প্রসঙ্গ : পানিতে ডুবে মৃত্যু

2

এমরান চৌধুরী

বছরের সব সময় ছোট ছোট শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকলেও বর্ষাকালে এই ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যায় বহুগুণ। কারণ বর্ষাকালে নিরন্তর বর্ষণ, না থাকলেও যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় তাতেই গ্রামের পুকুরগুলো পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সে সাথে আশপাশের বিল, ডোবাগুলো এক বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়। ফলে পুকুর বিল-ডোবাতে পড়েই গ্রামের অনেক শিশুর প্রাণহানি ঘটে। শহরেও এই জাতীয় দুর্ঘটনা যে খুব একটা ঘটে না তা কিন্তু নয়। বিশেষত বড় বড় নালার ধারে গড়ে উঠা বস্তিগুলোর ছেলেমেয়েরা এই দুর্ঘটনায় পড়ার সমুখ সমুখ সম্ভাবনা থাকে। বর্ষার অতিবৃষ্টি কিংবা পাহাড় থেকে নেমে আসা পানির ঢলে নালাগুলো ভরে পানি উপচে পড়ে, সে সঙ্গে থাকে পানি নামার সময় প্রচÐ স্রোত। এ অবস্হায় কোনো শিশু যদি পানিতে পড়ে যায় তার লাশটাও খুঁজে পাওয়া রীতিমতো অসম্ভব। এ ছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়ন, পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্হা না থাকায় অল্প বৃষ্টিতেই শহর আর শহর থাকে না। পানির তলায় তলিয়ে যায় মূল চট্টগ্রাম শহরেরই অধিকাংশ জায়গা। এই রকম তলিয়ে যাওয়া শহরে প্রাপ্ত বয়স্ক লোকেরও পানির স্রোতে বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সী যত শিশুর মৃত্যু হয় তারমধ্যে ৪৩ শতাংশ মারা যায় পানিতে ডুবে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েল্থ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্যব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। জাতীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম ও স্থানীয় পর্যায়ের অনলাইন নিউজ পোর্টালে ২০২০ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪২৫টি ঘটনার কথা প্রকাশিত হয়েছে। এসব ঘটনায় সারা দেশে শিশুসহ ৭৬৯ জন ব্যক্তি পানিতে ডুবে মারা যায়। পানিতে ডুবে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে, ১৮৪ জন। এছাড়া চট্টগ্রামে ১৪৫ জন, রংপুরে ১১৩, রাজশাহীতে ১০০, ময়মনসিংহে ৮৮, বরিশালে ৫১ ও খুলনা বিভাগে ৪৭ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এ সময়ে সবচেয়ে কম মৃত্যু ছিল সিলেট বিভাগে, ৪১ জন। নেত্রকোনা জেলায় ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়, ৪৮ জন। পরবর্তী স্থানগুলোতে রয়েছে ঢাকা, নোয়াখালী, দিনাজপুর, গাজীপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা। এসব জেলায় যথাক্রমে ৪৩, ৩১, ৩০, ২৭ ও ২৫ জন মারা যায়। বান্দরবান, শরীয়তপুর, খুলনা ও নড়াইল- এ চারটি জেলায় কারো মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। মেহেরপুর জেলায় একজন, রংপুর, রাজবাড়ী এবং সাতক্ষীরায় দুজন করে এবং নীলফামারী, বাগেরহাট, মাগুরা ও মাদারীপুর জেলায় তিনজন করে পানিতে ডুবে মারা যায়। (সূত্র : যুগান্তর অনলাইন)
পৃথিবীর অনেক দেশেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে পানিতে ডুবে অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয় সুইমিংপুলে। আর আমাদের দেশে পানিতে ডুবে অধিকাংশ শিশুর মৃত্যু হয় পুকুরে, জলাশয়ে, ডোবা বা নালায়। পুকুর বা ডোবা সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক স্হান। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা পুকুরেই হয় যেটি বাড়ির সীমানা বা ঘরের ২০ মিটারের মধ্যে। অবশিষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে ডোবা,নালা, লেক,খাল আর নদীতে। বর্ষা মৌসুমে বিল ঝিলের পানিতে ডুবেও অনেক শিশুর মৃত্যু হয়। শহরাঞ্চলে অনেক সময় ঢাকনাবিহীন পানির ড্রামে পড়ে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে।। শুধু শিশুর মৃত্যু নয় সাঁতার না জানা অনেক বয়স্ক মানুষও পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা পত্রপত্রিকার পাতায় প্রায়ই চোখে পড়ে। কিন্তু এ অনাকাংখিত মৃত্যু একটু সচেতন হলে অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। তার জন্য প্রয়োজন কোন অবস্হায় কোন পরিবেশে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা ঘটে সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর পরিবেশ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই,অধিকাংশ শিশুরই মৃত্যু ঘটে তাদের প্রতি নজর না রাখার কারণে। শিশুমাত্রই কৌতূহলপ্রিয়। পুকুরের ঘাট দেখলে তারা বড়দের দেখাদেখি নিজেরাও নামার চেষ্টা করে। এ সময় ঘটে যায় দুর্ঘটনা। অনেক সময় পাকা ঘাটে খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে ডুবে যায়। আবার এমন ঘটনাও দেখা গেছে একজনকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক শিশুও মৃত্যুমুখে পতিত হয়। অনেক সময় গরুর খাবার দেওয়ার মাটির পাত্রে পড়েও অনেক শিশু মারা যায়। এ গেল ছোট শিশুদের কথা। অনেক কিশোর কিশোরী কৌতূহলের বশে পানিতে বা গোসল করতে নামে। অথচ তারা নিজেরাই জানে না তারা সাঁতার জানে না। এ সাঁতার না জানার কারণে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
এ অনাকাংখিত মৃত্যু প্রতিরোধে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রিভেন্টিং ড্রাওনিং: অ্যান ইমপ্লিমেন্টেশন গাইডে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষজনকে সম্পৃক্ত করে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। সবচেয়ে বড় প্রয়োজন মা বাবা অভিভাবকদের নিজ নিজ শিশুদের প্রতি সার্বক্ষণিক নজর রাখা। বিশেষত গ্রামে যারা বসবাস করেন তাদের এ ব্যাপারে পরিপূর্ণ সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। ছোট শিশুদের কখনো তাঁদের দৃষ্টির বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। এক সময় গ্রামাঞ্চলে শিশুদের কোমড়ে রেশমের সাথে ঘন্টির মতো কিছু একটা বেঁধে দেওয়া হতো । শিশু হাঁটার সময় বা খেলার সময় আওয়াজ হতো। যাতে করে মা বুঝতে পারত শিশুটি ধারে কাছে আছে। আর যখন শব্দ শোনা যেত না তখন মা বা ভাইবোনেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করত। এতে করে শিশুদের অবস্হান জানা শোনা সম্ভব হতো। শিশুদের পানিতে ডোবার সবচেয়ে বিপজ্জনক সময় সকাল নয়টা থেকে বেলা একটার মধ্যে। এ সময় গৃহে থাকা অভিভাবকেরা সাধারণত গৃহস্হালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। বড় ভাইবোন থাকলে তারা হয় স্কুলে বা অন্যকাজে থাকেন ব্যস্ত। ফলে কাজের চাপে শিশুদের যথাযথ খোঁজ খবর রাখা হয়ে ওঠে না। এ সময় প্রত্যেক মা বাবা অভিভাবককে অবশ্যই নজরদারি বাড়াতে হবে। পুকুর ঘাটে যাতে শিশুরা নামতে না পারে তার জন্য সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করতে হবে। বর্ষাকালে কিংবা বন্যা কবলিত স্হানে শিশু যাতে ঘরের বাইরে যেতে না পারে তার জন্য সামনের এবং পেছনের দরজার মুখে প্রতিরোধক দিতে হবে। মা বাবার সাথে বা অন্য কারো সাথে শিশু বেড়াতে গেলে তাদের চোখে চোখে রাখতে হবে। গ্রামবাংলায় নানার বাড়িতে বা কোথাও বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনাও খুব একটা কম নয়।
উপর্যুক্ত বিষয়গুলো আমরা যদি সতর্কতার সাথে আমলে নিই তাহলে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারি। মনে রাখতে হবে আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীমাতৃক দেশের নাগরিক হিসেবে অবশ্যই একটা নির্দিষ্ট বয়সে শিশুদের সাঁতার শেখাতে হবে। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশের মতো ভারি বস্তুর ভার কিছুটা হালকা করতে হলে সচেতনতাই হতে পারে অনিবার্য উপাদান।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক