প্রাচ্যের সৌন্দর্যরাণী চট্টগ্রামকে সবুজায়ন করতে বৃক্ষরোপণের বিকল্প নেই

9

রশীদ এনাম

সুদীর্ঘকাল আভিজাত্যের ইতিহাস, উত্থান পতন নানা দ্বন্দ্ব সংঘাত পেরিয়ে আজকের চট্টগ্রাম।হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিতে ধারণ করে মহিমায় উজ্জ্বল প্রাচ্যের সৌন্দর্যরানী অপরূপ লিলাভূমি চট্টগ্রাম একমাত্র জেলা যেখানে সৃষ্টিকর্তার তাঁর নিজস্ব তুলির আঁচড়ে ছবির মতো অপরূপা করে সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে চলে গিয়েছে কর্ণফুলী নদী। দরিয়া নগরের এই শহরে সাগরের সাথে মিতালী রচনা শহরের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে নদী। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর শহরের নাম চট্টগ্রাম। সবচেয়ে বড় গ্রাম চাটগাঁ। সৃষ্টিকর্তার তুলির স্পর্শে অপরূপা করে ঢেলে সাজিয়েছেন চট্টগ্রামকে। পাহাড়, নদী, দরিয়া নগর বেষ্টিত বৃহত্তর চট্টগ্রাম। এই শহরে আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে পড়ে। সবুজ অরণ্যরাণীতে নানা রকমের পশু পাখির অভয়ারণ্য। দেশের প্রবেশদ্বার ব্যবসার প্রাণ কেন্দ্র বাণিজ্য রাজধানী চট্টগ্রাম। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৭১-র স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বৈরাচার আন্দোলন প্রত্যেকটি সূচনা কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে, মা মাটি ও মাতৃভূমির জন্য মাস্টারদা সূর্যসেন ও প্রীতিলতার মতো আরও অনেক বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের কৃতি সন্তানদের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের মাতৃভাষার ৪০% অনুজ্ঞাসূচক ক্রিয়া কিন্তু চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা থেকে উৎপত্তি। দেশে প্রথম আঞ্চলিক ভাষার অভিধান এবং আঞ্চলিক ভাষার চ্যানেলও চট্টগ্রাম থেকে শুরু। দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল ও চট্ট কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এ জন্য বোধহয় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী (মোহন দাশ করমচাঁদ) বাংলাদেশ সফর করতে এসে চট্টগ্রাম কে নিয়ে উচ্ছসিত প্রশংসা করতে গিয়ে বলেছিলেন, Chittagong to the fore – চট্টগ্রাম সর্বত্রে এগিয়ে। শিল্প উদ্যোক্তা ব্যবসায়ও কিন্তু চট্টগ্রাম প্রথম। সমগ্র দেশে শিক্ষা দিক্ষা সাংস্কৃতিতেও চট্টগ্রামের মানুষ কিন্তু মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছে।
চট্টগ্রামকে একসময় বলা হতো প্রকৃতি আধার। এক একটা গাছ মানে এক একটা অক্সিজেনের ভান্ডার। চট্টগ্রাম নগরীতে দিন দিন গাছ বিলুপ্তের পথে। সরকারী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে নির্বিচারে গাছ কাটার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরে একসময় বড়ো বড়ো পাখুড় গাছ, বট, রেইনট্রি,কদম, তুলা, নিম, বাদাম গাছ ছিলো এখন তা দেখা মিলে না। নগরীর পার্কগুলো বৃক্ষ শুন্য হয়ে পড়ছে। এক সময় আমরা বিকেলে বন্ধুরা মিলে সাহিত্য আড্ডা ও পাঠচক্র করতাম। বিপ্লবী উদ্যোনে কখনো বা জাতিসংঘ পার্কে। এখন সে সবুজ পার্কও নেই সাহিত্য আড্ডাও নেই। সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মুর্তিরমতো বর্ষিয়ান পাখুড় এবং বট গাছগুলোর নিচে গেলে কি প্রশান্তি শীতল হাওয়া। এসব গাছের ফলগুলো পাখিদের খুব প্রিয় খাবার। তাছাড়া এসব গাছে নানা রকমের পাখির অভয়ারণ্য বিশেষ করে, টিয়া, ময়না, বুলবুল, বট ঘুঘু, চিঁহি, শালিকসহ নানারকমের পাখির আবাসস্থল বর্ষিয়ান গাছগুলো। গাছ সংকটের কারণে অনেক বন্য প্রাণী ও বিহঙ্গ আজ বিলুপ্তের পথে। খুব কষ্ট লাগে অপরূপা আমাদের প্রাণের শহরটি কেনো জানি দিন দিন ধুসর নগরীতে পরিণত হচ্ছে। আগের মতো এখন আর সবুজ নেই। চট্টগ্রামের প্রকৃতি আজ বিপন্ন। পাখি ডাকা, ছায়া-ঘেরা সবুজ বেষ্টনি চট্টগ্রাম শহরে রয়েছে পাহাড়, যাকে বলা হয় পৃথিবীর পেড়েক স্বরূপ। স্বর্গীয় শহর থেকে প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত বিনাশ করে চলেছে কিছু পিশাচরূপী মানুষ। বৃক্ষ খেকোরা থেমে নেই প্রতিনিয়ত সাবার করছে। রাতের অন্ধকারে পাহাড় কেটে তৈরী হচ্ছে দালান কোঠা। প্রতিবছর পাহাড় ধসে শত শত মানুষ মারা যায়। নদী-নালা পুকুর-দিঘিতে ময়লার ভাগাড় ফেলে দখল করে স্থাপন করছে অবৈধ মার্কেট, বস্তি কলোনী। বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতায় বন্দী থাকে শহরের মানুষ। প্রতিবছরই কিন্তু ধারাবাহিকভাবে ঘটে এসব ঘটনা। এসব কিন্তু আমাদের কারনে ঘটছে। গুটিকয়েক শ্রেণীর মানুষরূপী দানবের কারণে ভোগান্তির শেষ নেই। ওদের ইন্দনদাতা কিন্তু রাগব বোয়াল না হয় জনপ্রতিনিধি বা প্রভাবশালী ব্যক্তি। প্রকৃতি খেকো অমানুষদের জন্য প্রকৃতি ফোঁসে উঠছে। প্রতিবছর জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, সুনামি, বজ্রপাত, করোনা ভাইরাস পিছু ছাড়ছে না। এ জন্য প্রকৃতিপ্রেমী দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতি নিয়ে বলেছিলেন, ‘মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন প্রকৃতি ও মানবের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। মানুষ যেন প্রকৃতিকে বাদ দিয়েই চলতে চায়। মানুষের এই ব্যবহারে প্রকৃতি এখন রূষ্ট। প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তাতে মানুষের জেতার কোন সম্ভাবনা নেই। এ দেশে আরেকটি নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে হবে। যেখানে মানুষ ও প্রকৃতি সহাবস্থান থাকবে। মানুষ তুমি বৃক্ষের মতো আনত হও সবুজ হও’। পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ গ্রন্থ লেখক আহমেদ ছফা লিখেছেন, ‘বৃক্ষের ভেতর যে সরল জীবনপ্রবাহ স্পন্দিত হয়, তার সঙ্গে মানুষের হৃদস্পন্দনের অবশ্যই একটা মিল আছে। প্রকৃতিগতভাবে উভয় একই বস্তু। কিন্তু তারতম্য শক্তি হচ্ছে গতিশীলতায়। একজন পুরুষ একজন নারীর সঙ্গে যেভাবে সম্পর্ক নির্মাণ করে, সেভাবে একজন মানুষ একটি বৃক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু মানুষ যিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে পারেন, বৃক্ষেরও একটি জীবন্ত সত্তা রয়েছে, অন্য যে কোন প্রাণীর মত’। চট্টগ্রাম নগরীকে সবুজায়ন করতে হলে বৃক্ষরোপণ আন্দোলন গড়ে তোলতে হবে। সবুজের হাত ছানি দিয়ে প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে। মাস চারেক পরে বর্ষা মৌসুম শুরু হবে তার আগে নগরপিতা মাননীয় জেলাপ্রশাসন চট্টগ্রামকে সবুজায়ন করার লক্ষ্যে একটি পরিল্পনা করতে পারেন। যেমন গতবছর চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন কদমতলী, বটতলী, আমবাগান, নিমতলাসহ গাছে নামে যে এলাকায় রয়েছে সেই নামের সঙ্গে মিল রেখে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সত্যি প্রশংসার দাবি রাখেন চট্টগ্রাম জেলাপ্রশাসন তবে সেটি বাস্তবায়ন হয়েছে কিনা আল্লাহ ভালো জানে।
গাছ নিয়ে একটা হাদিসের কথা মনে পড়লো, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ট মনিষী আমাদের প্রিয় নবিজি হযরতম মুহাম্মদ(সা.) বলেছেন ‘যদি তুমি জানো পরের দিনই রোজ কেয়ামত, তাপরেও একটি গাছ লাগিও’। আল কোরআন, সূরা দাহরে আছে, ‘বেহেশতে তোমাকে দেয়া হবে আদা মিশ্রিত পানীয়’। কোন মুসলিম কোন গাছ রোপণ করে অথবা ক্ষেতে ফসল বোনে। আর তা কোনো পোকামাকড় কিংবা মানুষ বা পশু পাখি খায়, তাহলে তার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে বুখারি হাদিস-২৩২০ মুসলিম হাদিস ৪০৫৫।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের মাননীয় সিটি মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরকে ধন্যবাদ ও সবুজ ভালোবাসা। আপনি চট্টগ্রাম শহরের জলবায়ু মোকাবেলায় এবং সবুজায়ন করার লক্ষ্যে ৫ লক্ষ গাছ লাগানোর একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সত্যি এটা প্রশংসার দাবিদ্বার। সিটি মেয়র সাহেবের মতো চট্টগ্রামের জেলার প্রত্যেকেটি থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ শহরে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এবং চট্টগ্রামের সবুজায়ন করতে এগিয়ে আসতে পারেন। পাশাপাশি সবুজ বৃক্ষরাজী ও পাহাড় কাটা বন্ধ করুন। “প্রকৃতির জন্য সময় বলে কথা, আমি বলব প্রাকৃতি সৌন্দর্য বর্ধন করতে হলে বৃক্ষের কোন বিকল্প নেই। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বলেছেন, সবাই যেন বনজ ফলজ, ভেষজ কমপক্ষে তিনটি করে গাছ লাগাই। প্রকৃতিকে রক্ষা করতে গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নেই। পাড়ায়, এলাকায় মহল্লায় ক্লাব সংগঠনের তরুণরা কিন্তু বৃক্ষরোপণে আন্দোলন করতে পারেন। যেখানে খালি জায়গা বিশেষ করে বাড়ি আঙ্গিনা, বাড়িতে ছাদে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায়, গাছ লাগাতে পারেন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য হলো গাছ। মনকে ভালো রাখতে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। প্রকৃতি হলো মনের দাওয়াই। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য হলো গাছ। মনকে ভালো রাখতে প্রকৃতিকে ভালোবাসতে হয়। গাছ লাগানোর কোন বিকল্প নেই। আসুন আমাদের চট্টগ্রাম নগরীকে সবুজায়ন করতে এগিয়ে আসি।
লেখক : প্রাবন্ধিক