বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে

5

দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের আরেক নাম বজ্রপাত। বৈশাখ মাস বা এপ্রিল থেকে শুরু করে জুন মাস পর্যন্ত প্রচন্ড দাবদাহের সাথে কালবৈশাখির আগমন বার্তা দেয় এ বজ্রপাত। বজ্রপাত সাধারণ কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, এ দুর্যোগ মোকাবেলায় আগে থেকে সতর্ক না হলে বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকি থাকে। সম্প্রতি প্রচন্ড তাপপ্রবাহে ওষ্ঠাগত মানুষ একটু বৃষ্টিতে স্বস্তির আশা করলেও এসময়ে স্বাভাবিক বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা নেই, বরং তীব্র গতির বিজলি, প্রচন্ড আওয়াজে বজ্রপাত আর ঝড়-বাতাস নিয়ে বৃষ্টি নামে। গত এপ্রিলে এবং এ মাসের শুরু থেকে যে কয়টি জেলায় বৃষ্টি হয়েছে এর সবগুলো রূপ ছিল এরকম। এ সম্পাদকীয স্তবকটি যখন লেখা হচ্ছে, তখন চট্টগ্রামসহ বেশ কয়টি জেলায় বিকট আওয়াজে একের পর এক বজ্রপাত হচ্ছে আর ঝড়-বাতাসের সাথে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এতে এ পর্যন্ত ৬ জনের প্রাণহানির খবর দিয়েছে বেসরকারি টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদগুলো। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বজ্রাঘাতে দেশের বিভিন্ন জেলায় ১৩ জনের প্রাণহানির ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। এপ্রিল মাসে সম সংখ্যক মৃত্যু হয়েছে বজ্রাঘাতে। আমরা জানি, সরকার প্রাণহানি বিবেচনায় ২০১৬ সালে বজ্রাঘাতকে দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছিল । এরপর সাত বছর পার হলেও এখনো এই দুর্যোগ প্রতিরোধের টেকসই কোনো প্রকল্প হাতে নিতে পারেনি দুর্যোগ মন্ত্রণালয় ও এর সাথে সংশ্লিষ্টরা। তবে বজ্রাঘাত প্রতিরোধে ‘তাল গাছ রোপণ’ প্রকল্প নামক একটি কর্মসুচির কথা শোনা গেলেও অধিদপ্তরের লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর প্রকল্প থেকে প্রত্যাশিত সাফল্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ বজ্রনিরোধক দন্ড, বজ্রনিরোধক যন্ত্র ও ছাউনি স্থাপনের মাধ্যমে চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে কোনো কিছুর মাধ্যমেই বজ্রাঘাতে প্রাণহানি ঠেকানো যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব কৌশলই ব্যর্থ হয়েছে। তাই গবেষণার মাধ্যমে সব অংশীজন ও বিশেষজ্ঞকে নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হলে উপযুক্ত সমাধান আসতে পারে বলে মনে করছেন তারা। দুর্যোগব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২ হাজার ১৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এই বজ্রাঘাতে। এ ছাড়া ২০২১ সালে ৩৬৩ জন এবং ২০২২ সালে মারা গেছেন ২৭৪ জন। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএফ) হিসাব অনুযায়ী, ২০২২-এর এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত বজ্রাঘাতে ৩৪০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তথ্য মতে, ২০১৭ সালে দুর্যোগব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দুই প্রকল্পের (কাবিখা ও টিয়ার) মাধ্যমের সারা দেশে ৪০ লাখ তাল গাছের চারা রোপণ শুরু করে। কিন্তু সেটিতে প্রত্যাশিত সাফল্য না আসায় ২০২২ সালে সেটি বাতিল ঘোষণা করা হয়। ২০১৮ সালে আবহাওয়া অধিদপ্তরের নেওয়া লাইটনিং ডিটেকশন সেন্সর প্রকল্পও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়েছে। অন্যদিকে ২০২১ থেকে ২০২২ অর্থবছরের আওতায় দুর্যোগব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর বজ্রপাতপ্রবণ ১৫ জেলায় একই প্রকল্পের (কাবিখা ও টিয়ার) মাধ্যমে ৩৩৫টি বজ্রনিরোধক দন্ড-যন্ত্র বসায়।
সংশ্লিষ্ট জেলাগুলোয় তথ্য নিয়ে জানা যায়, এর বেশির ভাগই সচল নেই। আবার কোনোটির কাভারেজ বা রেডিয়াস খুবই কম। এই ধরনের আরও ৬ হাজার ৭৯৩ দন্ড বসানোর জন্য ৩২১ কোটি টাকার প্রকল্প সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রকল্প খুব বেশি কার্যকরী হবে না। কারণ এসব যন্ত্রের কাভারেজ খুবই কম। যদি কাভারেজ কয়েক কিলোমিটার বা কয়েকশ মিটারও হয়, তবেই এটি বজ্রাঘাত থেকে রক্ষায় কার্যকর হবে। আর তা না হলে এটি থেকে সুফল আসবে না। বজ্রপাত প্রতিরোধে জনসাধারণের করণীয় সম্পর্কে মন্ত্রণালয় ও আবহাওয়া অফিস থেকে যে নির্দেশনা দেওয়া আছে তা অনুসরণ করলে বজ্রাঘাতের ক্ষতি থেকে নিজেকে অনেকটা রক্ষা করা সম্ভব। এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়টা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বজ্রপাতের জন্য, সে কারণে এই সময়টাতে জনসাধারণকে বেশি সচেতন হতে হবে। এর স্থায়িত্ব এক ঘণ্টার বেশি থাকে না। তাই এই সময়টাতে বাড়িতে বা নিরাপদ স্থানে থাকতে হবে। তাহলে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া অনেকাংশ সম্ভব হবে। মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা বেশি বেশি প্রচার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাল গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রোপনে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
ইলেকট্রিক লাইনের শর্টসার্কিট থেকে এসময় নিরাপদ রাখা খুব জরুরি বিধায় আর্থিং স্থাপন করা জরুরি। এক সময় প্রতিটি ঘরে এ জাতীয় আর্থিং থাকলেও এখন তা দেখা যায় না, এতে শর্টসার্কিট হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়, বিশেষ করে বজ্রপাত যখন হয়, তখন এর সম্ভাবনা আরো বেশি থাকে। সর্বোপরি প্রয়োজন জনসচেতনতা ও সতর্কতা।