প্রধান উপদেষ্টাসহ তিনজন হাটহাজারীর, খুশির বন্যা

3

হাটহাজারী প্রতিনিধি

বাংলাদেশের নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানসহ তিন উপদেষ্টা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর হওয়ায় উপজেলাজুড়ে বইছে খুশির বন্যা। তাদের গ্রামের বাড়ি উপজেলার তিন ইউনিয়নে। সরকারে উপজেলাটির তিনজন স্থান পাওয়ায় ব্যাপক উচ্ছ¡সিত উপজেলাবাসী।
গত বৃহস্পতিবার রাতে শপথ নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের নজুমিয়া হাট এলাকার বাথুয়া গ্রামের সন্তান। তিনি হাজী নজুমিয়া বাড়ির প্রয়াত দুলা মিয়া সওদাগরের ছেলে। প্রামীণ ব্যাংকের এই প্রতিষ্ঠাতা পরিবারের আট ভাই দুই বোনের মধ্যে তৃতীয়। তাঁর পিতা পারিবারিক পেশা বদল করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বক্সিরহাটে স্বর্ণের গহনার ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
এছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরেক উপদেষ্টা (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়) গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর জাহান বেগম। তিনিও উপজেলার বুড়িশ্চর ইউনিয়নের নজুমিয়া হাট মসজিদ সংলগ্ন দোয়ার বাড়ির প্রয়াত আহমদ মিয়ার মেয়ে। তিনি তাঁর পরিবারের তিন ভাই তিন বোনের মধ্যে পঞ্চম। তাঁর পিতা কাপড় ব্যবসায়ী ছিলেন।
অপর উপদেষ্টা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের গুল মোহাম্মদ চৌধুরী বাড়ির প্রয়াত মনির আহম্মদ চৌধুরীর ছেলে। তিনি তাঁর পরিবারের চার ভাই পাঁচ বোনের মধ্যে বড় সন্তান। তাঁর পিতা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আর্মি মেডিকেল কোরে কর্মরত ছিলেন। যদিও বর্তমানে ফারুক-ই-আজম ঢাকার বাইরে থাকায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণ করতে পারেননি।
শিকারপুর ইউনিয়নের সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান লোকমান হাকিম মেম্বার বলেন, নতুন সরকারের প্রধান ড. ইউনূস একজন ভালো মানুষ। তিনি দেশটাকে সাজাতে পারবেন। তবে, দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের যে ঊর্ধ্বগতি তা নিয়ন্ত্রণে রাখাসহ জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে। সর্বোপরি দেশে শান্তি ফিরে আসুক সেটাই চাই।
হাটহাজারী সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফাতেমা আক্তার মিম বলেন, নতুন সরকারের কাছে কোটা বৈষম্য আন্দোলনে অংশ নেওয়া দেশের সকল শিক্ষকার্থীর নিরাপত্তা চাচ্ছি।এই দেশ কেমন চাই, শিক্ষাব্যবস্থা কেমন চাই, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন চাই, আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা কেমন চাই এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের যে রিফর্ম সেটা কীভাবে হবে- এই পাঁচটা পয়েন্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি এই ৫টা পয়েন্ট পূর্ণ হয়, তাহলে আমরা বলবো এই আন্দোলন সাকসেস হয়েছে।
ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের মো. মুজিবুল আলম চৌধুরী জানান, নতুন সরকারকে আইনশৃঙ্খলা ভালোর দিকে নিয়ে আসতে হবে। দেশে চলমান পরিস্থিতি তথা সন্ত্রাসী, রাহাজানি, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি- এগুলো যেন না হয়। আমরা সাধারণ মানুষ যাতে সাধারণভাবে খেয়ে-পরে থাকতে পারি। পাশাপাশি শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতিসহ সাধারণ জনগণের যে চাওয়া-পাওয়া সেগুলোকে পূর্ণ করার বিষয়টি প্রত্যাশা রাখছি।
হাটহাজারী পৌরসভা এলাকার বাসিন্দা অ্যাড. হাদী সরফুদ্দিন হায়দার জানান, বর্তমান সরকারকে বিচার বিভাগ দলীয়করণ ও বর্তমান দলীয় বিচারপতি এবং তাদের দোষরদের করে আসা অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া নি¤œ আদালতে সাধারণ মানুষের আস্থা বিনষ্ট হয়েছে তা অতি শীঘ্রই ফিরিয়ে আনতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে জানা যায়, তিনি নগরীর বলুয়ারদীঘি স্কুল থেকে প্রাইমারী, এমইএস স্কুলে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় ১৬তম স্থান অধিকার করে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৭ সালে মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে বিএ এবং এমএ সম্পন্ন করেন। ১৯৬২ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেন।
এরপর ১৯৬৫ সালে তিনি স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যান। ভেন্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যায় থেকে ১৯৬৯ সালে অর্থনীতিতে পিএইচডি লাভ করেন তিনি। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করেন। এরপর স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭২ সালে দেশে ফিরে মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন এবং বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এই পদে কর্মরত ছিলেন।
ক্ষুদ্রঋণ ধারণার প্রবর্তক মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেরা ফতেপুরের জোবরা গ্রামের সেই নবযুগ খামার থেকে ১৯৭৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ক্ষুদ্রঋণ’ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারণা নিয়ে বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এই পুরস্কার লাভ করেন। ইউনূস বিশ্ব খাদ্য পুরস্কারসহ আরও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন।
নূরজাহান বেগম সম্পর্কে জানা যায়, ১৯৭৬ সালে যখন তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রকল্প শুরু করেন, তখন তিনি ড. ইউনূসের প্রথম সারির সহযোগিদের একজন ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী নুর জাহান বেগম অনেক দেশে ক্ষদ্র ঋণ প্রকল্পের পরামর্শদাতা, প্রশিক্ষক এবং মূল্যায়নকারী হিসাবে কাজ করেছেন। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের তৃণমূল গোষ্ঠীতে দরিদ্র গ্রামীণ মহিলাদের সংগঠিত ও প্রশিক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালনের পাশাপাশি গ্রামীণ ফাউন্ডেশন, ইউএসএসহ বেশ কয়েকটি সংস্থার বোর্ডেও দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যাংকের শুরুর দিকে এবং সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দিনে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের প্রথম ‘প্রিন্সিপাল’ ছিলেন।
নূর জাহান বেগম নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্ব তিনি পেয়েছিলেন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. ইউনূসের কাছ থেকে। তিনি এখন গ্রামীণ পরিবারের একটি অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে ২০১০ সালে তিনি গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি নোবেল বিজয়ী প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এছাড়া গ্রামীণ পরিবারের একটি অলাভজনক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ শিক্ষার ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক-ই-আজম সম্পর্কে জানা যায়, ফারুক-ই-আজম মুক্তিযুদ্ধের একজন বীরসেনানী। সাহসী এই যোদ্ধা বীর প্রতীক খেতাবও পেয়েছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বছরে উচ্চমাধ্যমিক পাস করা ফারুক সে সময় খুলনায় ছিলেন। পরে অনেক বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে চট্টগ্রামে পৌঁছান। তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতের হরিণা ইয়ুথ ক্যাম্পে আশ্রয় নেন ৬ মে। পরে নৌবাহিনীর জন্য মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুট করা হবে শুনলে তিনি সেখানে যোগ দেন।