প্রেমিকের হাত ধরে পালানো এবং প্রাসঙ্গিক কথন

2

এমরান চৌধুরী

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার পোস্ট শেয়ার হয়। কোন কোন পোস্ট সীমাহীন বিরক্তির উদ্রেক করে। কোনটায় আবার নিজেকে সচেতন হতে অনুপ্রেরণা যোগায়। তবে বেশিরভাগ পোস্টই নেই কাজ তো খই ভাজার মতো। ইচ্ছে হলো দিলাম এই যা। তারমধ্যে কিছু কিছু আমাদের অত্যন্ত ভাবিত করে। মনের অলিন্দে ছড়িয়ে দেয় চরম দুঃখবোধ। হৃদয়ে শুরু হয় রক্তক্ষরণ। আমাদের সমাজে এমনিতেই নিরাপত্তার বড় অভাব। ফলে যাদের ঘরে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আছে তাদের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। বর্তমানে অভিভাবকগণ নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। একদিকে বখাটেদের উৎপাত, অন্যদিকে অন্যায্য পক্ষ থেকে মেয়ের জন্য প্রস্তাব আসা। এখানে মেয়েপক্ষকে কৌশলে এসব প্রস্তাবকে যেমন এড়িয়ে যেতে হয়। তেমনি বিজলি চমকানোর মতো এক সকালে হয়তো দেখা যাবে তাদের ১৮/২০ বছরের রক্তের ও মায়ার বন্ধনকে তোড়াই কেয়ার করে মেয়ে পালিয়ে গেছে। এমনি পালিয়ে যাওয়া এক মেয়ের বাবার করুণ আকুতিমাখা একটি চিঠি চোখে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তিনি প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়া তাঁর মেয়ের প্রতি এক বেদনাদায়ক চিঠি লিখেছেন। কৌতূহলী পাঠকের জন্য নিচে তার চুম্বক অংশ উদ্ধৃত করছি-‘মা’রে,! শুরুটা কিভাবে করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
যেদিন তুই তোর মায়ের অস্তিত্ব ছেড়ে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলি সেদিন থেকে তোকে মা বলে ডাকতে শুরু করলাম। তোকে মা ডাকতে গিয়ে আমার নিজের মা হারানোর ব্যাথাটা’ই ভুলে গিয়েছিলাম। তোর মাও তোকে মা ছাড়া অন্য নামে কখনো ডাকেনি।….হঠাৎ করে তুই এভাবে চলে যাবি আমি তা বুঝতেই পারিনি…! ছেলেটা যেদিন বাইরে ব্যাগ হাতে তোর জন্য অপেক্ষা করছিল, যে কখন তুই দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসবি। আমি তখন ভেতরে বসে রবের কাছে প্রার্থনা করছিলাম আর ভাবছিলাম যে আর কতটা ভালবাসতে পারলে তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি না। অপরদিকে, তুই ঘরে বসে ভাবছিলি আজ যেতে না পারলে ছেলেটার কাছে ছোট হয়ে যাবি।
জানিস মা তুই তোর তিন বছরের ভালবাসা খুঁজে পেয়েছিস। কিন্তু আমার জীবন থেকে বিশ বছরের ভালবাসা হারিয়ে গেছে..!….আমি জানি মা তোদের সব সন্তানদের একটা প্রশ্ন বাবারা কেন তাদের ভাললাগাটাকে সহজে মানতে চায় না।
উত্তরটা তোর ঘাড়ে তোলা থাকলো, তুই যেদিন মা হবি সেদিন নিজে নিজে উত্তরটা পেয়ে যাবি..!
তোরা যখন একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে যাস তখন ওই ছেলে ছাড়া জীবনে কারও প্রয়োজন বোধ করিস না। কিন্তু একটা বাবা বোঝে তার জীবনে নিজের মেয়েটার কতটা প্রয়োজন..!…
মারে বাবার উপর রাগ করিসনা..!
তোরা যদি অল্প দিনের ভালবাসার জন্য ঘর ছেড়ে পালাতে পারিস, তবে আমরা বিশ বছরের ভালবাসার জন্য বেপরোয়া হব না কেন ?
বাবারা মেয়ে সন্তানের জন্মের পর চিন্তা করতে থাকে নিজের মেয়েটাকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিতে পারবে তো।…যদি মন কাঁদে চলে আসিস ! বুক পেতে দেব ! ঠিক আগে যেভাবে ভালো বেসেছিলাম। সেভাবেই বাসবো।
হয়তো তোর মায়ের মতো তোকে পেটে ধরিনি, তবে পিঠে ধরার যন্ত্রণাটা সহ্য করতে পারছিনা।’
আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা খুব কম বয়সে প্রেমে পড়ে। এজন্যে আমাদের আবহাওয়া অনেকটা দায়ী। উন্নত দেশসমূহে যেখানে ২০/২২ বছর বয়সেও যৌবন আসে না সেখানে একই সময়ে আমাদের দেশে দুই তিন সন্তানের মা হয়ে যায় এক একজন মেয়ে। অন্যদিকে প্রেমে পড়ার আগে তারা একচুলও ভাবে না তাদের দু’পরিবারের মধ্যে সম্পর্কটা আদৌ হতে পারে কিনা। রূপ দেখে ঝাঁপ দেয়া যেমন আগুনে ঝাঁপ দেয়ার সামিল, একইভাবে বস্তিতে থেকে দালানের স্বপ্ন দেখাও বেমানান। যদিও আইনের দৃষ্টিতে প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েরা নিজেদের পছন্দসই পাত্র-পাত্রীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অধিকার রাখে। আজকাল বেশির ভাগ বিয়ে তাই মেয়ে বা ছেলের পছন্দ অনুযায়ীই হচ্ছে এবং সিংহভাগ পরিবার তা মেনেও নিচ্ছে। আবার কোনো কোনো পরিবার নিজেদের সন্তানদের পছন্দের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন। এটাই হওয়া বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বেশি ভালো। কারণ জোর করে অভিভাবকত্ব খাটানোর সময় পেরিয়ে গেছে সেই দুই দশক আগে। তবে এক্ষেত্রে নজরদারিও প্রয়োজন নিজের মেয়েটি কোনো প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে কি না? হাজার হলেও রক্ত। সেই রক্ত যদি বিপথে ধাবিত হয় তাহলে এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কিছুই হতে পারে না। পতিতা বলে আমরা যাকে অশুচি অস্পৃশ্য বলি তাদের একজনও কিন্তু স্বেচ্ছায় বারবণিতা বা দেহজীবি হয়নি। এরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পুরুষ নামক দানবের খপ্পরে পড়ে পতিতালয়ে ঠাঁই নিয়েছে অথবা কথিত প্রেমিক ভোগ করার পর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। এমনও ঘটনা অহরহ ঘটছে বিয়ে করবে বলে ঘর থেকে নিষ্পাপ মেয়েটিকে ঘরের বাহির করে সংঘবদ্ধভাবে ধর্ষণ করে প্রেমিক চম্পট দিয়েছে অথবা তুলে দিয়েছে লম্পটের হাতে।
এসব নৈমিত্তিক ঘটনা জানার পরও অনেক মেয়ে ঘর ছাড়ে প্রেমের টানে। এই ঘর ছাড়া বা প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতার পেছনে যে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই তা নয়। আমরা সাধারণত দেখতে পাই দুটো পরিবারের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান, ধর্মের অমিল সম্পর্ক মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে বড় অন্তরায় হয়ে দেখা দেয়। কোনো বিত্তবান পরিবারই চায় না বিত্তহীন পরিবারের সাথে ছেলে বা মেয়ের বিয়ে হোক। এক্ষেত্রে মেয়ে যতই সুন্দরী হোক কিংবা শিক্ষিত হোক সেটা গুরুত্ব পায় না। বিত্তবানরা সম্পর্কের বিচার করে বিত্ত দিয়ে। মেয়ের বাপের গাড়ি-বাড়ি না থাকলে ছেলে মেয়েকে যতই ভালোবাসুক তা মেনে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে অভিন্ন ধর্মের না হলে দুটো প্রাণের স্বাভাবিক মিলন হিমালয় পর্বত ডিঙানোর চেয়েও কঠিন হয় পড়ে। এক জোড়া যুবক-যুবতী যখন বুঝতে পারে পরিবার বা সমাজ তাদের মিলনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, কোনোভাবেই তাদের সম্পর্ক মেনে নিবে না তখন তারা পালিয়ে বিয়ে করার মতো অনিশ্চিত যাত্রায় বেরিয়ে পড়ে। তখন রক্তের বাঁধনের চেয়ে সম্পর্কটাই বড় হয়ে দেখা দেয়। তিন বছরের ভালোবাসার কাছে কুপোকাত হয় দশ মাস দশ দিন গর্ভে ধরা মা ও বাবার বিশ বছরের নিবিড় ভালোবাসা। তুচ্ছ হয়ে যায় ধর্মের বন্ধন।
যারা প্রেমের টানে ঘর ছাড়ছে তাদের মনে রাখা উচিত মা-বাবার মতো নিখাদ আপনজন পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। প্রেমের টানে যতটা বাস্তবতা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে মোহ। এই মোহের ঘোর কেটে গেলে মানুষ বুঝতে পারে তারা সঠিক কাজটি করেনি। এমন এক সময় বিষয়টি বুঝে যখন ফেরার সুযোগ খুব কমই থাকে। তাই হৃদয়ঘটিত ব্যাপারে জড়িত হয়ে কোনো কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অন্তত কাছের মানুষদের কাছে বিষয়টি শেয়ার করা উচিত। ধীরে সুস্হে ভাবা উচিত। এতে করে এমন একটি পথ বেরিয়ে আসতে পারে যাতে বিশ বছরের ভালোবাসার সম্মানটি রক্ষা পায়। মনে রাখতে হবে আমাদের একটাই জীবন। এই জীবন শুধু একা সুখী হওয়ার জন্যে নয়, সুখটা বহুজনের অন্তরে বিশেষত মা-বাবার অন্তরে সঞ্চারিত করতে পারাটাই সবচেয়ে বড় সুখ। মা-বাবাকে কাঁদিয়ে অথৈ জলে ভাসিয়ে, সমাজের কাছে তাঁদের অপদস্ত করে কখনো কেউ প্রকৃত সুখী হয়েছে এমন নজির আছে বলে আমার মনে হয় না।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক