প্রসঙ্গ নারী : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস

30

ড. মো. মোরশেদুল আলম

মুক্তিযুদ্ধকালীন শৌর্য-বীর্য, সাহস, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি নারীরা যুদ্ধাহত পুরুষের সেবা-শুশ্রƒষা করেছেন, উৎসাহ প্রদান করেছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন, খাদ্য, ঔষধ, পোশাক সরবরাহ করেছেন, অস্ত্র হাতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসে যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালি নারীর উপর অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও নৃশংসতার বাস্তব চিত্রের পাশাপাশি বাঙালি নর-নারীর বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন।
রাইফেল, রোটি, আওরাত (১৯৭৩) আনোয়ার পাশা (১৯২৮-১৯৭১ খ্রি.) রচিত প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। পঁচিশে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জান্তব নখরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত সময়ের অনুপুঙ্খ উপস্থাপন ঘটেছে এ- উপন্যাসে। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হায়েনারা বাঙালি নারীদের ক্যান্টনমেন্টে আটক রেখে পাশবিক নির্যাতন চালত। এ উপন্যাসের বীরাঙ্গনা পলি, রোজী এবং রোশেনা তেমনই বন্দি শিবিরে আটককৃত নারীর প্রতিচ্ছবি। স্বামী সন্তান নিয়ে পলির সুখের সংসার ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তার সকল সুখ কেড়ে নেয়। তারা পলিকে ধরে এনে গণিকালয়ে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। স্বামী-সন্তান-সংসার হারানো পলির মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা প্রবল আকার ধারণ করে। সে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এক পাঞ্জাবী অফিসারের সাথে প্রেমের অভিনয় করে। ছলে, বলে, কৌশলে তাকে মদ পান করিয়ে মাতাল করে তোলে। তারপর বটি দিয়ে কুপিয়ে তাকে হত্যা করে। কিন্তু এতেও তার মনের জ্বালা মেটেনি। কারণ পাকিস্তানি সেনারা পলির ছোটবোন রোজীকেও ক্যান্টনমেন্টের গণিকালয়ে ধরে এনে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। রোজী তার জীবনের এ নির্মম পরিণতিকে মেনে নিতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ছোটবোনের এ পরিণতি পলিকে আরো বেশি প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। তাই সে সাংবাদিক নাজিম হোসেনের নিকট থেকে একটি মাইন সংগ্রহ করে বুকে বেঁধে মিলিটারি ভর্তি ট্রাকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পলি এভাবে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে বিশ ত্রিশজন পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করে। এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বীরাঙ্গনা রোশেনাও মুক্তিযুদ্ধের সময় বুকে মাইন বেঁধে পাক হানাদার বাহিনীর ট্যাঙ্কের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক প্লাটুন সৈন্য হত্যা করে।
শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮খ্রি.) রচিত দুই সৈনিক (১৯৭৩) উপন্যাসটি মুক্তিযুদ্ধের সময় নারী নির্যাতনের আরেক চিত্ররূপ। পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক বাঙালি নারী ধর্ষণ, পাশবিক অত্যাচার, নির্যাতন এবং ঘরবাড়ি লুটপাট এ উপন্যাসের মূল বিষয়বস্তু। বাঙালিরা যতই মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমর্থক হোক না কেন, হানাদার বাহিনীর পাশবিক অত্যাচার ও নির্যাতন হতে তারাও যে রক্ষা পায়নি তা এ উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মখ্দুম মৃধা আইয়ুব খানের একনিষ্ঠ ভক্ত এবং মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মৃধা তার কলেজ পড়–য়া দুই মেয়ে চামেলী ও সাহেলীকে গ্রামের বাড়ি নিয়ে আসে। একদিন পাক হানাদার বাহিনীর জীপ গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পাকিস্তানের সমর্থক মৃধার বাড়িতে গিয়ে উঠে। পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে ছিল মেজর হাকিম, ক্যাপ্টেন ফৈয়াজ এবং ছয় সাতজন সাধারণ জওয়ান। মৃধা পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষাকারী এ সকল সৈন্যদের ফেরেশতার সাথে তুলনা করেন এবং যথোপযুক্ত আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন। মখ্দুম মৃধার ভাষায়, ‘‘পাকিস্তান-রক্ষা সব মুসলমানদের জন্য ফরজ। আল্লার ইচ্ছা তিনি পাকিস্তান রক্ষা করবেন। তাই তিনি ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। এই মিলিটারিরা সাধারণ সিপাই নয়। ওরা আল্লার ফেরেশতা।” চা-নাস্তা দেওয়ার পর মৃধা তাদের জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে। রাতের খাবার শেষ করে পাকিস্তানি সেনারা মদ্যপান আরম্ভ করে। এ সময় তারা মৃধার দুই মেয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে মৃধা তার মেয়েদেরকে সৈন্যদের সামনে নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেয়। এক পর্যায়ে অফিসাররা তাদেরকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মাতাল সৈন্যদের সাথে মেয়ের বিয়ে দিতে মৃধা অস্বীকৃতি জানায়। এতে তারা রেগে গিয়ে মৃধাকে আটক করে তার দুই মেয়েকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যায়। অসহায় মৃৃধার তাকিয়ে থাকা ছাড়া প্রতিবাদ করার কোন সুযোগ ছিল না। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর মৃধার কাছে তার বৃদ্ধা মায়ের আহাজারি ও অভিযোগের চিত্রটি ঔপন্যাসিক তুলে ধরেছেন। ‘‘কথা কস না ক্যান? মুখে রাও নাই ক্যান? পাকিস্তান বানাইছিলি না? তহন হিন্দু মাইয়াদের উপর জুলুম অইলে কইতিস অমন দু’একডা অয়। অহন দ্যাখ্ আল্লার ইনসাফ আছে কি না।” মেয়েদের শোকে ও তাদের রক্ষা করতে না পারার যন্ত্রণায় মখ্দুম মৃধা অবশেষে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।
ফেরারী সূর্য (১৯৭৪) রাবেয়া খাতুন (জ. ১৯৩৫খ্রি.) রচিত একটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র রাশা মুক্তিযুদ্ধের সময় পিতৃহারা হয়। পিতার বুলেটবিদ্ধ লাশ বটি দিয়ে মাটি খুঁড়ে কাফন ছাড়াই কবর দেয়। পিতা এবং ভাইকে হারিয়েও মুক্তিযোদ্ধা আশেকের প্রেমিকা রাশা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সে আশেককে প্রেরণা যুুগিয়েছে। এ উপন্যাসের আরেক চরিত্র খালেদের স্ত্রী বকুল। স্বামী সন্তান নিয়ে তার ছিল সুখের সংসার। মুক্তিযুদ্ধের সময় একদিন পাকিস্তানি সেনারা বাড়িতে এসে বকুলকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে যায়। শারীরিক নির্যাতনের পর তাকে জীপে করে বাড়ির সামনে ফেলে রেখে যায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা নির্যাতনের পর বকুলের অবস্থার বর্ণনা দিয়ে গিয়ে ঔপন্যাসিক বলেন, ‘‘নখরাঘাতে ফালা ফালা, নিজেরই-রক্তে মাখামাখি এক টুকরো মাংস। নগ্ন, কিন্তু প্রাণের স্পন্দনে তখনো উষ্ণ। ওকে পাঁজাকোলে তুলে খালেদ অবাক হয়ে দেখলো যে বকুলের জন্য পরিবারে উৎকন্ঠার অন্ত ছিলো না এই মুহূর্তে তার পাশে কেউ নেই।” এ উপন্যাসের বকুল চরিত্রের মত অসংখ্য বাঙালি নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পরিবারে ফিরে গেলেও তাদের আর স্বাভাবিকভাবে কেউ গ্রহণ করে নি। ফলে এদের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। এ উপন্যাসের বকুলও শেষ পর্যন্ত মুক্তির পথ হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিয়েছে। যদিও বকুলের স্বামী খালেদ পাক বাহিনী কর্তৃক বকুলের উপর নির্যাতনকে নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে। কিন্তু বকুল অনুভব করতে পেরেছে তার শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ তাকে বাঁকা চোখে তাকাবে। সে বুঝতে পেরেছিল বেঁচে থাকলেও বাকী জীবনটা স্বামীর অনুগ্রহ নিয়ে বাঁচতে হবে। এভাবে বেঁচে থাকাটা তার কাছে অর্থহীন মনে হয়। তাই সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।
হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের (জ. ১৯৪৭ খ্রি.) অন্যতম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র হলদী গাঁয়ের বুড়ি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি মায়েরা দেশাতœবোধ ও দেশপ্রেমের যে পরিচয় দিয়েছেন এ উপন্যাসের বুড়ি চরিত্রটি তারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। চাচাত ভাই বিপতœীক গফুরের সাথে বুড়ির বিয়ে হয়। গফুরের প্রথম স্ত্রীর দুই ছেলে ছিল সলীম ও কলীম। অনেক সাধনার পর বুড়ির কোলজুড়ে রইস নামের একটি পুত্র সন্তান আসে। কিন্তু রইসের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুড়ি বুঝতে পারে তার বহুপ্রত্যাশিত ছেলেটি বোবা। তবুও স্বামীর মৃত্যুর পর বোবা ছেলে রইসই তার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠে। যুদ্ধের সময় বুড়ির সৎ ছেলে সলীমের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি গ্রামের মনসুর মেম্বারের মাধ্যমে পাকিস্তানিরা জানতে পারে। তখন তারা সলীমের খোঁজ নিতে বুড়ির বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। বুড়ির কাছে কোন উত্তর না পেয়ে তারা কলীমকে গুলি করে হত্যা করে। মিলিটারিদের হাতে কলীমের মৃত্যুর পর বুড়ির মনোজগতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। হলদী গাঁয়ের জন্য কিছু করতে তার মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। একদিন কাদির ও হাফিজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা হলদী গাঁয়ের মিলিটারি ক্যাম্প আক্রমণ করে। প্রথম দিকে ভাল করলেও গোলাবারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হঠতে বাধ্য হয়। হাফিজ ও কাদির পালিয়ে বুড়ির বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বুড়ি ঘরের মধ্যে লুকিয়ে রাখা এল.এম.জি’টা ছেলে রইসের হাতে তুলে দিয়ে ঠেলে ঘরের বাইরে বের করে দেয়। অস্ত্রসহ রইসকে পেয়ে সৈন্যরা ঘরে না ঢুকে সোল্লাসে বেরিয়ে যায়। বুড়ি অনুভব করে তার বুকের কলজেটা ওরা খাবলে নিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর বুড়ি গুলির শব্দ শুনতে পায়। বুড়ি বোবা ছেলে রইসের নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দিয়ে বাঁচিয়ে দেয় কাদির ও হাফিজের মতো মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন।
রক্তের অক্ষর (১৯৭৮) রিজিয়া রহমান (জ. ১৯৩৯ খ্রি.) রচিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস। এ উপন্যাসের নায়িকা উচ্চ শিক্ষিতা বীরাঙ্গনা নারী ইয়াসমীন। মুক্তিযোদ্ধা কামালকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ইয়াসমীনের মা, বাবা, ভাই, বোনকে হত্যা করে। তারা ইয়াসমীনকে বন্দি করে পাশবিক নির্যাতন চালায়। দীর্ঘদিন দুঃসহ নির্যাতন ও বন্দি জীবন শেষে মুক্তিযুদ্ধের পর ইয়াসমীনের ঠাঁই হয় একটি নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। দীর্ঘদিনের প্রেমিক যে সারাজীবন সুখে দুঃখে তার পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিল, স্বাধীন দেশে সে তার দায়িত্ব না নিয়ে অনুকম্পা প্রকাশ করেছিল। তার আত্মীয় স্বজনও সমাজে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে তাকে আশ্রয় দেয় নি। এমনকি তাদের পরিচয় দিতেও নিষেধ করেছিল। পরিবার-পরিজনের আশ্রয় হারিয়ে একজন শিক্ষিতা নারী হিসেবে আত্মনির্ভরশীল হতে গিয়েও সে ব্যর্থ হয়। চাকরির ক্ষেত্রে বীরাঙ্গনাদের সুযোগ দেওয়ার সরকারি ঘোষণা সত্তে¡ও নিয়োগকারী কর্মকর্তাদের কুরুচিপূর্ণ প্রশ্নের প্রতিবাদ জানালে তার আর চাকরি হয় নি। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় সম্পত্তির লোভে এক প্রতারক পুরুষ তাকে বিয়ে করে। তার উদ্দেশ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় ইয়াসমীনের দখল হয়ে যাওয়া বাড়িটি উদ্ধার ও ভোগ দখল এবং ইয়াসমীনের শরীরকে ব্যবহার করে ফায়দা আদায় করা। প্রতিদিন নিত্যনতুন পুরুষের সঙ্গী হতে তার স্বামী তাকে বাধ্য করে। স্বামীর নির্যতানে ইয়াসমীনের শেষ পর্যন্ত পতিতালয়ে ঠাঁই হয়। অসংখ্য নারীর জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে দেশ স্বাধীনতা অর্জন করে, সেই দেশের সুবিধাভোগী মানুষের প্রতি প্রবল ঘৃণায় ইয়াসমীন বলে, ‘‘যুদ্ধ যদি আমাকে বেশ্যাই বানাল, তবে তার ফলভোগ ওই ক্রীম খাওয়া লোকদের করতে দেব না। আমি বেশ্যা। আমি বেশ্যা হয়েই যাবো।’’ ইয়াসমীনের এ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদে স্বাধীনতা-উত্তরকালে নির্যাতিতা নারীদের মানসিক যন্ত্রণা যেমন অভিব্যঞ্জিত হয়েছে, তেমনি সমকালীন সমাজ বাস্তবতাও ফুটে উঠেছে। পতিতালয়ের অন্ধকার জগতেই গুÐা হীরুর ছুরিকাঘাতে শেষ পর্যন্ত ইয়াসমীনের মৃত্যু ঘটে।
নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১) সৈয়দ শামসুল হকের (জ. ১৯৩৫ খ্রি.) মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম। জলেশ্বরী গ্রামের আলেফ মাষ্টারের মেয়ে বিলকিস এ উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্র। যুদ্ধকালীন সময়ে সে মা-বাবা, ভাই-বোন এবং সন্তানদের খবর নিতে ঢাকা থেকে নিজ গ্রাম জলেশ্বরী আসে। মুক্তিযোদ্ধা মনসুরের নির্দেশে সিরাজ নামধারী প্রদীপ বিলকিসকে জলেশ্বরী পৌঁেছ দেয়। জলেশ্বরীর বাজারে এসে সে দেখতে পায় পাক হানাদার বাহিনী দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা। তারা বিলকিসের ছোট ভাই খোকাকেও হত্যা করে। মিলিটারিরা লাশগুলো দাফন করতে নিষেধ করে। বাজারের খোলা ময়দানে লাশ পড়ে আছে এবং তা দাফন করতে পারবে নাÑএ বিষয়টি বিলকিসের মনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বিলকিস এক পর্যায়ে সিরাজের সহায়তায় মৃতদেহগুলোকে দাফনের উদ্যোগ নেয়। এভাবে সিরাজ ও বিলকিস দিনে পাটের গুদামে আশ্রয় নেয় আর রাতে মৃত লাশগুলো দাফনের ব্যবস্থা করে। কিন্তু একদিন হানাদার বাহিনীর দোসর বিহারীদের দ্বারা ধৃত হয়ে তারা পাকিস্তানি ক্যাম্পে বন্দি হয়। সৈন্যরা জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানতে পারে সিরাজের আসল নাম প্রদীপ। তারা প্রদীপ ও বিলকিসকে ভাই-বোন মনে করে। এরপর তাদের উপর শুরু হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। এক পর্যায়ে তারা বিলকিসের সামনেই সিরাজ নামধারী মুক্তিযোদ্ধা প্রদীপকে হত্যা করে। পাকিস্তানি মেজর বিলকিসকে ভোগ করতে অগ্রসর হলে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য সে ছলনার আশ্রয় নেয়। তাকে ভোগ করার শর্ত হিসেবে প্রদীপের লাশ সৎকারের ব্যবস্থা করতে বলে। সৎকারের জন্য আগুন জ্বালানো হলে বিলকিস হঠাৎ মেজরকে আলিঙ্গন করে চিতার আগুনে ঠেসে ধরে। বিলকিসের আত্মত্যাগ ও মেজরকে পুড়িয়ে মারার মধ্য দিয়ে সে তার প্রতিশোধ স্পৃহা পূর্ণ করে।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক, চ.বি.