বাজেট বাস্তবায়নে পরিপক্ব পদক্ষেপ জরুরি

1

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

এটি সর্বজনবিদিত যে, প্রতিটি দেশে চলমান সরকারের আমলে প্রতিবছর বাজেট পেশ একটি চিরায়ত রীতি। সরকার পরিচালনায় প্রতিটি খাতকে বিবেচনায় নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দের হ্রাস-বৃদ্ধি অত্যধিক তাৎপর্য বহন করে। পুরো বছরের দেশীয়-বৈদেশিক আয়-ব্যয় ইত্যাদি নির্ভর করে একটি বাস্তবায়নযোগ্য বাজেটের উপর। আমদানি-রপ্তানি থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে রাজস্ব আয়, দাতা সংস্থা-উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্রসমূহের অনুদান বা ঋণ বাজেট প্রণয়নে প্রধান ভূমিকা পালন করে। সাধারণ জনগণ, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনমুখী সকল প্রতিষ্ঠান থেকে কর প্রাক্কলন সাপেক্ষে বাজেটের আকার নির্ধারিত হয়। বিভিন্ন পেশাজীবী-অর্থনীতিবিদ-সংস্থা ও ব্যবসায়ী মহল থেকে নানা প্রস্তাবনা সাধারণত বাজেটে সন্নিবেশিত হয়ে থাকে। জনহিতকর কাজে নানামুখী সেতু-কালভার্ট-রাস্তাঘাট-পরিবেশ-নদী শাসন-কৃষি ও শিল্প উন্নয়নসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কাঠামো বাজেটে অন্তর্ভুক্ত। মজার বিষয় হচ্ছে বাজেট ঘোষণার পর পরই দুই ধরনের বিপরীত চিত্র দেশবাসী প্রত্যক্ষ করে থাকেন। সরকারি দলের পক্ষ থেকে বলা হয় ঘোষিত বাজেট গণমুখী। অন্যদিকে বিরোধী দলসমূহ একে গরীবকে আরো গরীব বানানোর বাজেট হিসেবে অখ্যায়িত করে। মহান সংসদেও বাজেট নিয়ে দীর্ঘ সময় জোরালো আলোচনা বা বক্তব্য সাংসদদের রুটিন কর্তব্য। সর্বোপরি সংসদে বাজেট পাস হওয়ার আগে-পরে দ্রব্যমূল্যের উঠা-নামা একটি বিব্রতকর চিত্র। করারোপ কেন্দ্রীক অনুমান বা সিন্ডিকেট কারসাজিতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মজুত ও বাজারজাতকরণ সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ।
সচেতন মহলসহ দেশের আপামর জনগণ গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যসূত্রে ইতিমধ্যে অবগত হয়েছেন, মূল্যস্ফীতি-ডলার সংকট-ক্রমবর্ধমান ব্যাংক ঋণের সুদ হারসহ প্রভৃতি চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেটের সারসংক্ষেপ অনুমোদন সাপেক্ষে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট চূড়ান্ত করা হয়েছে। বাজেটে বিগত বছরের মতো এবারও রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা প্রাক্কলন করা হয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণ নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। তন্মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে আদায় হবে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৬ শতাংশ বেশি। অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া খাত হচ্ছে পরিবহন ও যোগাযোগ। এই খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭০ হাজার ৬৮৭ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সর্বাধিক বরাদ্দ পেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ যার পরিমাণ ৩৮ হাজার ৮০৮ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সবচেয়ে কম বরাদ্দপ্রাপ্ত খাত প্রতিরক্ষায় ধরা হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা।
বাজেটে আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ (এনইসি) কর্তৃক ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তন্মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ১ লাখ ৬৫ হাজার কোটি এবং বৈদেশিক ঋণ থেকে ১ লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে। নতুন এডিপির আকার চলতি অর্থবছরের মূল এডিপির তুলনায় ২ হাজার কোটি বা শূণ্য দশমিক ৭৬ শতাংশ এবং সংশোধিত এডিপির তুলনায় ২০ হাজার কোটি টাকা ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ বেশি। এবারের বাজেটে এডিপিতে বরাদ্দসহ মোট প্রকল্প রয়েছে ১ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ১ হাজার ১৩৩টি, কারিগরি সহায়তার ৮৭টি এবং সমীক্ষা প্রকল্প ২১টি। মোট প্রকল্পের মধ্যে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপি থেকে স্থানান্তর হবে ১ হাজার ২৭৭টি প্রকল্প। বাকিগুলোর মধ্যে নতুন অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে ৬০টি। এছাড়া আগামী অর্থবছরের এডিপিতে নতুন কিন্তু অনুমোদনহীন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৮৯৪টি, বৈদেশিক অর্থায়নের সুবিধা অনুমোদনহীন নতুন ২৫৭টি প্রকল্প এবং সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) প্রকল্প থাকবে ৮০টি।
প্রকৃতপক্ষে বছর সমাপ্তে দেখা যায় বাজেটে প্রস্তাবিত প্রকল্পসমূহ অনেকক্ষেত্রে শেষ করা সম্ভব হয় না। সময় বা অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়েও প্রকল্প সম্পন্নের বিড়ম্বনা নতুন কিছু নয়। ফলশ্রæতিতে নদীভাঙ্গন-জলাবদ্ধতা-যানজট ও খরা-বর্ষায় জনদুর্ভোগ নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিশ্রæতি ও আশ্বাসে জনগণের নাভিশ্বাস শুধু দীর্ঘায়িত হয়ে থাকে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অর্থ বিভাগের বিগত ১০ বছরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রতি অর্থবছরেই বিশাল আকারের বাজেট ঘোষিত হলেও প্রতিবারই এর বাস্তবায়ন হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটও পুরোটা বাস্তবায়িত না হওয়ার সংবাদ পরিবেশিত। চলতি অর্থবছরের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট সংশোধন করে ইতিমধ্যে তা ৭ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই বাজেটেরও বাস্তবায়ন হচ্ছে ৮৫ শতাংশ। যার আকার দাঁড়াবে ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। তাছাড়া ২০২২-২৩, ২০২১-২২, ২০২০-২১, ২০১৯-২০, ২০১৮-১৯, ২০১৭-১৮, ২০১৬-১৭, ২০১৫-১৬ ও ২০১৪-১৫ অর্থবছরের মূল বাজেট বাস্তবায়নের হার যথাক্রমে ৮৪ দশমিক ৯৩, ৮৫ দশমিক ৮৫, ৮১, ৮০, ৮৮, ৮০, ৭৬, ৭৮ দশমিক ৫৩ ও ৮১ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের প্রায় সমান অর্থনীতির দেশ ভিয়েতনামে বাজেট বাস্তবায়নের হার শতভাগ। ভারত কিংবা অফ্রিকার দেশ উগান্ডায়ও বাজেট বাস্তবায়নের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। অর্থ বিভাগ উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৬টি এবং রাজস্ব বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ৩টি বাধা চিহ্নিত করেছে। উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতাগুলো হচ্ছে যথাসময়ে ভূমি অধিগ্রহণ করতে না পারা, প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা, বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প অনুমোদনে দীর্ঘসূত্রতা, প্রকল্প দলিলে অসম্পূর্ণতা ও বারবার প্রকল্পের নকশা পরিবর্তন বা সংশোধন। রাজস্ব বাজেট বাস্তবায়নের পথে চিহ্নিত বাধাগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থ ছাড়ে দেরি হওয়া, জনবল নিয়োগে জটিলতা ও সময়মতো নিয়োগ না দেওয়া এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে সুবিধাভোগী নির্বাচনে বিলম্ব। বিশেষজ্ঞরা উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে সমীক্ষা না করা, যোগ্যতম সরকারি কর্মচারীকে যথাযথ পদে নিয়োগ না দেওয়া, সরকারি কর্মচারীদের অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব, প্রকল্প বাস্তবায়নে দেরি করা এবং বাস্তবতা বিবর্জিত উচ্চাভিলাষী রাজস্ব আয়-ব্যয়ের প্রাক্কলনকে বাজেট বাস্তবায়ন না হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে মনে করেন। তাছাড়াও বাজেট বাস্তবায়নের অদক্ষতার কারণে অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতও কম বরাদ্দ পাচ্ছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। যদিও অবকাঠামো নির্মাণে এবং অনুন্নয়ন খাতে ঠিকই অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে।
প্রাসঙ্গিকতায় সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জা আজিজুল ইসলাম গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘প্রশাসনিক অদক্ষতা ও জবাবদিহির অভাব মূলত এ দুই কারণে বাজেটের পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পগুলো অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে যতটুকু বাস্তবায়িত হয়, পরের তিন মাসেই হয় তার সমান। এতে কয়েকভাবে ক্ষতির শিকার হয় দেশ। একদিকে কাজের মান ঠিক থাকে না, অন্যদিকে খরচ বেড়ে যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো যেহেতু আগে থেকেই আঁচ করতে পারে সামনে তাদের কী কী কাজ আছে, ফলে বাজেট পাসের আগে থেকেই তারা কাজটা এগিয়ে রাখতে পারে। বাজেট পাসের পর কার্যপত্র ও দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করতে পারে। এতে বাজেট বাস্তবায়ন হার বাড়বে।’ অর্থ বিভাগের সাবেক কর্মকর্তাদের অনেকেই বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পসমূহ সময়মত সম্পন্ন না হওয়াকে বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দায়ি করেছেন। তাদের মতে, বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণগুলো নিয়ে সংসদে তেমন আলোচনাও হয় না। অথচ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে উৎসাহিত করতে এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ-কর্মসংস্থান তৈরি ও আয় বৃদ্ধির জন্য অন্যতম অনুঘটক হচ্ছে এডিপির বাস্তবায়ন। এডিপির বাস্তবায়ন পিছিয়ে থাকলে পুরো বাজেটের বাস্তবায়নই পিছিয়ে পড়ে।
২০২৩ সালের এপ্রিলে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রকাশিত ‘সরকারি খরচ ও আর্থিক জবাবদিহি (পিইএফএ) মূল্যায়ন ২০২১’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজেট বাস্তবায়নের প্রধান দুর্বলতার সঙ্গে জড়িত মূলত বাজেট প্রস্তুতি-জবাবদিহি ও বিশ্বাসযোগ্যতার ঘাটতি। এ কারণেই মূল বাজেট থেকে বাস্তবায়িত বাজেটের ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সরকারের অআর্থিক সম্পদের তথ্য পুরোপুরিভাবে তুলে ধরা হয় না। এ ছাড়া বাস্তবায়ন পর্যায়ে যথাযথ নিরীক্ষা হয় না, যা করা হয় তাও আবার ঝুঁকিভিত্তিক বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করে হয় না। যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয় না রাজস্ব সংগ্রহের তথ্যও। বাজেট বাস্তবায়নের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে। দুঃখজনকভাবে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির প্রতিবেদনগুলো জনগণের দেখার জন্য উন্মুক্ত করা হয় না। সর্বোপরি এই উপলব্ধিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে বাজেট প্রণয়ন নয়, বাস্তবায়নই বাজেট ঘোষণার সার্থকতা বহন করে। জনকল্যাণে সেটি কতটুকু পর্যাপ্ত কার্যকর, সামষ্টিক মূল্যায়নের প্রতিক্রিয়া বাজেটের সফলতাকে অর্থবহ করে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য চ.বি