বাজেট বাস্তবায়নে বাধাগুলো দূর করতে হবে

3

মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট, ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণের সুদহারসহ নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘোষিত হলো গত ৬ জুন বৃহস্পতিবার। সুখী সমৃদ্ধ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অঙ্গীকার নিয়ে ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বড় বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। বাজেটের ব্যয়ের বড় একটি অংশ রাজস্ব খাত থেকে আয় ধরা হয়েছে, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন বিশিষ্টজনেরা। অভ্যন্তরীন খাতে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এরপরও ২ লাখ ৫১ হাজার ৬০০টাকার ঘাটতি থেকে যায়। যা পূরণ করা হবে দেশি বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্র আর ঋণের পরিমানের সরল হিসাব করলে বলতে দ্বিধা নেই, বাজেট বাস্তবায়ন করতে গেলে সরকারকে বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। রাজস্ব আয় বলুন আর ঋণ পরিশোধ বলুন সবগুলোর দায় সাধারণ মানুষের উপর ছাপবে। বিপরীতে স্বস্তি আছে, সাধারণ মানুষের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর বিষয়টিতে। প্রস্তাবিত বাজেটে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার স্থিতিশীল রাখা ও উচ্চ মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে বেশকিছু প্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্য সরবরাহের ওপর উৎসে কর কমানো হচ্ছে। ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব পণ্যে উৎসে কর ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১ শতাংশ করা হচ্ছে। পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- পেঁয়াজ, রসুন, মটর, ছোলা, চাল, গম, আলু, মসুর, ভোজ্যতেল, চিনি, আদা, হলুদ, শুকনা মরিচ, ডাল, ভুট্টা, ময়দা, আটা, লবণ, গোলমরিচ, এলাচ, দারচিনি, লবঙ্গ, খেজুর, তেজপাতা, পাট, তুলা, সুতা এবং সব ধরনের ফলসহ ৩০ পণ্য। এর বাইরে বাজেটের পর দাম বাড়তে পারে বারো ধরনের পণ্যের। এই বাজেটে বেশকিছু পণ্যের আয়কর, শুল্ক, ভ্যাট অথবা সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোয় পণ্যের দাম বাড়বে। যেমন এলইডি ও এনার্জি সেভিং বাল্ব, তামাক পণ্য : সিগারেট উৎপাদন পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক ও মূল্য স্তর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। তাই সব ধরনের সিগারেটের দাম বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে জর্দা ও গুলের, মুঠোফোন ও ইন্টারনেট, পানির ফিল্টার, কাজুবাদাম, এসি, ফ্রিজ, গাড়ি, কোমল পানীয় ও এনার্জি ড্রিংকস, সিএনজি-এলপিজিতে কনভার্সন, জেনারেটর, মূলধনি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ। উচ্চবিলাসী এসব পন্যের শুল্কহ্রাস বা রেয়াতি সুবিধা প্রত্যাহার করা যথার্থ হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে মটোফোনে কথা বলা, ইন্টারনেটে ভ্যাট বাড়ানো এবং পানির ফিল্টারের দাম বৃদ্ধিও বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। স্মার্ট বাংলাদেম নির্মাণে ইন্টারনেট একটি অতিপ্রয়োজনীয় মাধ্যম। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন বিষয়ে অনলাইন ক্লাস, প্রেজেন্টেশনসহ বিভিন্ন শিক্ষা কার্যক্রমে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হয়, যদি এর দাম বাড়ে তার প্রভাবে শিক্ষায় পড়তে পারে। এছাড়া ফিল্টারের দাম বাড়লে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হবে ফিল্টার ব্যবহারকারীরা। এছাড়া পোশাক খাতে উৎসে কর বিষয়টি বিবেচনা করা জরুরি। আমরা মনে করি, বাজেট প্রস্তাবনা যাই হয়েছে, কা যথাযত বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকা জরুরি। বাজেটের আকার যত বড় চ্যারেঞ্জও তত বড়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, বছর সমাপ্তে দেখা যায়, বাজেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো অনেক ক্ষেত্রে শেষ করা সম্ভব হয় না। সময় বা অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়েও প্রকল্প সম্পন্নের বিড়ম্বনা নতুন কিছু নয়। ফলে নদীভাঙন, জলাবদ্ধতা, যানজট ও খরা-বর্ষায় জনদুর্ভোগ নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিশ্রুতি ও আশ্বাসে জনগণের নাভিশ্বাস শুধু দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ বিভাগের বিগত ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরেই বিশাল আকারের বাজেট ঘোষিত হলেও প্রতিবারই এর বাস্তবায়ন হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও পুরোটা বাস্তবায়িত না হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট সংশোধন করে ইতোমধ্যে তা ৭ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এ বাজেটেরও বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮৫ শতাংশ, যার আকার দাঁড়াবে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। তাছাড়া ২০২২-২৩, ২০২১-২২, ২০২০-২১, ২০১৯-২০, ২০১৮-১৯, ২০১৭-১৮, ২০১৬-১৭, ২০১৫-১৬ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মূল বাজেট বাস্তবায়নের হার ছিল যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ৯৩, ৮৫ দশমিক ৮৫, ৮১, ৮০, ৮৮, ৮০, ৭৬, ৭৮ দশমিক ৫৩ এবং ৮১ দশমিক ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশের প্রায় সমান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে বাজেট বাস্তবায়নের হার শতভাগ। ভারত কিংবা আফ্রিকার দেশ উগান্ডায়ও বাজেট বাস্তবায়নের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। অর্থ বিভাগ উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৬টি এবং রাজস্ব বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৩টি বাধা চিহ্নিত করেছে। আমরা মনে করি, এসব বাধা অতিক্রম করতে পারলে বাজেট পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন কোন কাজ নয়। তবে চিহ্নিত বাধাগুলো সরকারের আমলে থাকা জরুরি।