর থেকে সন্ত্রাসীদের ধরতে পাহাড়ে যৌথবাহিনীর অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ে পর্যটক না আসার কারণে বিপাকে পড়েছে এখানকার হোটেল মোটেল, পর্যটকবাহী পরিবহণ সংশ্লিষ্ট এবং পর্যটন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছে- করোনার পর থেকে নানা কারণে বান্দরবানে পর্যটন ব্যবসার ধস নেমেছে। করোনার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে প্রায় দেড় বছর পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা, ভয়াবহ বন্যা এখন ব্যাংক ডাকাতি সব মিলিয়ে পর্যটন শিল্প এখন শূন্যের কোটায়। বান্দরবানের নীলাচল পর্যটন কেন্দ্রের ব্যবসায়ী মঙ্গল তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, গত দুই তিন বছর পর্যটন মৌসুমে পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক আসছে না। পর্যটকরা আমাদের মেহমান। তাদের কাছে বিভিন্ন কিছু বিক্রয় করে আমরা আমাদের সংসার চালাতে হয়। বেশি কিছুদিন পর্যটক নেই, কী করবো বুঝে উঠতে পারছি না। শৈলপ্রভাতের ফল মূল দিয়ে বিভিন্ন রকম আইটেম বিক্রি করেন রতন বম। তিনি বলেন, পর্যটক না আসার কারণে আমাদের জীবন যাত্রা থমকে গেছে, শুক্র-শনিবার প্রচুর পর্যটক থাকার কথা কিন্তু নেই। বান্দরবান হিলটন হোটেলের ম্যানেজার আক্কাস আলী বলেন, সাপ্তাহিক ছুটিতে প্রায় বুকিং থাকতো কিন্তু গতকয়েক বছরের তুলনায় পর্যটক অনেক কমে গিয়েছে। এখন রুমের বুকিং নেই, পর্যটক নেই, খরচ পোষানো কষ্ট হয়ে পড়েছে। আমরা চাই দ্রুত সময়ে পর্যটকদের নিয়ে আবারও মুখরিত হোক পর্যটন নগরী বান্দরবান। হোটেল হিল ভিউ এর জেনারেল ম্যানেজার মো.পারভেজ বলেন, প্রায় সময় আমরা অথিতিদের রুম দিতে পারতাম না আর এখন রুম ফাঁকা। পর্যটকবাহী গাড়িচালক মো. কামাল উদ্দীন বলেন, আমাদের গাড়ি ভাড়া হচ্ছে না, পরিবার নিয়ে চরম কষ্টে আছি। বান্দরবানের আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো.সিরাজুল ইসলাম বলেন, কেএনএফ ঝামেলার কারণে পর্যটক আসা বন্ধ থাকায় বান্দরবানের পুরো অর্থনীতিই থমকে গেছে।
অন্যদিকে ট্যুরিস্ট পুলিশ ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বান্দরবানে বেড়াতে আসা পর্যটকদের সার্বিক নিরাপত্তায় ট্যুরিস্ট পুলিশের টহল টিম কাজ করে যাচ্ছে, যাতে করে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকরা নির্বিগ্নে ঘুরাফেরা করতে পারে। পর্যটন স্পটগুলোতে ট্যুরিস্ট পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত পর্যটকরা নির্বিগ্নে ঘুরাফেরা করতে পারে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সর্তক অবস্থায় রয়েছে।