প্রবীণ নাগরিক অধিকার সুরক্ষা প্রসঙ্গে

7

মুশফিক হোসাইন

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আছে ‘সকল জীবকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।’ জীবের মৃত্যু যে কোন সময় আসতে পারে! সাধারণত: পৌঢ়ত্বে বা বৃদ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হানা দেয়। এ হচ্ছে মহান সৃষ্টি কর্তার প্রচলিত নিয়ম। আজ যে নবীন কালের প্রবাহে কাল সে প্রবীণ। প্রবীণ বলতে বাবা, মা, দাদা, দাদী, নানা, নানী বা গুরুজনদের বোঝানো হয়। মনে রাখতে হবে, সমাজের সকল বয়োজ্যেষ্ঠদের আমরা প্রবীণ বলে গন্য করবো। বাংলাদেশের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩ অনুযায়ী ৬০ বছরের বেশি বয়সী বাংলাদেশিদের প্রবীণ বলে বিবেচনায় আনতে হবে। জাতিসংঘ ১৯৯০ সালে ঘোষণা করে ১৯৯১ সালের পহেলা অক্টোবর। বিশ্ব প্রবীণ দিবস’ হিসাবে পালিত হবে। ১৯৯১ সালে টঘঐজঈ এর জেনারেল অ্যাসেম্বলি সরকারী কর্মসূচি উন্নয়নে নির্দেশনা ও উৎসাহিত করার নীতিমালা প্রবর্তন করে। যাতে প্রবীণদের স্বাধীনতা, অংশগ্রহণ, যতœ, আত্মতৃপ্তি এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য প্রবীণ অধিকার নীতিমালা প্রতিষ্ঠা করে। ২০০২ সালে স্পেনের মাদ্রিদে ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের প্রবীন বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি সুসংবদ্ধ আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। ‘মাদ্রিদ’ ঘোষণায় বলা হয় প্রবীণগণ পূর্ণ অধিকার, সার্বিক নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বাঁচবে।
সকল মানুষই এক পর্যায়ে প্রবীণ হয়ে থাকেন। প্রবীণ বয়সে তাঁরা দৈনন্দিন জীবিকা অর্জনের কাজ থেকে অবসর গ্রহণ করে। এ সময় তাঁদের বেশির ভাগেই শারীরিক দুর্বলতায় ভুগে থাকে। ফলতঃ অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সংসারে, সমাজে নানাবিধ সমস্যাও অসুবিধার সম্মুখীন হতে থাকেন। এই সমস্যাগুলো পারিবারিক, অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্তি¡ক। উপার্জন করার ক্ষমতা বা সামর্থ্য না থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রবীণদের গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। ফলে তাঁরা নানাবিধ অবহেলা ও উপেক্ষার শিকার হতে থাকেন। আশ্রয় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা কঠিন হয়ে পড়ে। যাঁরা এতোদিন পরিবারে কর্তৃত্ব করেছেন, তাঁরা পরিবার বা অন্যের দয়াদক্ষিণের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে তাঁদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে প্রবীণদের সমস্যা ও অধিকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। উন্নতি বিশ্বে সরকারিভাবে তাঁদের সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা আছে। আমাদের সকলের পরিবারে বা আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে কেউ না কেউ প্রবীণ আছেন। পাড়া প্রতিবেশি, পতে ঘাটে, চলাফেরায় প্রবীণদের দেখা মেলে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারনা করছেন ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে প্রতি পাঁচ জনে একজন প্রবীণের দেখা মিলবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আদি যুগেও প্রবীণগণ শ্রদ্ধারপাত্র ছিলেন। সমাজে, গোত্রে তাঁরা বিশেষ সুযোগ সুবিধা ভোগ করতেন। আধুনিক সমাজেও উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের যথেষ্ট মর্যাদা ও সম্মানের সাথে দেখা হয়। শুধুমাত্র ব্যতিক্রম বাংলাদেশে। স্বাধীনতা পূর্বে সমাজে এই অবস্থা ছিল না। অথচ আমরা বিশ্ব প্রবীণ দিবস উপলক্ষে সভা সেমিনার, পথযাত্রা ও সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করে চলছি। ইতিমধ্যে দেশে প্রবীণ হৈতষী সংঘ, প্রবীণ নাগরিক ফোরাম, সিনিয়র সিটিজেন সোসাইটি, প্রবীণাশ্রম, জরা বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র ইত্যাদি সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। সকলের উদ্দেশ্য প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষা ২০২২ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘প্রবীণ নাগরিক ফোরাম চট্টগ্রাম।
বাংলাদেশে ১৯৯৮ সাল থেকে ‘বয়স্ক ভাতা’ স্কীম চালু হয়েছে। বর্তমানে ৬০০ টাকা করে ৩১ লক্ষ প্রবীণ এই সুবিধা ভোগ করছে। এখানেও নয় ছয়ের অভিযোগ আছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ও আইন থাকা সত্তে¡ও আক্ষরিক অর্থে দেশের প্রবীণগণ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। অতএব সরকার ও দেশবাসীদের প্রবীণদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় আরও সচেতন ও গুরুত্ব দিতে হবে। তাঁদের যথার্থ মূল্যমানপূর্বক কল্যাণকর কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না অতীতে এক সময় প্রবীণগণ তাদের দীর্ঘ জীবনাচরণে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতায় বেশ সমৃদ্ধ ও প্রজ্ঞাবান ছিলেন। তারা ঐ সময় সমাজ দেশের সেবা করেছেন। বিশ্বব্যাপী জ্ঞান বিজ্ঞান ও স্বাস্থ্যখাতে উন্নতির কারণে মানুষের গড় আয় বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। গড় আয়ু বাড়ার ফলে বিশ্বে এবং বাংলাদেশে প্রবীণদের সংখ্যা ও বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রবীণ সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৬.১৪ শতাংশ। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যা দ্বিগুন হবার আশংকা করছেন। পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বে ৪৭ শতাংশ পুরুষ এবং ২৪ শতাংশ নারী অনানুষ্ঠানিক শ্রমে নিয়োজিত। বাংলাদেশে ৬৪ শতাংশ। এ তথ্য থেকে এটা প্রমানিত যে, সুযোগ ও গুরুত্ব পেলে প্রবীণরা অবদান রাখতে পারেন। অতএব প্রবীণগণ যাতে দেশের চলমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও জীবন এবং শিক্ষায় তাঁদের অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে পারে। তবে সে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।
পরিশেষে প্রবীণদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক। একাকিত্ব, কর্মহীনতা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, যথাযথ চিকিৎসা না পাওয়া, নাগরিক পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা ও সুবিধার বঞ্চনা, বিনোদনের সুযোগ না থাকা, যৌন অতৃপ্তি, মানসিকভাবে চাঙ্গা না থাকা, যৌন অতৃপ্তি, মানসিকভাবে চাঙ্গা না থাকা, শারীরিক অক্ষমতা, ইত্যাদি। এছাড়াও মস্তিস্কের শক্তি কমে যাওয়ায় আল জাইমার, ডিমেনশিয়া, পার্কিনসন্স এবং অনেক ক্ষেত্রে অস্টিও পরোসিস, অন্টিও আর্থ্রাইটিস, পোস্ট্রেট বৃদ্ধি, হৃদরোগ, ডাইবেটিস, চোখের ছানি ইত্যাদি নানাবিধ জটিলতা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। প্রবীণদের এই সকল সমস্যা নিরসনে জরাবিজ্ঞান ও চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিটি শহরে স্থাপন এখন সময়ের দাবি। ঢাকায় যে চিকিৎসা কেন্দ্র বা হাসপাতাল আছে, দেশের দূর দূরান্তের প্রবীণগণ সেখানে চিকিৎসা গ্রহণে সম্ভব নয়।
দেশে যৌথ পরিবার ভাঙ্গছে। তার অন্যতম কারণ শিক্ষিত প্রজন্ম পেশাগত কারণে গ্রাম শহর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়া প্রবাস গমন অন্য একটি কারণ। সাম্প্রতিক সময়ে স্থায়ীভাবে বসবাস বা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে বিদেশে যাওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাড়ির মুরব্বী বা প্রবীণরা নিজ বাসস্থানে একাকী থাকতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় প্রবীণদের যথাযথ পরিচর্যাও দেখভাল করার জন্য পাড়ায়, গ্রামে বা নগরে ‘পেরেন্টস ক্লাব’ বা ‘প্রবীণ বন্ধু’ জাতীয় ক্লাব গড়ে তুলতে হবে। যেখানে সাংস্কৃতিক বিনোদন, লাইব্রেরী, চিকিৎসা সুবিধা, প্রার্থনা ঘর, ফ্রি অনলাইন সুযোগ সুবিধা, মানসিক স্বাস্থ্য, কেয়ার গিভার ও প্রশিক্ষিত নার্সের সুযোগ থাকতে পারে। প্রবীণ জনসংখ্যার সঠিক নিবন্ধন বা শুমারী বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়াও স্বাস্থ্য সেবা, যানবাহন, অফিস আদালত, ব্যাংক প্রভৃতি স্থানে পৃথক কিউর ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
দেশ ও সমাজের জন্য যাঁরা সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়ার উদাত্ত আহŸান জানাই। এইসব কর্মকান্ডে তরুণ প্রজন্মকে সাথে রাখতে হবে। তাঁদের সংহতি জোরদার ছাড়া প্রবীণদের অধিকার সুরক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত সেবাদানকারী সৃষ্টির জন্য প্রনোদনা দিয়ে সংস্থা বা ইনস্টিটিউটেড প্রতিষ্ঠা জরুরি। কারণ দেশে এবং প্রবাসে দক্ষ সেবা দানকারীদের প্রচুর চাহিদা। এতে করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্য একটি দুয়ার খুলে যাবে। সর্বশেষে প্রবীণদের প্রতি আহŸান শরীরের যত ওজন, খাদ্যগ্রহণে তত ক্যালোরী গ্রহণ করতে অভ্যস্থ হোন।
প্রাবন্ধিক নিসর্গী, ব্যাংক নির্বাহী (অব)।