প্রসঙ্গ : ঘুণেপোকা, অন্তর্ঘাতক এবং অনিবার্য পতন

3

এম.এ. মাসুদ

আমাদের সমাজে এমন এক খাসলতের কিছু মানুষ আছেন যারা উপরে সাধু আর তাদের ভিতরটা শয়তানীতে ভরপুর। এ জাতীয় মানুষেরা বিনামূল্যে অপরের উদ্দেশে উপদেশ বিলিয়ে থাকেন। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ঘরোয়া বৈঠক বা যে কোন জনসমাগম স্থলে এই স্বভাবের ব্যক্তিরা জনগণের উদ্দেশে উপদেশ খয়রাত করেন। এই অভ্যাস বা খাসলত তাদের মজ্জাগত। এই উপদেশ বিতরণকারীদের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারী ক্ষমতাধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং আমলারাও থাকেন। এই সকল উপদেশ বিতরণকারীরা এমনভাবে তাদের মুখ নিসৃত বাণী প্রদান করে থাকেন, যাতে মনে হয় তারাই একমাত্র ন্যায়ের ফেরিওয়ালা, সত্যবাদী যুধিষ্ঠির এবং তারাই সকল ভাল কর্ম করে থাকেন। শুধু তারাই পরোপকারী দানবীর। অর্থাৎ সকল ভাল কিছুর সোল এজেন্ট শুধু তারাই এবং তাই তারা জনগণকে ভাল হওয়ার, সৎ হওয়ার, দায়িত্ববান হওয়ার, দেশের কল্যাণে ব্রতী হওয়ার, দেশের মানুষের সুখে-দুঃখের সাথী হওয়ার উপদেশ দিয়ে বেড়ান। অথচ পর্দার অন্তরালে তারা ভিন্ন মানুষ।
সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, রাজনীতিবিদ বা অতি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত থাকা আমলা বা কর্মকর্তা যখন কোন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বা সভা-সমিতিতে সরকারী-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বা জনগণের উদ্দেশে সততার সাথে চলার, সৎ ভাবে দায়িত্ব কর্তব্য পালন করার উপদেশ দিয়ে থাকেন, তখন মনে হয় যেন তাঁরা কতই না সৎ এবং তাঁরা সৎ বলেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদসমূহে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছেন। এসব মানুষেরা বাইরে সততার অভিনয় করেন, মানুষের কল্যাণ কামনায় প্রাণপাত করেন, কিন্তু তাঁরা কোন বিবেচনাতেই সৎ বা জনকল্যাণকামী নন, এরা নিজেদের কল্যাণকামী। প্রকৃতপক্ষে তাঁরা এই সব ভন্ডামীর মাধ্যমে দেশ ও সমাজের মানুষের দৃষ্টিতে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হওয়ার প্রয়াসী হন। এরা হলেন সর্ষের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা ভূত, এরা হলেন ঘুণে পোকা, এরা হলেন অন্তর্ঘাতক এবং এরা হলেন ফ্রাংকেস্টাইন। বিগত ১৬ বছর এই পরজীবী ঘুনে পোকা, অন্তর্ঘাতক ফ্রাংকেস্টাইনদের নিরাপদ বিচরণ ভূমি ছিল আওয়ামী সরকার এবং এর নিয়ন্ত্রণাধীন এবং প্রভাবাধীন সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান। এরা নিজেরা লুটেপুটে খেয়ে আখের গুছিয়ে মোটা তাজা হয়েছেন আর সরকারের সর্বনাশ সাধন করেছেন।
গত জুলাই ও আগস্টের শুরুর দিকে নির্মম নির্যাতন, উৎপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি, হত্যা, গুম ও দুঃসহ যাতনার কণ্ঠক পথ পেরিয়ে বিপুল সম্পদহানি, সহ¯্রাধিক জীবনহানি, পাঁচ শতাধিক মানুষের পঙ্গুত্বের বিনিময়ে বাংলাদেশের ছাত্রদের নেতৃত্বে যে অভূতপূর্ব ও নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার বিপ্লব সংগঠিত হল, সমগ্র বিশ^বাসী তা অবাক বিস্ময়ে দেখেছে। বাংলাদেশের মানুষ যাদের এতদিন বিশ^াস করে এসেছিল, যাদেরকে শেষ ভরসাস্থল মনে করেছিল – এই গণ অভ্যুত্থানের কারণে এই বিশ^াসের জায়গাগুলির কর্ণধারদের অনৈতিকতা, নৃশংসতা, সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজন তোষণ, ব্যাংক লুট, খুন, গুম, রাজনীতির মাঠ ভিন্ন মতাবলম্বী শূন্য করা, ভিন্ন মতের মানুষের বিরুদ্ধে শত শত মামলা দিয়ে বাড়িছাড়া করা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ এবং আমলাদের ব্যাপক সুযোগ সুবিধা দিয়ে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে তোলার মাধ্যমে যেভাবে লুটপাটে এবং অনৈতিক কাজে নিজেদেরকে সংশ্লিষ্ট করেছে তা জেনে জনগণ হতবাক। জনগন যাদের এতদিন সাধু হিসেবে দেখে এসেছে, এখন তাদেরকে খল আর শয়তান রূপে দেখে যেমন চমকিত তেমনি বিস্মিত। তারা দেখল যে, দেশের মন্ত্রী-এমপি, সাবেক সেনা প্রধান ও তাঁর ভাতৃদ্বয়, সাবেক পুলিশ প্রধান এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তা, ঊর্ধ্বতন আমলা, ব্যাংকার, দেশের সরকার প্রধান এবং বিচারপতি পর্যন্ত সবাই আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিজেদের জড়িত করে দেশে-বিদেশে দেশের মান-সম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছেন। গত ১৬ বছর সুবিধাবাদী আমলা, লোভী ব্যবসায়ী, চাটুকারিতায় পারাঙ্গম মন্ত্রিসভা, এমপিগণ, গৃহপালিত বিরোধীদল ও পেশাজীবী এবং ব্যাংক লুটেরা দ্বারা পরিবেষ্টিত সরকার প্রধান শেখ হাসিনা তোষামোদে আমোদিত ও বুঁদ হয়েছিলেন। এই গন্ডি থেকে তিনি বের হতে পারেননি, তাঁকে ভাল উপদেশ দিয়ে সঠিক পথ দেখাবার জন্য ছিল না কোন সৎ উপদেষ্টা, আর তিনিও কারো উপদেশ শোনার জন্য আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়নি। সরকার প্রধান যাদের দ্বারা গত ১৬ বছর পরিবেষ্টিত ছিলেন তারা সবাই সরকারের ভিতরে থাকা। ঘূনে পোকা আর অন্তর্ঘাতক। এরা গত ১৬ বছর সরকারের মধ্যে থেকে ঘুণে পোকার মত অন্তর্ঘাত করে ফ্রাংকেস্টাইনে পরিণত হয়েছেন আর তাঁর পতনকে অনিবার্য করে তুলেছেন। এই পতনকে রোধ করার সাধ্য কারো ছিল না।
১৭৫৭ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ২৬৭ বছর আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ নামের এই ভূখÐ শাসন করেছে অনেক স্বৈরাচারী আর অত্যাচারী শাসক। অনেকবার হানা দিয়েছে বর্গী, ওলন্দাজ-আরাকান জলদস্যু আর ইংরেজ লুটেরা। ইংরেজ দখলদার, পাকিস্তানী এবং স্বদেশীয় স্বৈরাচার কর্তৃক এদেশের মানুষ লাঞ্ছিত, লুণ্ঠিত নিষ্পেষিত এবং মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হয়েছে বার বার। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়স ৫২ বছর। স্বাধীনতার পর অর্ধ শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও এদেশের মানুষ এখনো পেল না অর্থনৈতিক মুক্তি, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার। বৃটিশ আমল, পাকিস্তান আমলের ২৪ বছর এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অধিকার হারা হয়ে নিজ দেশে পরবাসীর মত ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষ ভেবেছিল এবার তাদের লাঞ্চনা-বঞ্চনা নিগ্রহের অবসান হবে। কিন্তু ৫২ বছরের অধিকাংশ সময় এদেশের মানুষের দুঃখের রজনীর অবসান হয়নি, বরং গত ১৬ বছরের সময়কালে মানুষের যাপিত জীবনে নেমে আসে ভয়-আতংক, ক্ষুধা আর টুটি চেপে ধরা ভাষাহীন কণ্ঠের ভীতিজনক নিরবতার অমানিশা। মানুষের, মৌলিক, রাজনৈতিক, কথা বলার অধিকার খর্ব করে মানুষের পিটকে দেওয়ালে ঠেকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র-গণমানুষের রুদ্র রোষ টগবগ করে ফুটছিল এবং এক পর্যায়ে এরই রোষ বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত অনৈতিকতার সকল হোতাদের ভাসিয়ে নিয়ে গেল। জাতি- ধর্ম-নিবিশেষে সকল মানুষ স্বস্তির নিশ^াস ফেলল। ৫ই আগস্ট এই দুর্ভাগা দেশের ১৮ কোটি ভাগ্যাহত মানুষের জীবনের ভাগ্যাকাশে এমন এক সোনালী সূর্যের উদয় ঘটল যে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল ৫৪ হাজার বর্গমাইল আয়তনের এই বাংলাদেশের প্রতিটি প্রান্ত। এদেশের লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, নিষ্পেষিত যে মানুষকে এতদিন বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে, তাদের কণ্ঠকে রুদ্ধ করে, তাদের মৌলিক অধিকার খর্ব করে, তাদের মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করেছিল আওয়ামী সরকার, আজ এই নিপীড়িত ছাত্র-জনতা দুর্বিষহ যন্ত্রণা, জেল-জুলুম উপেক্ষা করে, আয়না ঘরের কপাট ভেঙ্গে উন্নত মস্তকে নূতন সূর্যের আলোয় অবগাহন করে মুক্ত বাতাসে নিশ^াস নিতে, চোখ ভরে বাংলার শ্যামলিমা আর নীল আকাশ দেখতে আবাল বৃদ্ধবণিতা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। তাদের এক বুক আশা, তাদের চোখে স্বপ্ন, এদেশে আবার শান্তি ফিরে আসবে, সকল দল-মত, জাতি-ধর্মের মানুষ এই দেশে শান্তিতে বসবাস করবে, এখানে থাকবে না ব্যাংক লুটেরা, থাকবে না দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ-আমলা, এদেশের শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে, মানুষে মানুষে সৌহার্দ্য বিরাজ করবে, বটতলা, হাটখোলায় মেলা জমবে আবার। এদেশের তরুণ সমাজ আবার শিক্ষায়-দীক্ষায়, মেধায় তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে জগত সভায় তাদের মাথা উঁচু করে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করবে।
পুনশ্চ ঃ গত ২৫ আগস্ট রাত সাড়ে সাতটায় জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর প্রদত্ত ভাষণে আনসারদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া সম্পর্কে বলেছেন যে, আনসারদের সকল সমস্যার যৌক্তিক সমাধান করা হবে এবং ইতিমধ্যে তাদের একটি প্রধান দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে আনসারদের সমস্যা সমাধানের প্রধান উপদেষ্টার এই আশ্বাস সত্ত্বেও কতিপয় আনসার সদস্যের সচিবালয় ঘেরাও করার মত এই বেআইনী ও হটকারী কাজ ক্ষমার অযোগ্য। এর পিছনে পতিত সরকার এবং বিদেশি চক্রান্ত থাকতে পারে। এর তদন্ত হওয়া উচিত এবং এর হোতাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

লেখক : বর্ষিয়ান নাগরিক ও সমাজকর্র্মী